এক মাস পর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ ইমরান খানের! নিরাপত্তা নাকি রাজনৈতিক কৌশল?
Imran Khan’s Prison Isolation: অবশেষে ২ ডিসেম্বর ইমরান খানের বোন উজমা খানম ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করেন। মাত্র ৩০ মিনিটের সেই সাক্ষাতে মোবাইল রাখা বা আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া, কিছুরই অনুমতি ছিল না।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ২০২৩ সাল থেকে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা জেলে বন্দি তিনি, কিন্তু গত এক মাস ধরে পরিবার বা আইনজীবীদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয়নি। আদালতের স্পষ্ট অনুমতি থাকলেও জেল কর্তৃপক্ষ তা মানেনি, যা দেশজুড়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জনপ্রিয় এক নেতার সঙ্গে এমন আচরণ রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, ইমরান খানকে ঘিরে এই কঠোর অবস্থান কি কেবল নিরাপত্তার দাবি, নাকি পাকিস্তানের ক্ষমতার রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা?
দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় নথি ফাঁস থেকে শুরু করে দাঙ্গা উস্কানির অভিযোগে বিভিন্ন মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে রয়েছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তবে ইমরান ও তাঁর দল পিটিআই (তেহরিক-ই-ইনসাফ) শুরু থেকেই দাবি করছে, এই অভিযোগগুলি করা হয়েছে স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। তাঁদের অভিযোগ, পরিকল্পিত ভাবে এসব মামলা দেওয়া হয়েছে শুধু তাঁকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরিয়ে রাখতে এবং ভবিষ্যতের ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা নিতে না দেওয়ার জন্য।
আদালত নির্দেশ দিয়েছিল, প্রতি সপ্তাহে দু’দিন ইমরান খানের পরিবার ও আইনজীবীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। কিন্তু গত এক মাস পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে কোনো সাক্ষাৎই করতে দেওয়া হয়নি। জেল কর্তৃপক্ষ 'নিরাপত্তা'র অজুহাতে সাক্ষাৎ বন্ধ রেখেছিল। এতে ইমরান খানের পরিবার ও সমর্থকদের মধ্যে চরম উদ্বেগ তৈরি হয়। তাঁরা অভিযোগ করেন, ইমরান খানকে ইচ্ছাকৃতভাবে একা রাখা হচ্ছে, যাতে মানসিক চাপ বাড়ে এবং রাজনৈতিকভাবে তাঁকে দুর্বল করা যায়।
আরও পড়ুন
ট্রাম্পের সাহায্য প্রার্থনা! পাকিস্তানের জেলে বসে যা লিখলেন ইমরান খান
অবশেষে ২ ডিসেম্বর ইমরান খানের বোন উজমা খানম ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করেন। মাত্র ৩০ মিনিটের সেই সাক্ষাতে মোবাইল রাখা বা আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া, কিছুরই অনুমতি ছিল না। উজমা জানান, ইমরান খান শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। তবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে একা সেলে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। দিনের আলো দেখতে পাচ্ছেন খুব সীমিত সময়। তিনি বলেছেন, এটি 'মানসিক অত্যাচারের' মতো। পরিবারের দাবি, জেল কর্তৃপক্ষ নিয়ম মানছে না, আদালতের নির্দেশও উপেক্ষা করছে।
তাঁর সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়ায় বড় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে কারণ, তিনি দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে আলোচিত রাজনীতিকদের একজন। তাঁর সঙ্গে কী আচরণ হচ্ছে, সেটি পুরো দেশের রাজনীতিকে স্বাভাবিক ভাবেই প্রভাবিত করে। একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে এক মাস ধরে দেখতে না দেওয়া খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা বলে উল্লেখ মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। গুরুত্বপূর্ণ হলো, যেখানে আদালত সাক্ষাৎ অনুমোদন দিয়েছিল কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তা মানেনি। এখন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছে, পাকিস্তানে কি সত্যিই আইন কাজ করে, নাকি সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় শক্তিই সব নিয়ন্ত্রণ করে?
অন্যদিকে পিটিআই বলছে, ইমরান খানকে ভয় দেখানো হচ্ছে। তাঁকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলছে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতাসীন প্রতিষ্ঠানগুলি চাইছে ইমরান খান রাজনৈতিক সমঝোতায় রাজি হোন বা সম্পূর্ণ চুপ হয়ে যান। সমালোচকরা বলছেন, যে কোনো জনপ্রিয় নেতাকে বন্দি করা হলে, এবং দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ রাখলে জনগণের সহানুভূতি বাড়তে পারে। এই ভয়েই হয়ত সরকার চায় পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তবে সরকার ও জেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ইমরান খান সুস্থ আছেন, তাঁর কোনো ঝুঁকি নেই। নিরাপত্তাজনিত কারণেই নাকি সাক্ষাৎ বন্ধ রাখা হয়েছিল। গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধেও সতর্ক করেছে সরকার ও জেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সরকার কখনও পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেনি, কেন আদালতের নির্দেশ মানা হয়নি?
আরও পড়ুন
পাকিস্তানে ক্ষমতাকেন্দ্রে আসীম মুনির! অভূতপূর্ব ক্ষমতার উৎস কী?
বিশ্লেষকদের মতে, যদি পরিস্থিতি এমনই চলতে থাকে, তাহলে পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়বে। ভবিষ্যতে বড় আকারের বিক্ষোভ, সংঘর্ষ বা অস্থিরতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশ্লেষকরা এখন এও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরেই সেনাবাহিনীর প্রভাব খুব শক্তিশালী। যে নেতা সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান, তাঁকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হয়। ইমরান খানও সেই পথেই হাঁটছেন। আবার কিছু সমালোচক বলছেন, ইমরান খানকে জেলে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে। তাঁকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার বড় পরিকল্পনার অংশ এটি যাতে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব কমে যায়।
পাকিস্তানে ইমরান খানকে ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এখন আর ব্যক্তিগত কোনও ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি দেশটির রাজনীতিতে বড় ধরনের মোড় আনতে পারে। ইমরান খানকে যদি সাধারণ মানুষ অন্যায়ভাবে নিপীড়নের শিকার হতে দেখেন, তাহলে পিটিআই বা তাঁর প্রতি জনসমর্থন আবার জোরদার হতে পারে। অন্যদিকে সরকার এবং সেনা নেতৃত্ব যদি কঠোর আচরণ চালিয়ে যায়, তাহলে দেশজুড়ে অসন্তোষ, সামাজিক অস্থিরতা এবং নতুন রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির দিকে যাঁরা নজর রাখেন, তাঁরা বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখছেন না। রাষ্ট্র, সরকার, সেনা ও আদালতের সমন্বয়ে কীভাবে জনপ্রিয় নেতা, বিরোধী শক্তি, আন্দোলন, বিচারব্যবস্থা এবং মানবাধিকার রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হয়, তার উদাহরণ পাকিস্তানে বহুবার দেখা গিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি তাই শুধু তাৎক্ষণিক উত্তেজনার মধ্যেই আটকে নেই। পাকিস্তানে রাজনৈতিক দমন, ক্ষমতার লড়াই, গণআন্দোলনের সম্ভাবনা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সামনে দীর্ঘমেয়াদী নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মহল মনে করছে।

Whatsapp
