৪৫০ মিলিয়ন মানুষের বর্জ্য! কুম্ভমেলা সামলাচ্ছেন সেই 'অস্পৃশ্য' সাফাইকর্মীরাই
Mahakumbh 2025: এবারের মহাকুম্ভে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মানুষ আসছেন বলে আশা করা হচ্ছে। আর তাঁদের বর্জ্য পরিষ্কার করেন তাঁদেরই সহনাগরিকরা।
এবার মহাকুম্ভ। প্রতি তিন বছর অন্তর চারটি নদীতীরবর্তী শহর প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী এবং নাসিকে পালা করে করে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এবারের মহাকুম্ভে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মানুষ আসছেন বলে আশা করা হচ্ছে। হিসেবমতো তা উত্তরপ্রদেশের জনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। কুম্ভমেলায় পবিত্র স্নান করে পাপশোধন করতে আসেন লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীরা। মেলাচলাকালীন তাঁরা ওই পরিসরেই থাকেন, দিন কাটান। তাঁরা পাপ পরিষ্কার করেন আর তাঁদের বর্জ্য পরিষ্কার করেন তাঁদেরই সহনাগরিকরা। বিশাল বিপুল এই মেলাকে পরিচ্ছন্ন রাখেন সেই মানুষরা, যাঁদের হিন্দুধর্মে বিশেষ মর্যাদাই নেই। হিন্দু বর্ণ ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তরে জন্মগ্রহণ করা তাঁদের কাছে 'অভিশাপ'। তাঁরা অভিশাপ বয়ে বেড়ান, আর বর্জ্য সাফ করে মহাকুম্ভকে পূণ্যার্থীদের সমাগমভূমি করে তোলেন।
সহস্রাব্দ প্রাচীন এই কুম্ভমেলা প্রয়াগরাজে চলবে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই বছর যেহেতু মহাকুম্ভ তাই এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সমাবেশ হতে চলেছে এই মেলা। আয়োজকরা আশা, গঙ্গা এবং যমুনা নদীর সঙ্গমস্থলে ছয় সপ্তাহব্যাপী এই উৎসবে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন তীর্থযাত্রী স্নান করবেন। এত মানুষের সমাগম, অল্পসময়ে এত মানুষের বর্জ্য সাফ করার কাজ করবেন কারা? ২,০০০ ফুটবল মাঠের চেয়েও বেশি এলাকা জুড়ে নদীতীর জুড়ে ১৫০,০০০ অস্থায়ী শৌচাগার স্থাপন করা হয়েছে। আর ৫,০০০ জন কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে শুধুমাত্র এই শৌচাগার পরিষ্কার করার জন্য। এই সাফাইকর্মীদের প্রায় সকলেই সেই প্রাচীন বর্ণবিন্যাসের অন্তর্গত সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষ। হিন্দুদেরই মেলায় যাঁদের কাজ কেবল বর্জ্য পরিষ্কার।
দ্য ওয়ারের একটি প্রতিবেদনে এই সাফাইকর্মীদের অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে। মহাকুম্ভে সাফাইয়ের কাজ করছেন সুরেশ বাল্মীকি। একা নন, তাঁর ১৭ বছরের ছেলে বিকাশ বাল্মীকিও দুর্গন্ধযুক্ত শৌচাগার সাফ করে চলেছেন রোজ। তাঁরা জানাচ্ছেন, বিপুল পরিমাণ মল-মূত্র পরিষ্কারের কাজ আরও কঠিন কারণ, একবার পরিষ্কার করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেটি আবার নোংরা হয়ে যায়। দশ মিনিটের মধ্যে ঝকঝকে শৌচাগার নোংরা হয়ে যায়।
আরও পড়ুন- নাগা সন্ন্যাসী কারা! রহস্যে ভরা এদের সাধনার পদ্ধতি জানলে শিউরে উঠতে হয়
সরকারি তথ্য বলছে, শহুরে নর্দমা এবং সেপ্টিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার প্রতি দশজন শ্রমিকের মধ্যে নয় জনই প্রান্তিক জাতির মানুষ। একসময় প্রবলভাবে 'অস্পৃশ্য' মনে করা হতো এই মানুষদের। সময় এগিয়েছে ঠিকই তবে এই ধারণা বদলায়নি আজও।
মনে করা যাক পাঁচ বছর আগের কথা। প্রয়াগরাজে শেষবার যখন এই উৎসব হয়েছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমনই পাঁচজন শ্রমিকের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, মোদির এই কাজের নেপথ্যে ছিল ভোট টানার কৌশল। কয়েক মাস পরেই ছিল ভোট। তিনি যে আসলে বর্ণবিন্যাসে বিশ্বাসী নন, তিনি যে আসলে দলিতদের পক্ষে সেই বার্তা দিয়ে আরও বড় অংশের হিন্দুভোট এককাট্টা করার একটি কৌশলের অংশ ছিল ওই পা ধুইয়ে দেওয়া। 'পলিটিকাল স্টান্ট' ছাড়া এই ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেই নারাজ রাজনৈতিকে বিশ্লেষকদের যুক্তিবাদী অংশ।
একজন মানুষ কোন ঘরে কোন পরিবারে জন্মাচ্ছে তা কীভাবেই বা তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে! উচ্চ বর্ণের মানুষ মানেই পড়াশোনা, সাংস্কৃতিক চর্চা সব তাঁর বরাদ্দ, তিনিই সব সুবিধা পাবেন কারণ তাঁর পদবি উচ্চবর্ণের আর স্রেফ নিম্নবর্ণের ঘরে জন্মানোর কারণে একদল মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়েই যাবে আজীবন এই রীতি মনুবাদী সংস্কৃতিতে মান্যতা পায় আজও। সাফাইকর্মীরা বলছেন, সময় এগিয়েছে ঠিকই কিন্তু তাঁদের প্রতি গভীর অবজ্ঞার মনোভাব একই রয়ে গেছে। এমনকী অনেক মানুষ আজও শৌচাগার ব্যবহার করে জল পর্যন্ত ঢালেন না। "লোকেরা বলে টয়লেট পরিষ্কার করা আমাদের কাজ, তাহলে তারা কেন জল ঢালতে যাবে?” বলছেন গীতা বাল্মীকি। প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কুম্ভমেলায় কাজ করেছেন তিনি দৈনিক সাড়ে তিনশো টাকা মজুরিতে।
সাফাইকর্মীদের কাজ আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে শৌচাগারের সঙ্গে প্রচুর জলের বন্দোবস্ত না থাকায়। ইচ্ছে করেই অবাধ জলের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আয়োজকরা জানিয়েছেন, ঢালাও জল থাকলে সেপটিক ট্যাঙ্কগুলি কয়েক ঘণ্টা অন্তর অন্তর পরিষ্কাত করতে হতো। পরিবর্তে, শৌচাগার ব্যবহারকারীদের অবশ্যই বাইরের জলের কল থেকে এক বালতি জল ভরে নিয়েই কাজ সারতে হবে। প্রতি দশটি শৌচাগার প্রতি একটি জলের কল রয়েছে। কিন্তু বালতিও সংখ্যায় কম। ফলে লোকজন জলের বোতল ব্যবহার করে, যা তারা আবার টয়লেটের ভিতরেই ফেলে দেয়।
আরও পড়ুন- অমৃতের সন্ধানে সমরেশ : সুমন চট্টোপাধ্যায়
হাতে করে এই সাফাই এড়াতে শ্রমিকদের জেট স্প্রে মেশিন দেওয়া হয়েছে। তবে অনেকে বলছেন। তাতে জলের চাপ যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। আয়োজকরা বলছেন, বর্জ্য পরিষ্কারের সমস্যা মোকাবিলায় আধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। বিশেষভাবে নির্মিত অস্থায়ী সেপটিক ট্যাঙ্কগুলির ভরাট হওয়া আটকাতে ২৫০ সাকশন গাড়ি মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু পোর্টেবল টয়লেট কেবিনে কাজ করা শ্রমিকরা বলছেন, এখনও তাঁদের ট্যাঙ্কে নামতেই হচ্ছে এবং নোংরা হতে হচ্ছে।
যতই শৌচাগার সাফ হোক, পরিদর্শন হোক না কেন মানুষের বর্জ্য উপচে পড়ছে যত্রতত্র। দুর্গন্ধ এড়াতে নাক ঢেকে সাফাইকর্মীরা নোংরা পরিষ্কার করছেন। বংশ পরম্পরায় এটাই তাঁদের কাজ। সাফাইকর্মীরা বলছেন, "বড় বড় মানুষ আসে, মল ত্যাগ করে এবং তা আমাদের পরিষ্কার করতে হয় যাতে আমরা দু' মুঠো খেতে পারি। এটাই জীবন।" ‘বড়' মানুষরা 'পাপ' ধুতে আসেন আর সাফাইকর্মীরা চিরকাল ধরে শূদ্র থেকে যান, অস্পৃশ্য থেকে যান। বড়লোকের বর্জ্য সাফই যাঁদের নিয়তি হয়ে যায়।