কেউ কিনতে চাইছে না! ডলার কি অচিরেই তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে?
US Dollar Losing Its Global Dominance: বিশেষ করে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের পর থেকে সোনা জমানোতে মনোযোগী হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগী এই দেশটি। অন্যদিকে, ডলার আর তেমন কেউ কিনতে চাইছে না।
চিন নাকি সমস্ত সোনা কিনে নিচ্ছে! গত দু-বছর ধরে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশটি এই কাজ করছে। আগে যেখানে তারা সব সময় ডলার কিনে রাখত, তারা এখন জমা করছে সোনা; পৃথিবীর প্রাচীনতম মুদ্রা। শুধু চিন একা নয়, রাশিয়াও এই পথে পা বাড়িয়েছে; বিশেষ করে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের পর থেকে সোনা জমানোতে মনোযোগী হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগী এই দেশটি। অন্যদিকে, ডলার আর তেমন কেউ কিনতে চাইছে না, ফলে তার দাম ক্রমশ পড়ছে, আর তার মাশুল গুণছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ। কী করে?
পরিসংখ্যান বলছে, ট্রাম্পের দেশের ধার এই মুহূর্তে ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। প্রতি বছর তার জন্য সুদ গুনতে হচ্ছে ১.১৫ ট্রিলিয়ন ডলার। ব্যপারটা কেমন তা উদাহরণ দিলে বোঝা সহজ হবে— আমরা যাঁরা ক্রেডিট কার্ড ব্যাবহার করি, তাঁরা জানি মাস শেষে যে মোট বিলটা আসে (বোঝার সুবিধার্থে ১০,০০০ টাকা ধরলাম), তার একটা ক্ষুদ্র অংশকে (ধরা যাক ৮৪৫ টাকা) বলা হয় মিনিমাম অ্যামাউন্ট ডিউ, বা ম্যাড; এখন এই টাকা রিশোধ করতে পারলে আপনাকে ব্যাঙ্ক আর জ্বালাবেনা। কিন্তু বাকি টাকার উপর চড়া সুদ যুক্ত হয়ে পরের মাসের ক্রেডিট কার্ডের বিলে জমা হবে। সেবারও পুরো শোধ করতে না পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকবে ঋণের বোঝা; পরিস্থিতি একসময় এমন জায়গায় পৌঁছবে যে, নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন সেই পথে হাঁটছে।
কী ভাবছেন, আজগুবি কথা বলছি? যে দেশ বিশ্বের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, যারা অন্য দেশের সিংহাসন উল্টে দিতে পারে, যারা এশিয়া থেকে শুরু করে আফ্রিকা পর্যন্ত সব দেশকে শিক্ষা দেয় সভ্যতার, আধুনিকতার, যারা নিজেদেরকে দাবি করে গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে, তাঁদের অর্থনীতি নিম্নগামী? হ্যাঁ, পরিসংখ্যান সেই কথাই বলছে। যে কোনো মধ্যবিত্ত মার্কিন নাগরিকদের জীবনযাত্রা দেখলে তার আন্দাজ পাওয়া যায়। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি কিনতে পারছে না, ভাড়া বাড়িতে থাকতে হচ্ছে (তিন দশক আগে মধ্যবিত্তরা কিন্তু বাড়ি বানাতে পারতো), লোন ছাড়া উচ্চ শিক্ষা সেদেশে বিলাসিতা; আবার যাঁরা স্টুডেন্ট লোন নিচ্ছে, তাঁদের পরিশোধ করতে গিয়ে অর্ধেক জীবন কেটে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
মাথার দাম ৪০ হাজার ডলার, ক্রীতদাস দুনিয়ার ‘কালো’ ঈশ্বরী হ্যারিয়েটকে সেলাম
আচ্ছা, এই যে বিপুল পরিমাণ ঋণের কথা বলছি, সেটা কার কাছে? কিছু আছে বাইরের বিভিন্ন দেশ জাপান, ফ্রান্স, এদের কাছে, আর বাকিটা দেশের জনগণের কাছে। কিন্তু, অর্থনীতির তত্ত্বানুযায়ী এই বিরাট অর্থ তো রাতারাতি উবে যেতে পারে না , কোথাও না কোথাও তো খরচ করেছে দেশটি, কেউ না কেউ তো উপকৃত হয়েছে, তাঁরা কারা ? অক্সফ্যামের মতো বড় বড় সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে, এলন মাস্ক, জেফ বেজোসের মতো শিল্পপতিরা সেই পুঁজি ঘরে তুলছে, আর প্রতি মুহূর্তেই তার মাশুল গুণতে হচ্ছে, দেশের সাধারণ মানুষকে। মার্কিন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ও পূর্ণ সহযোগিতায় একদিন যে নাসার জন্ম হয়েছিল, অর্থাভাবে সেই স্বনামধন্য বিজ্ঞান সংস্থা এখন ধুঁকছে। ভাবা যায়!
এই পরিস্থিতি একদিনে হয়নি। নিজেদের ইচ্ছামতো তারা ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার ছাপিয়েছে দিনের পর দিন, যার স্বীয়ভাগ খরচ করেছে যুদ্ধ বিগ্রহ, অস্ত্রপাতি কেনায়— এককথায় সামরিক খাতে। সামরিক শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে, বিশ্বজুড়ে প্রচার করে গেছে তাদের ন্যারেটিভ, ‘আমরাই সেরা‘। আর আমরা, মানে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলো, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে ডলার কিনে কিনে জমিয়ে রেখেছি এতদিন, ফলে শক্ত হয়েছে তাদের অর্থনীতি। সেই পরিস্থিতি কোভিডের পর থেকে প্রতিনিয়ত বদলেছে। সৌদি আরব, চিন, ও পাকিস্থান সম্প্রতি নিজেদের মধ্যে বিশাল অঙ্কের লেনদেন করেছে ইউএস ডলারের বাইরে। জাপান, এবং রাশিয়াও অনেকদিন ধরেই এই ডলারাইজেশানের ফাঁদ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। এককথায়, ডি-ডলারাইজেশানের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে পুরো বিশ্ব জুড়েই, তার প্রভাব পড়েছে মার্কিন অর্থনীতিতে।
আমেরিকার একটা বিরাট অংশের মানুষের জীবন জীবিকা কৃষি নির্ভর। কৃষিজাত পণ্য রফতানি করে বিপুল মুনাফা ঘরে আসে ট্রাম্পদের। কিন্তু সে রাস্তা আগের মতো আর মসৃণ নেই; ২০২৩ সালে, যে চিন স্বীয়ভাগ সোয়াবিন আমদানি করত আমেরিকা থেকে, তারা এখন আমদানি করছে ব্রাজিল থেকে। চিন নিজের উদ্যোগে ব্রাজিলে স্থাপন করেছে সোয়াবিনের ফ্যাক্টরি, যার প্রধান ক্রেতা আবার চিন নিজেই। ট্রাম্প চিৎকার চেঁচামেচি করে, ভয় দেখিয়ে যা করতে না পারছে, চিনের সরকার চুপচাপ তাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশই চিনের দেখানো রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন
মাথার দাম ৪০ হাজার ডলার, ক্রীতদাস দুনিয়ার ‘কালো’ ঈশ্বরী হ্যারিয়েটকে সেলাম
এই অবস্থা থেকে ট্রাম্পরা কি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে না? করছে তো, বিভিন্ন দেশের উপর ইচ্ছামতো ট্যারিফ চালু করেছে, আর রাশিয়া যে আশঙ্কা করছিল, যে ট্রাম্প ক্রিপ্টোকারেন্সিতে মনোযোগ দেবে, সেটাও শুরু করেছে। আর একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারের অঙ্কটা মনে করি, ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ৩৮ এর পরে ১৩ টা শূন্য! এই বিপুল ঘাটতি মেটাতে গেলে বিটকয়েন, ইথেরিয়াম এবং সোলানার মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি ছাড়া ট্রাম্পের গতি নেই, কারণ এই দুনিয়ায় তো হিসাব গুলিয়ে দেওয়া সোজা। সপ্তাদুয়েক আগে, এক ঝটকায় এক ট্রিলিয়ন ডলার হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গিয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি মার্কেট থেকে, যার আশঙ্কা রাশিয়া আগেই করেছিল।
এই ভাবে চলতে থাকলে, একদিন বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকের পালক খসে পড়বে মার্কিন মুকুট থেকে। অতীতে, একসময় পাউন্ড যেমন তার মর্যাদা হারিয়েছিল, অদূর ভবিষ্যতে ডলার ও হয়ত গ্রহণযোগ্যতা হারাবে বিশ্বের দরবারে; বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব মুদ্রায় ব্যবাসা বাণিজ্য করার চেষ্টা করবে, আর সেই সঙ্গে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে প্রাচীন লেনদেনের মাধ্যম— সোনা ও রুপো। অদূর ভবিষ্যতে, আমরা হয়ত সেই দিন দেখে যাব, কারণ পৃথিবীর কোনোকিছুই অপরাজেয় নয়।

Whatsapp
