অপুষ্টিতে ভুগে মরছে লাখো লাখো শিশু, এই ভারত চেয়েছিলেন নেতাজি?
Malnutrition in India: নেতাজি থাকলে দেশ বদলে যেত কী না, দেশে ঘৃণার চাষ আদৌ সম্ভব হতো কী না, দেশের বাচ্চারা না খেতে পেয়ে কাতরাতো কী না সেই তর্ক দেওয়ালে ঘা খেয়ে ফিরে আসে।
চামড়া পাতলা, নীচের পাঁজর সেই চামড়ার উপর ঢেউ খেলিয়ে যায়। ধুলোর শরীর, বাতিল সিক্কার মন। প্রতি দিন জন্মায়, প্রতিদিন মরে। পর দিন ফের জন্মায় অন্যত্র, প্লাটফর্মে গড়াগড়ি খায়, এঁদো বস্তির রাতে ফ্যালফ্যাল করে আকাশ দেখে, চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসে। জিরজিরানি দেহের এই চরিত্রদের ভারতে বলে স্যাম চিলড্রেন। SAM শিশুরা খাবার পায় না, পুষ্টিও না। মাঝে সাঝে চ্যারিটির নামে থ্যাঁতলানো কমলালেবু আসে। এসব কমলালেবুর মালিক-মালকিনদের গল্প বেশ মধুর। চ্যারিটি, সকলেই জেনেছি বাড়িতেই শুরু হয়। কিন্তু চ্যারিটির প্রয়োগ যাদের ক্ষেত্রে হয়, মানে ধরা যাক ওই এঁদো বাচ্চাদের, তাঁদের বাড়িতে বসিয়ে পাত পেড়ে খাইয়ে কিন্তু চ্যারিটি হয় না। এই 'খেতে না পাওয়া' আহারে এঁদো বাচ্চাদের পিছনে তাই এক শহুরে মায়া তাড়া করে বেড়ায়। তাড়া করে করে কমলালেবু ছুঁড়ে মারে, প্যাকেটভর্তি কেক ছুঁড়ে মারে, মাংসের হাড়ের মতো সেই মায়া একবেলার পেটে গেঁথে যায়। তাতে দিন কাটে না। সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশনের স্যাম শিশুরা দেশ জুড়ে বাড়তেই থাকে, মরতেই থাকে।
আমাদের দেশে, মানে ৭৫ বছর পার করে আসা স্বাধীন ভারতে পুষ্টির অপর নাম পিএম পোষণ। আর দেশে SAM শিশুর সংখ্যা ৯.২ লাখ। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গুরুতর তীব্র অপুষ্টি বা SAM (severe acute malnutrition) আক্রান্ত শিশু তারাই যাদের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন অত্যন্ত কম এবং উপরের বাহুর পরিধি ১১৫ মিমি-র থেকেও কম। SAM-এ আক্রান্ত শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতটাই কম যে তাঁদের মৃত্যুর আশঙ্কা নয় গুণ বেশি। কোভিড-১৯ মহামারী ভারতে ৯.২ লক্ষ শিশুকে তীব্র অপুষ্টির মুখে ফেলেছে। সবচেয়ে বেশি অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু রয়েছে উত্তরপ্রদেশে, তারপরেই রয়েছে বিহার। সরকার কিন্তু আগেই হাত তুলে রেখেছিল। তথ্য জানার অধিকার আইনে একটি প্রশ্নের জবাবে সরকার আগেভাগেই জানিয়েছিল, কোভিড মহামারী দরিদ্রদের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। কোভিড না হয় গোটা বিশ্বকেই ছারখার করেছে, অর্থনীতি ফের কবে সোজা হয়ে দাঁড়াবে বলাও মুশকিল কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর আগে অবস্থাটা কেমন ছিল?
দ্য গ্লোবাল নিউট্রিশন ইনডেক্স ২০১৮ সালেই জানিয়েছিল, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ অপুষ্টিতে ভোগা শিশু ভারতেই রয়েছে। প্রতি বছর তো দেশে এইসব তথ্য মেলে না। ২০২১ সালে তো জনগণনাও হয়নি। তাই NFHS-4 অর্থাৎ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার প্রতিবেদনে চোখ রাখতে হয়। ২০১৫-১৬ সালে ৬০১,৫০৯ টি পরিবারের ৭.৪ শতাংশ শিশু, ৬৯৯,৬৮৬ জন মহিলা এবং ১১২,১২২ জন পুরুষের মধ্যে গুরুতর তীব্র অপুষ্টির সমস্যা দেখা গিয়েছে৷ ৬.১ লক্ষ পরিবার নিয়ে পরবর্তী সমীক্ষা NFHS-5 করা হয়। ২২ টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির যা পরিসংখ্যান উঠে এসেছে তা আরও ভয়াবহ। সমীক্ষা বলছে, এই রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ২০১৫-১৬ সাল থেকে ২০১৯-২০ সালের মধ্যে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি বহুগুণ বেড়েছে। ভারতের অন্তত ৩৫.৫ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার।
আরও পড়ুন- ভারতে প্রতি বছর অপুষ্টিতেই মারা যাচ্ছে লাখো মানুষ! শিউরে উঠতে হবে যে তথ্যে…
দেশে অপুষ্টির সমস্যা মোকাবিলার জন্য, শিশু, কিশোরী এবং মহিলাদের মধ্যে কম ওজন, অপুষ্টি এবং রক্তাল্পতা কমাতে কেন্দ্র ২০১৮ সালে এই পিএম পোষণ অভিযান (প্রধানমন্ত্রী পোষণ শক্তি নির্মাণ) কর্মসূচি চালু করেছিল। জাতীয় পুষ্টি অভিযান (ন্যাশনাল নিউট্রিশন মিশন) নামেও পরিচিত এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল, অপুষ্টির মাত্রা কমানো এবং দেশের শিশুদের পুষ্টির মান উন্নত করা। রক্তাল্পতা, কম পুষ্টি এবং কম ওজনের সমস্যা কমানোর লক্ষ্যেই এই কর্মসূচি নেওয়া। তা কর্মসূচি তো নেওয়া হলো, দেশের হইল কী?
২০১৯ সালে ইউনিসেফ জানাল, বিশ্বব্যাপী ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে কম উচ্চতা, ১০১ মিলিয়ন শিশু বয়সের তুলনায় কম ওজনের সমস্যায় ভুগছে। জাতিসংঘ জানাচ্ছে, ভারতে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৬.৩ মিলিয়ন শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৪৫% অপুষ্টির কারণেই ঘটেছে।
NFHS-4 অনুযায়ী, তপশিলি উপজাতির পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪৩.৮ শতাংশ শিশুই অপুষ্টির শিকার এবং ৪৫.৩% শিশুর ওজন অত্যন্ত কম। তপশিলি জাতির শিশুদের মধ্যে ৪২.৮ শতাংশ অপুষ্টির শিকার এবং ৩৯.১ শতাংশের ওজন কম। তপশিলি জাতি এবং উপজাতির শিশুদের মধ্যে রক্তাল্পতার প্রকোপও অত্যন্ত বেশি। আর ওদিকে জাতিসংঘের শিশু অধিকার কনভেনশনে (UNCRC) স্বাক্ষরকারী ১৯৩টি দেশের মধ্যে ভারত অন্যতম। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি, স্বাস্থ্য পরিষেবা দেশের প্রথম লক্ষ্য বলেই জানা যায়। তবু দেশে ধুঁকছে দেশেরই আগামী প্রজন্ম, যারা কোনওদিনই যোগ্য 'ওয়ার্কফোর্স' হয়ে উঠবে না ভারতের।
অপুষ্টির কারণ নিয়ে নতুন করে বলার মতো কিছুই আর ভাঁড়ারে নেই। পকেটে টাকা নেই, পেটে খিদে আছে। খিদে আর অর্থের ব্যস্তানুপাতিক এই সম্পর্কে সবচেয়ে ভুক্তভোগী শিশুরা আর শিশুদের মায়েরা, সে গর্ভাবস্থাতেই হোক বা জন্মের পরে। কারণ, দুর্বলদের মধ্যে দুর্বলতর এরাই। একই পরিবারে পেট অনেক। 'ক্ষমতা যদি নেই খাওয়ানোর তাহলে সন্তান নাও কেন' জাতীয় জ্ঞানের বাণীর মুখে থুতু ফেলে দেয় পিতৃতন্ত্র। একটা পোঁটলা সম্বল হলেও তার পুরুষ উত্তরাধিকারীই কাম্য, চিরকাল। ফলে দরিদ্রতম পরিবারের ক্ষেত্রে 'যা এনেছো সবাই ভাগ করে নাও' জাতীয় প্রথাটিও বৈষম্যমূলক। মাছের বড় টুকরো বা গোটা ডিম পুরুষ সন্তানের প্রাপ্য, কন্যাটির অভিধানে কোনও ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি১২-এর জায়গা হয়নি। অপুষ্টিতে ভোগা মা মাসে রক্তপাত ঘটাতে ঘটাতে গর্ভধারণও করে, রোগা জিরজিরে SAM সন্তান জন্মায়। চক্রবৎ কিছুরই পরিবর্তন হয় না।
আরও পড়ুন- দেশজুড়ে অপুষ্টি, অনাহার! দারিদ্র কমার শুকনো পরিসংখ্যান হাসি ফোটাবে ভারতীয়দের মুখে?
সরকার, স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের মাংস, মরশুমি ফল খাওয়াতে বলেছে। ‘পিএম পোষণ প্রকল্প’-এর আওতায় স্কুল পড়ুয়া শিশুদের পুষ্টি জোগাতে আমাদের রাজ্য সরকারের স্কুল শিক্ষা দফতর ৩৭১ কোটি ৯০ লক্ষ ৭৮ হাজার ৪০০ টাকা অতিরিক্ত তহবিল দিচ্ছে মিড-ডে মিল প্রকল্পে। নেতাজির জন্মদিন থেকে, মানে ২০২৩ সালে ২৩ জানুয়ারি থেকে ২৩ এপ্রিল এই ৪ মাসের জন্য টাকা বরাদ্দ হয়ে গিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এই মুহূর্তে মিড-ডে মিলে প্রাথমিকে পড়ুয়া-পিছু বরাদ্দ ৫ টাকা ৪৫ পয়সা। কেন্দ্র দেয় ৩ টাকা ২৭ পয়সা আর রাজ্য ২ টাকা ১৮ পয়সা। উচ্চপ্রাথমিকে মোট বরাদ্দ ৮ টাকা ১৭ পয়সা। কেন্দ্র দেয় ৪ টাকা ৯০ পয়সা, রাজ্য ৩ টাকা ২৭ পয়সা। এই আগুন বাজারে এক শিশুকে এই টাকায় কী পুষ্টি জোগানো যেতে পারে তা খুব সহজ অঙ্কই! রোজ গ্যাসই খরচ হয় দেড়শো টাকার উপর, সরকার রন্ধনকর্মীর খরচ দেয় মাসে ১৫০০ টাকা। তারপরেও যা খরচ তাতে অপুষ্টি মুক্ত ভারতের স্বপ্নে বেশি জ্বালানি দেওয়া পড়তায় পোষায় না।
এর পরে দুর্নীতি, চাল চুরি, ডিম চুরির মিষ্টি মধুর রাজনৈতিক আখ্যান শব্দের মেদ বাড়াবে মাত্র। ২৩ জানুয়ারি দিনটিকে বাছা হয়েছে প্রকল্পের শুরুয়াদ হিসেবে। এসব বিশেষ দিন, বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ মূর্তিকে সামনে রাখতেই হয় রাজনীতিবিদদের। মূর্তি নেমে এসে ছারখার করে না, মূর্তি দুর্নীতির কলার ধরে থাপ্পড় মারে না। মূর্তি এমনকী, সবটুকু দেখেও স্থাণুবৎ থাকে। নেতাজি থাকলে দেশ বদলে যেত কী না, দেশে ঘৃণার চাষ আদৌ সম্ভব হতো কী না, দেশের বাচ্চারা না খেতে পেয়ে কাতরাতো কী না সেই তর্ক দেওয়ালে ঘা খেয়ে ফিরে আসা ক্ষীণ আলোর মতোই। নেতাজি নেই, অপুষ্টি আছে, দুর্নীতি আছে, এবং আমাদের বিপ্লবের শীতঘুম আছে। এটুকুই সত্য। বাকিটা রবিবার।