'আত্মা' এখনও আসে ফিরে? পর্যটকদের কেন টানে ভৌতিক রহস্যে মোড়া সিকিমের বাবা মন্দির!
Baba Mandir Sikkim: সেনাবাহিনীর অনেকেই নাকি এখনও হরভজনের বিছানার চাদরে ভাঁজ দেখতে পান। তাঁদের বিশ্বাস, হরভজন এখনও আছেন।
হাড় কাঁপানো হাওয়া, বরফের মধ্যে কনকনে জমে যাওয়া শরীর নিয়ে তবু একটিবার মন্দিরে প্রবেশ করছেন পর্যটকরা। পাহাড়প্রেমী মানুষের বরাবরের ভালোবাসার জায়গা সিকিম। সিকিম ঘুরতে গিয়ে বাবা মন্দিরে যান না এমন পর্যটক নেই। মজার বিষয় হলো, নামে বাবা হলেও ভারতীয় ধার্মিক গুরুদের সঙ্গে এই মন্দিরের 'ঈশ্বরের' কোনও সম্পর্কই নেই। এক সেনার নামে এই মন্দির। যাকে ঘিরে বরফে ঢাকা এই পর্যটন কেন্দ্রে আজও রহস্যময় হাওয়া উড়ে আসে। ষাটের দশকের একজন ভারতীয় সেনার কথা আজও মনে করিয়ে দেয় এই মন্দির। বাবা হরভজন সিংয়ের গল্প আজও রহস্য আর অতিপ্রাকৃতের মোড়কে যত্নে মোড়া। মৃত্যুর পরেও নাকি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে চলেছেন বাবা হরভজন। সৈনিক হরভজন সিংয়ের নামে দু'টি মন্দির রয়েছে। একটি ওল্ড সিল্ক রুটে পুরনো বাবা মন্দির নামে জনপ্রিয় এবং অন্যটি, নাথুলা পাস থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে একটি জায়গায় নতুন বাবা মন্দির নামে পরিচিত। পুরনো মন্দিরটিতে সাধারণ পর্যটকদের যাওয়া কিছুটা কঠিন। তবে গ্যাংটক থেকে সহজেই সোমগো লেক/নাথুলা পাস এবং নতুন বাবা মন্দির ঘুরে আসা যায়।
হরভজন সিং ১৯৪৬ সালের ৩০ অগাস্ট পাকিস্তানের একটি গ্রামে এক শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার পঞ্জাবে চলে আসে। পঞ্জাবের ডিএভি পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করতে ভর্তি হন হরভজন। ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন হরভজন। ১৯৬৬ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি পঞ্জাব রেজিমেন্টে সিপাহি হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। উল্লেখ্য, ভারত তখন চরম কঠিন পরিস্থিতির মুখে! চিন-ভারত যুদ্ধের পর সীমান্ত ভীষণ চাপের মধ্যে পড়ে রয়েছে। সেই উত্তাল সময়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন হরভজন। ১৯৬৮ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে, হরভজন সিং নাথু লাতে যুদ্ধের সময় প্রাণ হারান। কেউ কেউ আবার বলেন, সেই বছরটি সিকিমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভয়াবহ। সীমান্তের কাছেই হরভজনের পোস্টিং। এক বর্ষায় পিছলে গিয়ে প্রবল জলের তোড়ে ভেসে যান তিনি। তবে, মৃত্যুর পর তাঁর দেহ ৩ দিন পর্যন্ত উদ্ধারই করা যায়নি।
আরও পড়ুন- ভারতের এই মন্দিরে পূজিত হয় মোটরবাইক! ‘বুলেট বাবা’-র নেপথ্যে রয়েছে গা ছমছমে যে ঘটনা
সেনাবাহিনী হরভজনের মৃতদেহ খুঁজে না পেলে ঊর্ধ্বতনরা ধরেই নিয়েছিলেন যুদ্ধের মাঝপথেই রণে ভঙ্গ দিয়েছেন হরভজন। সেনাবাহিনী ছেড়ে ভয়ে পালিয়েছেন তিনি। শোনা যায়, এক রাতে হরভজনকে স্বপ্নে দেখেন তাঁর এক বন্ধু। স্বপ্নে নাকি হরভজন তাঁর বন্ধুকে জানান তাঁর মৃতদেহ কোথায় পড়ে আছে। স্বপ্নের বলা ওই জায়গা থেকেই নাকি তাঁকে উদ্ধার করা হয়। হরভজনকে দাহ করা হয় এবং পূর্ণ সামরিক সম্মান পান তিনি।
তবে এত কিছুর পরেও নাকি হরভজনের 'আত্মা'কে হামেশাই স্বপ্নে দেখতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর যোদ্ধারা। সেনাবাহিনীর সদস্যদের নাকি স্বপ্নে শত্রুপক্ষের কৌশল জানিয়ে দিতেন হরভজন। নাইট ডিউটিতে থাকা সৈনিক ঢুলতে থাকলে নাকি হরভজনের আত্মাই তাকে চড় মেরে জাগিয়ে দেন! তার মৃত্যুর পরেও সেনাবাহিনীর প্রতি তাঁর এই অবদানের কারণে হরভজন মাসিক যা বেতন পেতেন তা তাঁর মায়ের কাছে পাঠানো হতো। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর বার্ষিক ছুটিও পেতেন হরভজন। ছুটির জন্য হরভজনের ব্যাগপত্র গোছানো হতো। তিনজন সেনা সদস্য প্রতি বছর হরভজনের বাড়িতে তাঁর ব্যাগপত্র নামিয়েও আসতেন ছুটিতে।
হরভজনের জন্য ট্রেনে আসন বুক করা হতো। সাধারণত, ফাঁকা আসনগুলি অপেক্ষার তালিকায় থাকা যাত্রীদের দেওয়া হয়, তবে হরভজনের জন্য এক বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মৃত্যুর পরও হরভজন প্রমোশন পেতে থাকেন। একজন সেপাই হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু অবসর নেন একজন অধিনায়ক হিসেবে।
আরও পড়ুন- শ্মশান থেকে মৃতদেহ তুলে আনা হতো পুজোয়, চমকে দেয় উত্তর কলকাতার কালী মন্দিরের ইতিহাস
যত সময় এগিয়েছে, হরভজন একজন সেনা থেকে 'বাবা' হয়ে উঠেছেন। নাথু লা'র নায়ক বলা হয় তাঁকে। তাঁর নামেই বাবা মন্দির তৈরি হয়েছে বরফের মাঝে। সেখানে একটি বসার ঘর, একটি স্টোর রুম এবং একটি অফিস রয়েছে। সেনাবাহিনীর অনেকেই নাকি এখনও হরভজনের বিছানার চাদরে ভাঁজ দেখতে পান। তাঁদের বিশ্বাস, হরভজন এখনও আছেন, এখনও তাঁর উপস্থিতি টের পান সেনারা।
মানুষ এখনও এই মৃত সৈনিকের অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন। পুরনো বাবা মন্দিরটি তৈরি হয়েছে হরভজনের পোস্টিংয়ের জায়গায় একটি বাঙ্কারে এবং নতুন মন্দিরটি তৈরি হয়েছে নাথুলা পাসের কাছে। বাঙ্কারটি ১৩১২৩ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। ৫০ টি সিঁড়ি বেয়ে বাঙ্কারে পৌঁছতে হয়। চাঙ্গু হ্রদের কাছাকাছি অবস্থিত নতুন বাবা মন্দিরটিতে সবসময়ই পর্যটকদের ভিড়। মন্দিরে তিনটি ঘর রয়েছে, কেন্দ্রের ঘরটিতে শিখ গুরু এবং বাবা হরভজনের বড় প্রতিকৃতি রয়েছে। বাবার সমস্ত মৌলিক চাহিদার বস্তু, পোশাক, জুতো, সমস্ত তাঁর ব্যক্তিগত ঘরে রাখা।