বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকের কাছে গোমাংস ছিলই না, শুধু সন্দেহের বশেই প্রবাসে হত্যা?
Bengal labour lynched in Haryana: সম্প্রতি জানা গিয়েছে, সাবিরের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া সেই মাংস মোটেই গোমাংস ছিল না। অন্তত ল্যাবের রিপোর্ট তো তেমনটাই বলছে।
২০১৫ সালে গোমাংস রাখার অভিযোগে উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে ৫২ বছরের আখলাখ মহম্মদকে পিটিয়ে মেরেছিল তথাকথিত গোরক্ষক বাহিনী। নারকীয় ভাবে মারধর করা হয়েছিল তাঁর বাইশ বছরের পুত্র দানিশকেও। তারপর ২০২৪ সাল। রাজধানী দিল্লি থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে হরিয়ানার চরখি দাদরির বাধরা এলাকায় গণপ্রহারে মৃত্যু হল বাংলার এক যুবকের। নিহত সাবির মালিক পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসিন্দা, পেশায় পরিচ্ছন্নতা কর্মী। চরখি দাদরির একটি বস্তিতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তিনি। গোমাংস রান্না করার অভিযোগে তাকে বেধড়ক মারধর করে স্বঘোষিত গোরক্ষক বাহিনী। আদৌ সে মাংস গোমাংস ছিল কিনা প্রমাণ হওয়ার আগেই শাস্তির নিদান হয়ে গিয়েছিল। শাস্তি একটাই মৃত্যু। যেমন শাস্তি পেয়েছিলেন আখলাখ, পেলেন সাবিরও। তবে সম্প্রতি জানা গিয়েছে, সাবিরের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া সেই মাংস মোটেই গোমাংস ছিল না। অন্তত ল্যাবের রিপোর্ট তো তেমনটাই বলছে।
প্রতি বছরই বাংলা থেকে অজস্র যুবক ভিনরাজ্যে যান কাজের আশায়, আরেকটু ভালো রোজগারের আশায়। গিয়েছিলেন বছর বাইশের সাবিরও। ঘটনা ২৭ অগস্টের। তার পাতে একটুকরো মাংস দেখতে পেয়েছিল গোরক্ষক বাহিনী। ব্যাস। কাল হল সেটাই। গ্রামের মধ্যে গরুর মাংস রান্না করা হচ্ছে, পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিল কয়েকজন যুবক। পুলিশ এসে সেই মাংস বাজেয়াপ্তও করে। তবে তাতে শান্তি পাননি স্বঘোষিত গোরক্ষকেরা।
আরও পড়ুন: গোমাংস খাওয়ার অভিযোগ! বাংলার পরিযায়ী শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা! কী করছিল পুলিশ?
বান্ধরা গ্রামের কাছে একটি ঝুপড়িতে থাকতেন সাবির। জীবিকার জন্য বর্জ্য এবং খালি বোতল সংগ্রহ করতেন। সেই বোতল দেওয়ার নাম করেই সাবিরকে একটি দোকানে ডেকে নিয়ে গিয়ে শুরু হয় মার। না, তাতেও মন ভরেনি। সেখানে মারধর পর্ব সেরে বাইকে করে তুলে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে ফের মারধর করা হয় সাবিরকে। শেষমেশ তাঁর অচেতন দেহখানা ফেলে যাওয়া হল তাঁর বস্তির সামনে। গোমাংস খাওয়ার অভিযোগে প্রাণ কেড়ে নেওয়া হল বছর বাইশের এক পরিযায়ী শ্রমিকের। সেই মাংস আদৌ গোমাংস কিনা, তা প্রমাণিত হওয়ার আগেই নির্মম ভাবে হত্যা করা হল সাবিরকে। সেই হত্যায় অভিযুক্ত পাঁচ জনের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস)- অনুযায়ী রুজু হল একটি মামলা। দুই নাবালক-সহ ৫ জনকে গ্রেফতারও করা হল।
সাবিরের ঝুপড়ি থেকে পাওয়া মাংসের নমুনা পুলিশ সংগ্রহ করে। তার পর সেই নমুনা পাঠানো হয় ফরিদাবাদের একটি ল্যাবে। সম্প্রতি সেই ল্যাবের রিপোর্ট সামনে এসেছে। যেখানে দেখা গিয়েছে, ওই মাংস আর যা-ই হোক, গোমাংস ছিল না কোনও ভাবেই। না, গোরক্ষকদের তাণ্ডব আখলাখের মৃত্যুতেও থামেনি, থামল না সাবিরের মৃত্যুতেও। হরিয়ানার ফরিদাবাদে আরিয়ান মিশ্র নামে এক দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াকে গুলি করে খুন করে গোরক্ষক বাহিনী। এসইউভি-তে করে গরু পাচার করছে সে ও তার বন্ধুরা, সেই সন্দেহেই হত্যা। আরিয়ান ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান জানতে পেরে অবশ্য পরে হাত কামড়েছিল বজরং দলের সদস্য সেই গোরক্ষকবাহিনীর প্রধান কৌশিক নামক ব্যক্তি। মহারাষ্ট্রের নাসিকে গোমাংস নিয়ে ট্রেনে ওঠার অভিযোগে এক ৭৫ বছরের বৃদ্ধকে মারধর করা হয়। সেই বৃদ্ধও বারবার জানিয়েছিলেন, সেটি ছাগলের মাংস। তবে তাঁর সেই দাবি না শুনে চলে বেধড়ক মারধর। সেই ভিডিও-ও ভাইরাল হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আরও পড়ুন: ‘ভুল করে’ ব্রাহ্মণ কিশোরকেই খুন! হাত কামড়াচ্ছে হরিয়ানার গোরক্ষক দল
স্বঘোষিত গোরক্ষকরা ধারাবাহিক ভাবে এই যে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে দেশ জুড়ে, তা কেন্দ্রের অজানা নয়। তবু এই ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা বন্ধ করতে কোনও ব্যবস্থার পথে হাঁটে না সরকার। সাবির হত্যার পরে বিজেপি শাসিত হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীকে কার্যত পাশে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছিল গোরক্ষকদেরই। নির্বিকারে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘গো-পূজক গ্রামবাসীদের এই কাজ থেকে কে-ই বা নিবৃত্ত করতে পারে?’’ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি অবশ্য গোরক্ষকদের হাতে একের পর এক নিরীহ মানুষের হত্যার ঘটনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছিলেন এটা 'মোদির নৃশংস নতুন ভারত'। ২০১৭ সালে গুজরাটে একটি অনুষ্ঠানে এসে মোদিকে বলতে শোনা গিয়েছিল— গরুর নামে মানুষ হত্যা গ্রহণযোগ্য নয় একেবারেই। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার নেই কারওরই। কিন্তু মোদির সেই বাণী মনে রাখেনি তাঁর দল বা সমর্থকেরা নিজেই। সাবির, আরিয়ানদের ঘটনাই তার প্রমাণ। মনে কি রেখেছেন খোদ মোদিও? প্রশ্ন জাগে বৈকি।