মাইক্রোপ্লাস্টিক: আকারে ক্ষুদ্র হলেও এর প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী?
Microplastics: এমনকি, আমরা যে জামা কাপড় পরি, তাদের মধ্যে পলিয়েস্টার, নাইলন, অর্থাৎ কোনো সিনথেটিক ফাইবার থাকলেই সেখান থেকে আমাদের শরীরে মিশতে পারে মাইক্রোপ্লাস্টিক।
এই যে আমাদের খাওয়ার টেবিলে এক গ্লাস জল রাখা আছে, এই যে আমরা বাতাস থেকে প্রতিনিয়ত শ্বাস নিচ্ছি, সেখানে মিশে আছে মাইক্রোপ্লাস্টিক: ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের কণা। এগুলি প্রায়শই অদৃশ্য থাকে; খালি চোখে দেখা যায় না। আকারে ২ মাইক্রোমিটার থেকে ৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। মূলত সিন্থেটিক পলিমার কণা, যা কঠিন, জলে অদ্রবণীয় এবং সহজে নষ্ট হয় না। প্রশ্ন হলো, আকারে ক্ষুদ্র হলেও এর প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী?
ক্ষুদ্র আকারের জন্য সহজেই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গুলি পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের (মাটি, জল, বাতাস) সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান। নদীর স্রোত, বৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে এরা পুকুর, নদী এবং শেষমেষ সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। মাছেরা এদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে; এককথায় সহজেই মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করছে, এবং একসময় এই মাইক্রোপ্লাস্টিকই আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে, যা শুধু আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকারকই নয় বরং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যের মধ্যেও এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ।
সস্তায় টেকসই, বেশি দিন চলে বলে আমরা দৈনন্দিন কাজে প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করি। আমাদের ব্যবহুত শিল্পজাত বিভিন্ন সামগ্রী, বডি ওয়াশ, ফেস ওয়াশের চকচকে দানাদার পদার্থ, টুথপেস্ট, সিন্থেটিক পোশাক এসবই মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রাথমিক উৎস। এছাড়াও বিভিন্ন ঠান্ডা পানীয়, জলের বোতলেও মিশে আছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। আমরা চা খাওয়ার জন্য টি-ব্যাগ ব্যবহার করি, সেখান থেকেও শরীরে মিশতে পারে এই বিষাক্ত পদার্থ। কী ভাবছেন, প্রাকৃতিক ফাইবারের তৈরি টি-ব্যাগে কী করে মিশছে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক? ফাইবারটা প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি হলেও তার মুখ আটকাতে গিয়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি, আমরা যে জামা কাপড় পরি, তাদের মধ্যে পলিয়েস্টার, নাইলন, অর্থাৎ কোনো সিনথেটিক ফাইবার থাকলেই সেখান থেকে আমাদের শরীরে মিশতে পারে মাইক্রোপ্লাস্টিক।
আরও পড়ুন
হাড়ের ব্যথা থেকে ডায়াবেটিস, নিমেষে সারাবে, আজই খাদ্যতালিকায় যোগ করুন সস্তার এই শস্য
বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো আছে ন্যানোপ্লাস্টিকের তাণ্ডব, যেগুলো আরও ছোট কণা, এবং তাই সনাক্ত করা তুলনামূলকভাবে কঠিন; যারা আদতে সেকেন্ডারি মাইক্রোপ্লাস্টিক। আল্পসের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গাড়ির টায়ার ক্ষয় হতে হতে নির্গত হওয়া ন্যানোপ্লাস্টিক কণা সেখানকার পাহাড়গুলিকে দূষিত করছে। কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটন্ত জলে ১১.৬ বিলিয়ন ন্যানোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। এককথায়, আমাদের চারপাশের পরিবেশে এদের অবাধ বিচরণ, আর তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রাণিজগতের উপর, ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ক্যানসার, হরমোনের তারতম্য, প্রজনন প্রক্রিয়ায় বাধা ছাড়াও মারাত্মক সব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক।
২০২৫ সালে ইঁদুরের উপর করা এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তাদের মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে চলাচল করছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা এবং সেগুলি ইঁদুরের মাথার রক্তনালীগুলিকে ব্লক করে দিচ্ছে। একই ঘটনা লক্ষ্য করা গিয়েছে মানব মস্তিষ্কের অন্দরেও; এ বছর ৩১ মার্চ, নেচার মেডিসিনের এক যুগান্তকারী গবেষণায় প্রথমবারের মতো মানুষের মস্তিষ্কের টিস্যুতে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গিয়েছে। আবার, ইউনিভার্সিটি অফ নিউ মেক্সিকোর গবেষকরা দাবি করেছেন, বিগত এক দশকে মানুষের মস্তিষ্কে মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিমাণ প্রায় ৫০% বেড়েছে। ফলে, আমাদের স্নায়ু কোষের ক্ষতি হচ্ছে এবং ডিমনেশিয়া, অ্যালঝাইমার্সের মতো স্নায়বিক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। এই কণা রক্তে মিশলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ইত্যাদির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। ফলে, আমাদের স্নায়ু কোষের ক্ষতি হচ্ছে এবং ডিমনেশিয়া, অ্যালঝাইমার্সের মতো স্নায়বিক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। এই কণা রক্তে মিশলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ইত্যাদির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
আরও পড়ুন
আমেরিকা বনাম চিন! চাঁদ জয়ের যুদ্ধে কে এগিয়ে?
আসলে বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর যুগে আমাদের হাতে সময় বড় কম, ঝট করে ফুটিয়ে নিলে হয়ে যাবে, বা মশলা মিশিয়ে একটু গরম করে নিলে ঝামেলা শেষ, এই ফর্মুলাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি আমরা। সেজন্য বিশ্বব্যাপী অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এতে মিশে আছে অত্যাধুনিক প্যাকেজিং প্রযুক্তি; যার অধিকাংশই প্লাস্টিক নির্ভর। পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, এইসব প্যাকেটজাত পণ্য যারা বেশি ব্যবহার করেন তারা অন্যদের তুলনায় ৪৮% বেশি মানসিক উদ্বেগের সমস্যায় ভুগছেন; তাঁরা অন্যদের তুলনায় শতকরা ২২% বেশি বিষণ্ণতার শিকার।
এখন বড় কথা হলো, এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় আছে? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুরোপুরি নির্মূল করার উপায় না থাকলেও, সচেতন থাকলে কিছুটা কমতে পারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রকোপ। সবার আগে দরকার পরিশ্রুত পানীয় জল গ্রহণ করা, সেজন্য ‘রিভার্স অসমোসিস’ প্রযুক্তি নির্ভর অত্যাধুনিক ফিল্টার ব্যবহার করা উচিত, কারণ খাওয়ার জলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কাজের চাপের জন্য খাওয়া ভুলছি আমরা, তারপর ও অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার গরম করে না খেয়ে রান্না করা খাবার খাওয়া উচিত, এবং সেই রান্না করা খাবার প্লাস্টিকের পাত্রে না রেখে কাঁচ বা ধাতব পাত্রে রাখা ভালো। পরনের পোশাক সুতির, উলের বা লিলেনের পরা ভালো, তা সে পলিয়েস্টারের তৈরি জিনিস যতই চকচকে দেখাক না কেন। আমরা যে সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট ব্যবহার করি, কেনার আগে দেখা দরকার পলিথিন বা পলিপ্রপিলিন জাতীয় উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে কিনা। এত আলোচনা, পর্যালোচনা কোনোটাই কাজের হবে না, যদি আমরা প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ না করি।

Whatsapp
