“আমাদের নাম কি বাদ পড়বে?”: এসআইআর আতঙ্কে উত্তরবঙ্গের রাজবংশীরা
Rajbanshi Anxiety Over SIR: কোচবিহারে রাসমেলা উত্তরবঙ্গ এবং আসামের মানুষের সবথেকে বড় মিলনস্থল, সেই মেলা জুড়ে এবার যেমন নজরকাড়া ছিল এসআইআরের প্রচার, তেমন ছিল এ অঞ্চলের আবেগের শিল্পী জুবিন গার্গের ছবি আর তাঁর গান।
কোচবিহার জেলাটি আসাম লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসামের রাজনৈতিক হাওয়া বেশি দোলায় এই জেলাকে। কোচ রাজবংশের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা ১৮৯১ সালে এক আন্দোলন করে নিজেদের রাজবংশী স্বতন্ত্র পরিচয় গ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গ এখনও এককভাবে সবথেকে বেশি সংখ্যার তফসিলি জাতি রাজবংশীরা। কৃষি এবং চা-বাগান, মাছ ধরা এমন ছোট ছোট নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের মধ্যে আবদ্ধ রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে এখন শিক্ষার হার কিছুটা বেড়েছে, সরকারি চাকরিতে উচ্চ পদে কাজ করছেন অনেক রাজবংশী। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এখনও আর্থিক অনটনের শিকার। ৬০ ভাগ রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন, এমন তথ্য একাধিক সরকারি সমীক্ষায় উঠে এসছে। সাক্ষরতার হার বাড়লেও আর্থিক অনটন এমন অনিশ্চয়তা তৈরি করছে যার ফলে প্রাথমিক স্তরের পর স্কুলে ড্রপ আউট, গ্রামীণ স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থান প্রকল্প বেহাল থাকায় উত্তরপূর্বের রাজ্যে দিনমজুরির কাজ করতে যাচ্ছে বহু পরিবার। এই সব পরিবার এতটাই আর্থিক ভাবে দূর্বল এসআইআর-এর কাজ করতে তাঁরা যে বাড়ি ফিরবেন সেই খরচও জোগাড় করা তাঁদের পক্ষে বিরাট চাপের হয়ে যাচ্ছে, ফলে তারা অনেকেই আসছেন না।
রাজবংশীরা অত্যন্ত সহজ সরল মনের মানুষ। তাঁরা চতুর নন বলে বারবার সুবিধাবাদী রাজনীতির শিকার হন
এমন আক্ষেপ প্রাক্তন সাংসদ তারিণী রায়ের।
তাই কি রাসমেলার মতো কোচবিহারের বিখ্যাত উৎসবেও চতুর্দিকে এসআইআর? কোচবিহার পুরসভার চেয়ারম্যান তৃণমূল কংগ্রেসের আদি নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন,
একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছে বিজেপি। পাশের আসামের ঘটনা, ডিটেনশন ক্যাম্প এসব নিয়ে ওরা প্রচার করে রাজবংশী মানুষের মধ্যে ভয় ছড়াচ্ছে।

কোচবিহারের তৃণমূল কংগ্রেসের আদি নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ
আসামের ১১ টি জেলায় যাদের নাম বাদ পড়েছে তাদের বড় অংশ রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ। এমনকি এর মধ্যে অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছেন, ফলে আসাম এসআইআর নিয়ে আতঙ্ক বাড়িয়েছে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে। ভেটাগুড়ির ব্যবসায়ী দিনেন রায় বলেন,
আসামের এক গ্রামে জন্ম আমার, পরে কোচবিহারে বসবাস। অনেকের আবার আত্মীয় পরিজন সব আসামে। ফলে এখন একটা চাপা উৎকন্ঠা সবার মধ্যেই।
আরও পড়ুন
‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন আজও | টোটোপাড়ায় এসআইআর যে প্রশ্ন তুলছে
শুধু কোচবিহার নয় আলিপুরদুয়ার জলপাইগুড়ি দার্জিলিং দক্ষিণ দিনাজপুর মালদহ পাশের রাজ্য বিহার এমনকি বাংলাদেশেও রাজবংশী সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষ থাকেন। তবে যারা পশ্চিমবঙ্গে আছেন তাদের মধ্যে এখন ভয়টা বেশি। এই ভয়ের কারণ কী? কোচবিহার জেলার সিপিএমের সম্পাদক অনন্ত রায়, তিনি নিজেও রাজবংশী সম্প্রদায়ের। তিনি বলেন,
নথি না থাকলেই অবৈধ ভোটারের অভিযোগ তুলে সাজা বা বাংলাদেশ পাঠানো বা ডিটেনশন ক্যাম্পে জীবন কাটাতে হবে— আরএসএস, বিজেপি কৌশল করে এই ভয় দেখিয়ে প্রচার করে চলেছে। আসলে ওরা ভয় দেখিয়ে মন জয় করতে চায়। কিন্তু বাস্তব হলো গত কয়েক বছরে বন্যা-সহ প্রাকৃতিক দূর্যোগে বহু গরিব মানুষ কোনো ভাবে প্রাণ রক্ষা করেছেন। তাঁদের ঘরের সঙ্গে নথিও নেই, নষ্ট হয়েছে বা ভেসে গিয়েছে। এসব মানুষরা অনেকে ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সরকারি দফতরে বলেছেন, কিন্তু সরকার আমল দেয়নি। এখন ভয়টা বাড়ছে। আমরা ওদের পাশে থেকে আইনী সহায়তা করব।

কোচবিহারের জেলার সিপিএমের সম্পাদক অনন্ত রায়
জেলার ছোট ছোট জেরক্স সাইবার ক্যাফে দোকান গুলি আবার যেন লাভের মুখ দেখছে। দীপক বর্মন নামে একজন রাজবংশী সম্প্রদায়ের অল্প বয়সি ছেলে বলেন,
ছবি লাগবে এসআইআর ফর্মে কিন্তু আধার ভোটার রেশন কার্ড সব বেশ কিছু কপি করে জেরক্স করছেন এলাকাবাসীরা।
প্রায় প্রতি পরিবারের পুরুষরা কাজের সূত্রে পরিযায়ী তাই তাদের নাম যেন বাদ না পড়ে শাসক দলের নেতারা সে বিষয়ে দেখভাল করবেন বলছেন কিন্তু সেসব পরিবারকে খরচ জোগাড় করিয়ে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে নীরব তারা, একটা চাপা আতঙ্ক ভয় যে সবার মাধ্যেই আছে তা পরিষ্কার। সিতাই এলাকার মহঃ সফিক শেখ আসামের ঘটনার উল্লেখ টেনে বলেন,
আমরাও রাজবংশী, তবে নস্যশেখ। আমাদের দাদুর নামও এলাকার ভোটার লিস্টে ছিল, ফলে আমরা স্থানীয় বাসিন্দা এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এখন সমস্যা হচ্ছে এসআইআর ফর্ম জমা দেওয়ার সময় বিএলওকে আসল আধার এবং ভোটার কার্ড দেখাতে হয়, সাম্প্রতিক দূর্যোগের সময় আমাদের সব পারিবারিক নথি নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আমরা আবেদন করেছি নতুন নথির জন্য। কিন্তু এখনও হাতে পাইনি ফলে উদ্বেগ আছে। এমন অবস্থা বহু পরিবারের।
রাজবংশীদের সরলতাকে কাজে লাগানো বা তাদের সহজে বিভ্রান্ত করার কৌশলে বিজেপির প্রভাব থাকলেও এবার তৃণমূলও তাদের মধ্যে সমর্থন বাড়াতে তৎপর। এবার রাজবংশী সম্প্রদায়ের গর্বের মানুষ বীর চিলা রায়ের জন্মদিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করতে চলেছে রাজ্য সরকার। রাজ্য সরকারের রাজবংশী ভাষা অকাদেমির চেয়ারম্যান বংশীবদন বর্মন বলেন,
এসআইআর-এ রাজবংশীদের নাম যেন বাদ না পড়ে, আমরা সেটা নজর রাখছি। তবে আমাদের গ্রেটার কোচবিহার রাজ্যের আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, তিনি বলেছেন আমাদের সঙ্গে থাকো আমিও তোমাদের উন্নয়ন করব। রাজবংশীদের বিদ্যুৎ বিল মকুব করেছে সরকার। কিছু উন্নয়ন হয়েছে, আমরা সে কারণে সরকারের পাশে আছি। কিন্তু যে গতিতে উন্নয়ন হচ্ছে তাও কিন্তু মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়।

কোচবিহারের রাসমেলায় সিপিআই(এম)-এর সহয়তা কেন্দ্র
নতুন রাজ্যের দাবি ভোটের আগে লুকানো তাস হিসেবে সামনে আসে। কখনও বিজেপির শীর্ষ নেতারা আলাদা রাজ্যের দাবিকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করেন আবার তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে থাকলে তারাও তাদের পাশে থাকবেন এমন আশ্বাস দেওয়া হয়। এর মাঝে কিন্তু নতুন রাজ্যের থেকে বড় দাবি হয়ে উঠেছে এসআইআরে রাজবংশীদের নাগরিকতার নিশ্চয়তা রক্ষা করা। ইতোমধ্যেই অনেক এলাকায় গিয়ে ভোটারদের পরিবারে তালা বন্ধ দেখে ফিরে এসছেন বিএলও, ফোনে সে সব পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা কর্নাটক বা কেরালায় কর্মরত বলে জানিয়েছেন। তাঁরা এসআইআর-এর ফর্ম পূরণ করতে খরচ করে বাড়ি ফিরবেন না এমন কথাও বলেছেন অনেকে। পরিস্থিতি একরকম নেই সেটা শাসক এবং প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও বুঝতে পারছে।
আরও পড়ুন
এসআইআর | যেভাবে নাভিশ্বাস উঠছে বিএলওদের
মাথাভাঙা এলাকার কলেজ ছাত্রী সুমিতা রায়ের কথায়,
সরকারি বিদ্যুতের বিল না হয় লাগবে না, কিন্তু নিজের বিরাট বাড়ি এবং সে বাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করার মতো অবস্থা কতজন রাজবংশী মানুষের আছে সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। আমাদের নিজস্ব যে লোকসংস্কৃতি সেটার চর্চাই এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর্থিক অনটনটা বড় সমস্যা।
কোচবিহারে রাসমেলা উত্তরবঙ্গ এবং আসামের মানুষের সবথেকে বড় মিলনস্থল, সেই মেলা জুড়ে এবার যেমন নজরকাড়া ছিল এসআইআরের প্রচার, তেমন ছিল এ অঞ্চলের আবেগের শিল্পী জুবিন গার্গের ছবি আর তাঁর গান। বিজেপি নেতৃত্ব বারবার বলছেন বিরাট সংখ্যায় মানুষ বাদ পড়বেন এসআইআরের ফলে। কিন্তু আসামের মতো এই ঘোষণা কাদের প্রতি এটাই আতঙ্কের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে। এলাকার বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত মহারাজ এখনও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল দ্রুত ঘোষিত হবে কোচবিহারে এমন আশা করছেন, কিন্তু এসআইআর প্রসঙ্গে বলেন,
অনেকের তো কাগজপত্র নথি ঠিক নেই, ফলে হয়ত অনেকের নামও বাদ যেতে পারে!
ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা যে অনুন্নত সম্প্রদায়ের মধ্যে চেতনা গড়ে তুলে তাঁদের অধিকার বোধের ভাবনা শিক্ষার প্রসারের প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন সেই সম্প্রদায়ের মানুষরা নাগরিকত্ব রাখার জন্যই এখন মরিয়া। নাগরিক তালিকায় নাম তোলার জন্য রাজবংশী সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ এখন সচেতনভাবে চেষ্টা শুরু করেছেন।
(মূল প্রতিবেদনটি প্রাথমিক ভাবে দ্য ওয়্যার-এ প্রকাশিত হয়েছিল।)
Whatsapp
