পেলব অথচ নৃশংস! কেন পড়তেই হবে নোবেলজয়ী হ্যান কাং-এর লেখা?
Nobel laureate Han Kang: কবি, লেখক, শিল্পীরা সত্যের বাইরে গিয়ে আরেক সত্যের খোঁজ করেন। কাং আমাদের এক নগ্ন সত্যের কাছে নিয়ে যান, ভণিতা ছাড়াই।
কোমল অথচ নৃশংস! সাহিত্যে নোবেলজয়ী হ্যান কাং-এর লেখা পড়া তাই খুব একটা সহজ কাজ নয়। আসলে আষাঢ়ে দুপুরে জমিয়ে, আয়েশ করে সাহিত্যচর্চার জন্য কলম ধরেননি হ্যান কাং। মানুষের নিরাপত্তা, মানুষের কমফোর্ট জোন থেকে তাদের নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন হ্যান। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে হ্যানের লেখা পড়তেই হবে কারণ, হ্যান অস্বস্তিতে ফেলেন, হ্যান আরামও দেন। বিশ্বসাহিত্যের জগতে হ্যানকে বলা হয় উপন্যাসের পিকাসো। গল্প বলেন তিনি, তবে ভিন্নতর দৃষ্টিতে, ভিন্ন ধরনে। বাস্তববাদী উপন্যাসকে বিকৃত করে ফেলেন। উদ্ভট অস্বস্তিকর পরিধিতে এনে ফেলেন মানুষকে। বেরনোর পথ নেই, পালানোরও না! মানুষের অবস্থা সম্পর্কে সত্য কথা বলছেন হ্যান, পচে যাওয়া সিস্টেমের গলে যাওয়া চেহারা প্রকাশ্যে এনেছেন। এমন একটি সত্যের কথা বলেছেন হ্যান যা বাস্তবসম্মত উপস্থাপনায় চিত্রিত করাই যায় না।
হ্যান কাংয়ের গল্প আমাদের ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। একটি পুঁজিবাদী এবং পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের যে যে শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতি করতে পারে হ্যান কাং-এর গল্পগুলি সেই কথাই বলে। এই সিস্টেমকে উপেক্ষা করা অসম্ভব, এই হিংসাকেও এড়িয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব। যেমন হ্যানের দ্য ভেজিটেরিয়ান গল্পটি। গল্পটি শুরু হচ্ছে এই লাইনটি দিয়ে,
“It was late May when I first saw the bruises on my wife’s body"
একজন দক্ষ সঙ্গীতশিল্পীর মতো ধীরে ধীরে পাঠকের হাত ধরে গভীরে যেতে শুরু করেন কাং তারপর ছেড়ে দেয় তুমুল এক উথালপাথালের মধ্যে। ওই গল্পে স্ত্রী ইয়েং-হাইয়ের বিদ্রোহও শুরু হয় মৃদু লয়ে। গল্পের শুরুতেই ইয়েং-হাইয়ের স্বামীকে বলতে শোনা যায়,
“The only respect in which my wife was at all unusual was that she didn’t like wearing a bra”। কারণ? “because of the way it squeezed her breasts, and that I’d never worn one myself so I couldn’t understand how constricting it felt”
বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ নারী এই ঘটনাকে সমর্থন করেছেন, কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, সমাজ ও সিস্টেম মেয়েদের ততক্ষণই প্রতিবাদ করার অনুমতি দেয় যতক্ষণ তা মৃদু। প্রতিবাদ তীব্র হলেই দাঁত নখ বেরিয়ে আসে। কাং দক্ষতার সঙ্গে একজন বিদ্রোহীর অনিবার্য পতনের কথা নথিভুক্ত করে গেছেন।
আরও পড়ুন- AI-ই বিজ্ঞানীদের শেষ ভরসা? কী বলছেন রসায়নে নোবেলজয়ী হ্যাসাবিস?
কাংয়ের ছোটগল্প দ্য ফ্রুট অফ মাই ওম্যান-এ একজন স্ত্রী বলেছেন, "This isn’t living.. it only looks like it"। কবি, লেখক, শিল্পীরা সত্যের বাইরে গিয়ে আরেক সত্যের খোঁজ করেন। কাং আমাদের এক নগ্ন সত্যের কাছে নিয়ে যান, ভণিতা ছাড়াই। দ্য ভেজিটেরিয়ান গল্পটি খুব কাছ এই সত্যের কাছে নিয়ে যায় পাঠককে। একজন শিল্পী তার চারপাশের দুর্দশা থেকে সৃজনশীল অনুপ্রেরণা নিয়েই ব্যতিক্রমী শিল্প তৈরি করেন, তবু এই ধরনের শিল্প তৈরির প্রক্রিয়া আসলে তাকেও ধ্বংস করে দেয়।
মানব ইতিহাসে বহুবার প্রতিবাদের রূপ হিসেবে মানুষ নিজেকে অনাহারে শেষ করে দিয়েছে। এই জাতীয় অনশনের নজির অজস্র। সাফরাজেট আন্দোলন, মহিলাদের ভোটাধিকার, আইরিশ প্রতিবাদকারীদের আন্দোলন, তামিল টাইগারদের ব্রাদারলেস নাইট-এর মতো বহু আন্দোলন হয়েছে। একই রকম কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রতিবাদের গল্প লিখেছেন কাং। একজন বিদ্রোহী যোদ্ধার উদ্দীপ্ত উদ্দীপনা নয়, এক শান্ত হতাশার কথা লিখেছেন তিনি। খাবার বিষয়ে আরেকটি গল্পে বহুজনের মিলেমিশে খাওয়ার একটি উল্লেখ রয়েছে। অথচ আনন্দের সেই উপলক্ষ্য কীভাবে দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে সেই দৃশ্য অবর্ণনীয়ভাবে সৃষ্টি করে গেছেন কাং। সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে নয়, এই সময়কে বুঝতে গেলে কাং-এর লেখা পড়তেই হবে।
হ্যান কাং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম লেখিকা হিসেবে নোবেল জিতলেন। এখনও পর্যন্ত নোবেলজয়ী ১২১ জনের মধ্যে ১৮তম মহিলা তিনি। তাঁর সবচেয়ে পরিচিত উপন্যাস, দ্য ভেজিটেরিয়ান (২০০৭ সালে কোরিয়াতে প্রকাশিত) ২০১৫ সালে প্রথম ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছিল। ২০১৬ সালে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছিল এই বই। হ্যান কাং এ পর্যন্ত ইংরেজিতে ছয়টি কাজ প্রকাশ করেছেন। দ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হিউম্যান অ্যাক্টস, দ্য হোয়াইট বুক, ইউরোপা এবং গ্রিক লেসনস। ১৯৪৮-৪৯ সালের জেজু বিদ্রোহ এবং তাঁর বন্ধুর পরিবারের উপর এর প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী একজন লেখক সম্পর্কে তাঁর নতুন উপন্যাস উই ডু নট পার্ট ২০২৫ সালে প্রকাশিত হবে।