মুসলিম বিশ্বের চাপে বেকায়দায় ভারত, সামাল দিতে কী অস্ত্র মোদি-শাহর?
নুপুর শর্মা-কাণ্ডের জেরে তৈরি হওয়া সংকট থেকে বিজেপিকে উদ্ধার করতে সম্ভবত ত্রাতা হয়ে উঠতে চলেছেন 'বাতিল' হওয়া সেই মুখতার আব্বাস নকভিই।
নুপুর শর্মার কীর্তির জেরে কী ভাগ্য ফিরতে চলেছে মুখতার আব্বাস নকভি-র?
বিদেশি চাপের ঠেলায় ইতিমধ্যেই বিজেপি-বিড়াল হাতে-মুখে কালি মেখে গাছে চড়ে বসেছে। এমন দৃশ্য কিন্তু গত ৮ বছরে দেশবাসীর নজরে আসেনি। দেশের অভ্যন্তরে যে কোনও ইস্যুতে যুক্তিসংগত প্রতিবাদ বা বিরোধিতাকে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিতেই অভ্যস্ত নরেন্দ্র মোদির সরকার এবং দল। গত ৮ বছর যাবৎ এমনই চলছে। কিন্তু এবার অন্য ছবি সামনে এসেছে। বিজেপির 'সম্পদ' নুপুর শর্মা দল এবং সরকারকে কার্যত মাঝসমুদ্রে ঠেলে ফেলে দিয়েছেন। তবে এমন পরিস্থিতিতেও কিন্তু ভন্ডামি-মুক্ত হতে পারেনি দল। এই প্রথমবার রীতিমতো বিবৃতি জারি করে মোদি-শাহর দল যা বোঝাতে চেয়েছে, তার মোদ্দাকথা, বিজেপি মুসলিমদের বিরুদ্ধে নয়, আগেও ছিল না, এখনও নেই। ঘরে-বাইরে প্রবল চাপের মুখে গেরুয়া-শীর্ষ মহল যখন এসব কথা বলে অকালে 'কনফেশন ডে' পালন করতে নেমেছে, ঠিক তখনই লোকসভা এবং রাজ্যসভার দিকে তাকালে নজরে আসবে, বিজেপির একজনও মুসলিম সদস্য সংসদের কোনও কক্ষেই নেই। কিছুদিন আগে শেষ হওয়া সংসদের বাজেট অধিবেশনে বিজেপির তরফে তিন জন মুসলিম সাংসদ ছিলেন। এঁরা হলেন, এম. জে. আকবর, সৈয়দ জাফর ইসলাম এবং অবশ্যই কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি।
মোদি-শাহ-নাড্ডা 'দলের স্বার্থের' কথা মাথায় রেখে এই তিন জনের কাউকেই রাজ্যসভায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না। এই তিন মুখের বদলে অন্য কোনও মুসলিম মুখের কথাও বিবেচনায় আনেননি তাঁরা। ফলে সংসদে বিজেপি এখন 'মুসলিম-মুক্ত' একটি দল। আর গোটা এনডিএ-তে এই মুহূর্তে মুসলিম সাংসদের সংখ্যা মাত্র একজন। বিহারের খাগাড়িয়া কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত এনডিএ-র শরিক লোক জনশক্তি পার্টির মেহবুব আলি কাইজার কেন্দ্রের শাসক জোটের একমাত্র মুসলিম সাংসদ। বিজেপি-র দুই মুসলিম সাংসদ এম. জে. আকবর এবং সৈয়দ জাফর ইসলামের নাম ঘিরে তেমন জল্পনা না হলেও চর্চার শিরোনামে ছিলেন নকভি। প্রথমদিকের জল্পনা ছিল, আগামী ১০ জুন রাজ্যসভার যে ৫৭ আসনে নির্বাচন হতে চলেছে, তার একটিতে নিশ্চিতভাবেই প্রার্থী হবেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নকভি। সেই তালিকায় নকভি-র নামের হদিশ মেলেনি। পরবর্তী জল্পনা ছিল, সমাজবাদী নেতা আজম খান ইস্তফা দেওয়ায় উত্তরপ্রদেশের রামপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী করতে পারে নকভিকে। সেখানেও নকভি নেই। ওদিকে ৭ জুলাই শেষ হচ্ছে নকভি-র রাজ্যসভার মেয়াদ। সংসদীয় বিধি বলছে, কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর রাজ্যসভার সদস্য থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পরবর্তী ৬ মাস তিনি মন্ত্রী থাকতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আগামী ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত আইনি পথেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য থাকতে পারবেন নকভি। তবে এই ৬ মাসের মধ্যে লোকসভা বা রাজ্যসভায় তাঁকে জিতে আসতে হবে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের বক্তব্য, হাতে ৬ মাস সময় রয়েছে। এর মধ্যে কোনও আসন খালি হলে অথবা কোনও আসন খালি করিয়ে প্রয়োজন হলে সেখান থেকে নকভি-কে জিতিয়ে আনা যেতেই পারে। এখনই এই বিষয়ে আলোচনা অর্থহীন। এর উল্টো বক্তব্যও রয়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব যদি নকভি-কে এতখানি 'প্রয়োজনীয়' ভাবতেন, তাহলে তাঁকে রাজ্যসভাতেই ফের নিয়ে যেত বিজেপি। তেমন তো করেনি! তাহলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে যদি কোনও নির্বাচন হয়, সেখানেই নকভি দাঁড়াবেন, এমন ভাবনার ভিত্তি কী?
আরও পড়ুন: বিপজ্জনক সময়ের দিকে পা বাড়াচ্ছে ভারতীয় গণতন্ত্র
ফলে এখনই বলে দেওয়া যায়, বিজেপি'র শেষ মুসলিম মুখ মুখতার আব্বাস নকভির সংসদীয় জীবনের ইতি টানা হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক জীবন চালু থাকতে অবশ্য কোনও বাধা থাকছে না। তবে মোদির মন্ত্রিসভায় আগামিদিনে থাকবে না কোনও মুসলিম-মুখ।
দেশজুড়েই যখন নকভি-র ভাগ্যের ময়নাতদন্ত চলছে, ঠিক তখনই ধুমকেতুর মতো সামনে এলেন নুপুর শর্মা এবং নবীন জিন্দল৷ 'সেলিব্রিটি' নেত্রী নুপুর বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র, জিন্দল দলের মিডিয়া সেলের নেতা৷ হজরত মহম্মদের বিয়ে সম্পর্কে কিছু কথা বলে সংখ্যালঘু ভাবাবেগে বড় আঘাত হানার জেরে নুপুর শর্মা-কে সাসপেন্ড করেছে বিজেপি। একইভাবে হজরত মহম্মদ সম্পর্কে বিতর্কিত এক ট্যুইট করায় নবীন জিন্দালও সাসপেন্ডেড। এই দু'জনের প্রাথমিক সদস্যপদও কেড়ে নিয়েছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
কেন্দ্র এবং বিজেপি ভেবেছিল, এই টোটকা প্রয়োগেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে আসা সম্ভব হবে। তা হয়নি। ক্রমশই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা মুসলিম দুনিয়ায়। সৌদি আরব, কাতার, ইরান, কুয়েতের ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ওইসব দেশের সরকার নির্দেশ দিয়েছে ভারত সরকার যেন নিঃশর্তে ক্ষমা চায়। বিজেপি নেত্রীর বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে কুয়েতের প্রায় সব ক'টি সুপারমার্কেট থেকে সরানো হয়েছে ভারতীয় পণ্য। সুপারমার্কেটে থাকা ভারতীয় প্যাকেটবন্দি চা, চাল, লঙ্কার গুঁড়ো, মশলাপাতি প্লাস্টিকে মুড়ে ফেলা হয়েছে। আরবি ভাষায় তার গায়ে লিখে দেওয়া হয়েছে, ‘আমরা ভারতীয় পণ্য সরিয়ে ফেলেছি।’ ওইসব দেশে ভারতীয় পণ্য বয়কটের কথাও ভাবা হচ্ছে। পরিস্থিতি ক্রমশই ভারতের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ওদিকে, চলতি বছরের শেষ দিকে গুজরাত এবং হিমাচলে বিধানসভা নির্বাচনের সম্ভাবনা। নুপুর শর্মার মন্তব্য এবং সেই মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া সমগ্র মুসলিম বিশ্ব দেখাচ্ছে, তার প্রভাব গুজরাটের ভোটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা পদ্ম শিবিরের। পাশাপাশি, আরও বড় এক দুশ্চিন্তা কাজ করছে গেরুয়া অন্দরে। কিছুদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এই ভোটকে সামনে রেখে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের সলতে পাকানোর ছক কষেছিল বিজেপি। পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের কোনও মহিলাকে রাষ্ট্রপতি করার ভাবনা রয়েছে গেরুয়া শিবিরের।
কিন্তু সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছেন ওই নুপুর শর্মা। সব কাজ ছেড়ে মোদি-শাহ এখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হয়েছেন। দেশের এবং বিদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে বিশেষ এক বার্তা দিতে না পারলে এবার সত্যি সত্যিই ঝোলা কাঁধে নিয়ে দিল্লি ছাড়তে হবে বিজেপিকে। রাজনৈতিক মহলের ধারনা, সংখ্যালঘুর মন পেতে তাই আলোচনায় উঠে এসেছে বাতিলের খাতায় চলে যাওয়া মুখতার আব্বাস নকভি-র নাম।
বিজেপির অন্দরের খবর, দলের একাংশের দাবি, পরিস্থিতি সামাল দিতে রাষ্ট্রপতি পদে আনা হোক সংখ্যালঘু মুখ। প্রার্থী করা হোক নকভি-কে। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা মুসলিম-বিশ্বের কাছে ভারত বার্তা পাঠাক, 'আমরা মুসলিম-বিরোধী নই'৷ আর কোনও কারণে তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে বিকল্প হিসেবে ২০২৩ সালে উপ-রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বেঙ্কাইয়া নাইডু-র অবসরের পরই ওই সাংবিধানিক পদে সংখ্যলঘু মুখ হিসেবে মুখতার আব্বাস নকভির নাম এখনই প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দেওয়া হোক। এমন কিছু করা না গেলে ধনে-প্রাণে মারা যাবে বিজেপি। জানা যাচ্ছে, হাতের বাইরে চলে যাওয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে রাষ্ট্রপতি বা উপ-রাষ্ট্রপতি পদে মুখতার আব্বাস নকভির নাম প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছেন মোদি-শাহ। মোদির শাসনকালে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার এবং বঞ্চনার যে অভিযোগ বারবার উঠছে, তার অনেকটা মোকাবিলা যেমন নকভি-অস্ত্রে করা যাবে, তেমনই বিশ্বের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিতেও সফল হবে ভারত। এছাড়া বাঁচার আর পথ নেই বলেই মনে করছে বিজেপির শীর্ষ স্তর।
নুপুর শর্মা-কাণ্ডের জেরে তৈরি হওয়া সংকট থেকে বিজেপিকে উদ্ধার করতে সম্ভবত ত্রাতা হয়ে উঠতে চলেছেন 'বাতিল' হওয়া সেই মুখতার আব্বাস নকভিই।