উচ্চমাধ্যমিক ফেল ছাত্র আজ ইউপিএসসি চেয়ারম্যান! হার না মানা লড়াই অনুপ্রেরণা হতে পারে

হার না-মানা মনোভাবই শেষ পর্যন্ত জয়পতাকা তুলে দিয়েছে মনোজ সোনির হাতে।

কে মনোজ সোনি? উত্তরটা হয়তো অনেকেরই জানা। ইউপিএসসি-র একত্রিশতম চেয়ারম্যান। কিন্তু ভারতের সরকারি আধিকারিকদের নিয়োগ করার গুরুভার যাঁর হাতে ন্যস্ত, সেই মনোজ সোনির হার না-মানা লড়াইয়ের গল্পটা হয়তো অনেকেই জানেন না। জানেন না বন্ধুর পথ পেরিয়ে আসা তাঁর লম্বা সফরের গল্পটাও। হ্যাঁ সেদিনের সেই দাঁতে দাঁত চেপে অসহনীয় দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্পকে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রূপকথা বলেই মনে হয় মনোজের। বিশ্বাস হতে চায় না গুজরাতের আনন্দ জেলার সেই একরত্তি দুরন্ত শিশু আজকে একপ্রকার ভারতের ভাগ্যনিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। পিছনে ফিরে তাকালে আজও সবকিছু কেমন যেন স্বপ্ন বলে মনে হয়।


কালীপ্রসন্ন ঘোষের সেই কবিতাটা মনে আছে? 'পারিব না একথাটি বলিও না আর/…একবার না পারিলে দেখ শতবার।' এই কবিতাটি মনোজের জীবনের ক্ষেত্রে যেন চরম বাস্তব। হ্যাঁ, ব্যক্তিগত জীবনে মনোজ সাক্ষী বহু লড়াইয়ের। মনোজ কখনও পেরেছেন, কখনও বা পারেননি। কিন্তু হতাশ হয়ে পড়েননি কখনও। আগের ব্যর্থতা ভুলে নতুন করে শুরু করেছেন মনোজ, ঢাকার চেষ্টা করেছেন গতবারের ভুলত্রুটি। ফলশ্রুতি, আজকের ইউপিএসসি-র চেয়ারম্যান মনোজ সোনি।


১৯৬৫ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন মনোজ সোনি। জন্মের বছরপাঁচেকের মধ্যে জীবনের অন্যতম কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হয় মনোজকে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান মনোজ। আর তারপরই শুরু হল লড়াই, সে লড়াই দারিদ্রের বিরুদ্ধে, সে লড়াই পিতৃহীন সন্তানের বাঁচার লড়াই। অবশ্য দারিদ্র ছিল মনোজদের নিত্যসঙ্গী। বাবা দিনানিপাত করতেন মুম্বইয়ের ফুটপাথে হকারি করে। বাবার মৃত্যুর পর আরও কঠিন হল সেই লড়াই। মনোজের বয়স যখন দশ বছর, সেই সময় তাঁর মা সিদ্ধান্ত নেন মুম্বই ছাড়ার, মুম্বই ছেড়ে গুজরাতে পাড়ি জমালেন সোনির মা। গুজরাতে এসে শুরু হল আরও এক লড়াই, এ লড়াই সমাজের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর লড়াই, দেশের জন্য কিছু করতে চাওয়ার লড়াই। পড়াশোনাকে সেই লড়াইয়ের একমাত্র অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন সোনি। যদিও সেক্ষেত্রেও দারিদ্রর সঙ্গে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। এমনকী, পড়াশোনার খরচ চালাতে আজকের ইউপিএসসি চেয়ারম্যানকে একসময় বিক্রি করতে হয়েছিল ধূপকাঠি। তবে আগাগোড়াই যে খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন সোনি, তা হয়তো নয়। তিনি ফেলও করেছিলেন দ্বাদশ শ্রেণিতে। তবে ওই হার না-মানা মনোভাবই শেষ পর্যন্ত জয়পতাকা তুলে দিয়েছে সোনির হাতে।

 

আরও পড়ুন: ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কেউ, অশনির অভিশাপ বদলে গেল বর্ষার আশীর্বাদে

 

ইউপিএসসি-র চেয়ারম্যান পদে আসীন হবার আগে গুজরাতের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন মনোজ সোনি। তার আগে ১৯৯১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন তিনি। দেশের সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তিরূপে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অভিষিক্ত হওয়ার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন মনোজ। পরবর্তী সময়ে মহারাজা শিবাজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। মনোজের বিষয় ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন মনোজ সোনি।


তবে শুধু পড়াশোনা নয়, মনোজ সোনি ছিলেন স্বামীনারায়ণ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্য। এছাড়াও অনুপম নামক একটি মিশনের কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন মনোজ সোনি। অর্থাৎ এককথায় বলা চলে, মনোজের চরিত্র ছিল নানা রঙে রঙিন।


মনোজ সোনির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৭ জুন। তবে মনোজ সোনিকে নিয়ে কিন্তু কম বিতর্ক হয়নি। বহু প্রাক্তন আইএএস অফিসার প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁর নিয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা নিয়ে। মনোজ সোনির নিয়োগ-সংক্রান্ত প্রশ্নে ছাড় পায়নি মোদি সরকারও।


কিন্তু এতকিছুর পরেও বাবাকে হারিয়ে দারিদ্রর কোপে বলি হয়ে মায়ের হাত ধরে মুম্বই থেকে গুজরাত পালিয়ে আসা অভাবের চাপে ধূপকাঠি বিক্রি দ্বাদশ শ্রেণিতে ফেল করার পরেও বর্তমানে ইউপিএসসি-র চেয়ারম্যান। এর পিছনে যে অনন্ত লড়াই, শুধু সব অন্ধকারকে হারিয়ে একমুঠো রোদ ছুঁয়ে দেখার আশায়, সেই লড়াইকে কি কখনও অস্বীকার করার চলে? উত্তর, বোধহয় না। আর সেই কারণেই মনোজ সোনি পাথেয় হয়ে থেকে যাবেন বহু নাম না-জানা মানুষের কাছে।

More Articles