কমিয়ে দেখানো হয়েছে সংখ্যা? সরকারি নথিতেই উঠে আসছে কোভিডে মৃত্যুর গরমিল তত্ত্ব
Covid 19 Death Toll: প্রকাশিত তথ্য থেকে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে ভারতে কোভিড-১৯ এর কারণে মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লক্ষের কাছাকাছি, কোনওভাবেই তা ৫ লক্ষ নয়।
ভারতে জন্ম ও মৃত্যুর সরকারি নথি থেকে পাওয়া নতুন এক তথ্য বলছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে প্রায় ২১ লক্ষ বেশি মৃত্যুর তথ্য নিবন্ধিত হয়েছে। ২০২১ সাল ছিল কোভিড-১৯-এর মারাত্মক রূপ ডেল্টার বছর। তবে আশঙ্কা লুকিয়ে অন্য জায়গায়। ২০২১ সালের সরকারি হিসেবে দেখানো হয়েছিল যে, কোভিড-১৯-এর কারণে মৃত্যু হয়েছে ৩.৩২ লক্ষ মানুষের। আর নতুন তথ্য বলছে, সেই সংখ্যার প্রায় ছয় গুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে ওই সময়কালে। বুধবার প্রকাশিত হয়েছে সিভিল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের নতুন তথ্য। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে, মহামারী চলাকালীন মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে।
গত ৯ মে অবধি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের হিসেবে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সরকারিভাবে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫.৩৩ লক্ষ। গবেষকদের মূল্যায়ন বলছে, প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে অন্তত ৪-১২ গুণ বেশি। ২০২২ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ এবং ২০২১ সালে ভারতে 'অতিরিক্ত' মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৭ লক্ষ, যা ওই দুই বছরের ভারতীয় সরকারি পরিসংখ্যানের ৪.৮ লক্ষর চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদন বলছে, ভারতে প্রতি বছর জন্ম ও মৃত্যু গণনার নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে, তবে মহামারীকালীন সময়ের বেশিরভাগ তথ্যেই গরমিল হয়েছে। সিভিল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের তথ্য ছাড়াও, ভারতের আদমশুমারি ব্যবস্থাও স্যাম্পেল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসআরএস) থেকে তথ্য প্রকাশ করেছে। সরকার মৃত্যুর কারণ বিষয়ক মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসিসিডি) সম্পর্কিত ২০২১ সালের প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। একত্রে, এই তথ্যগুলি দেশে কোভিড-১৯ মৃত্যুর সংখ্যার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের একটা ছবি তুলে ধরছে। যদিও সেই ছবি এখনও সম্পূর্ণ নয়।
আরও পড়ুন-আসছে কোভিডের চেয়েও ভয়ঙ্কর মহামারী! যে ঝুঁকির কথা শোনালেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী
বছর আনুমানিক মৃত্যু নিবন্ধিত মৃত্যু নিবন্ধনের হার
২০০৭ ৮৩,৯১,৭৭৮ ৫৮,০৪,৯২২ ৬৯.১৭%
২০০৮ ৮৫,১১,৪৫০ ৫৬,৩৮,১৩১ ৬৬.২৪%
২০০৯ ৮৫,১৩,৪৬৪ ৫৬,৭৭,৭০৫ ৬৬.৬৯%
২০১০ ৮৫,১১,১৭৮ ৫৬,৯০,৫৪৯ ৬৬.৮৬%
২০১১ ৮৫,০৩,৩৭২ ৫৭,৩৫,০৮২ ৬৭.৪৪%
২০১২ ৮৪,৮৯,৭৮৯ ৫৮,৫০,১৭৬ ৬৮.৯১%
২০১৩ ৮৫,৮৯,০৮৪ ৬০,৮৬,৬১৬ ৭০.৮৬%
২০১৪ ৮২,৬৪,৭৩০ ৬১,৩৮,১৮২ ৭৪.২৭%
২০১৫ ৮১,৮৪,২০২ ৬২,৬৭,৬৮৫ ৭৬.৫৮%
২০১৬ ৮১,৫৩,৫১০ ৬৩,৪৯,২৫৯ ৭৭.৮৭%
২০১৭ ৮১,১৭,৬৮৯ ৬৪,৬৩,৭৭৯ ৭৯.৬৩%
২০১৮ ৮২,১২,৫৭৬ ৬৯,৫০,৬০৭ ৮৪.৬৩%
২০১৯ ৮৩,০১,৭৬৯ ৭৬,৪১,০৭৬ ৯২.০৪%
২০২০ অপ্রকাশিত ৮১,১৫,৮৮২ —
২০২১ অপ্রকাশিত ১,০২,২৪,৫০৬ —
সূত্র: সিআরএস এবং এসআরএস রিপোর্ট, সেন্সাস অফ ইন্ডিয়া
এই তথ্য থেকে এও বোঝা যাচ্ছে যে, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা এবং নিবন্ধিত মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য ক্রমশ কমছে।
‘অতিরিক্ত’ মৃত্যু
২০২১ সালের সিআরএস তথ্য বলছে, সেই বছর দেশে ১.০২ কোটিরও বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল, যা মহামারীর প্রথম বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ৮১.১৫ লক্ষ মৃত্যুর চেয়ে ২১ লক্ষ বেশি। এসআরএস-এর তথ্য দেখায়, ২০০৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ৮১ লক্ষ থেকে ৮৬ লক্ষের মধ্যে ছিল - বার্ষিক গড়ে ৮৩.৫ লক্ষ মৃত্যু। এই মৃত্যুর বেশিরভাগই সিআরএস-এ নিবন্ধিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নিবন্ধনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে - ২০১৩ সালে ৭০% থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে তা ৭৭% এবং ২০১৯ সালে তা ৯২% হয়েছে। ২০২০ এবং ২০২১ সালে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কিন্তু সেই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
২০২১ সালে নিবন্ধিত ১.০২ কোটিরও বেশি মৃত্যুর ঘটনাকে সেই বছরের প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যার কাছাকাছি হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তা বার্ষিক ৮৩.৫ লক্ষ মৃত্যুর 'স্বাভাবিক' সংখ্যার চেয়ে ১৮.৭৫ লক্ষ বেশি হবে। ২০২১ সালে মৃত্যুর এই উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির অন্য কোনও কারণ না থাকলে, এই 'অতিরিক্ত' মৃত্যুর পুরোটার জন্যই দায়ী হবে কোভিড-১৯ মহামারী।
আরও পড়ুন-করোনার পর নতুন মহামারীর আশঙ্কা বিশ্ব জুড়ে! কেন এত ভয়ঙ্কর ‘জম্বি ডিয়ার’ রোগ?
সিআরএস ২০২১-এর পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে ভারতের সরকারি হিসেবে কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর পরিসংখ্যান কমপক্ষে পাঁচ গুণ কম দেখানো হয়। মহামারীতে মৃত্যুর হিসেব কষলে দেখা যাবে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিন বছর ধরে এই মৃত্যু ঘটেছে। ২০২২ সালের সিআরএস তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালে কী ঘটেছিল দেখা যাক।
মহামারীর প্রথম বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে, সিআরএসে ৮১.১৫ লক্ষ মৃত্যু নিবন্ধিত হয়েছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে সেই বছর মৃত্যু নিবন্ধনের হার আগের বছরের মতোই ছিল অর্থাৎ ৯২%। তাহলে ২০২০ সালে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৮.২১ লক্ষ। এটি ৮৩.৫ লক্ষ 'স্বাভাবিক' মৃত্যুর চেয়ে প্রায় ৪.৭ লক্ষ বেশি। আনুষ্ঠানিকভাবে, ভারতে ২০২০ সালে ১.৪৮ লক্ষ কোভিড-১৯ মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে, যা সেই বছরের 'অতিরিক্ত' মৃত্যুর চেয়ে প্রায় তিনগুণ কম।
তবে এখানে উল্লেখ্য যে, অতিরিক্ত মৃত্যুর যে গণনা এখানে করা হয়েছে তা কিছুটা সরল। এখানে জন্ম মৃত্যুর নানা জটিল হিসেবের সূক্ষ্মতা নেই। আবার, এখানে কোভিড মহামারীর ফলে সৃষ্ট নানা ব্যাঘাত বা সমস্যার কারণে মৃত্যু - যেমন চিকিৎসা পরিষেবা পেতে অসুবিধা ইত্যাদি সমস্যার সম্ভাব্য বৃদ্ধির হিসাবও পাওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, এই জাতীয় মৃত্যুর কারণ কিন্তু সরাসরি করোনাভাইরাস নয়।
তবে একটি বিষয় প্রকাশিত তথ্য থেকে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে ভারতে কোভিড-১৯ এর কারণে মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লক্ষের কাছাকাছি, কোনওভাবেই তা ৫ লক্ষ নয়। অর্থাৎ, ভারত সরকার কোভিডে মৃত্যুর যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে গরমিল আছে, তা নয়া সরকারি নথিতেই স্পষ্ট।