৩১ বছর জেল, ১৫৪ বার বেত্রাঘাত! নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী জেল বন্দি মহম্মদির লড়াই অবাক করবে

Nobel Peace Prize 2023 Narges Mohammadi : নার্গেস ১৩ বার গ্রেফতার হয়েছেন, পাঁচবার সাজা পেয়ে মোট ৩১ বছর জেলে কাটিয়েছেন এবং ১৫৪ বেত্রাঘাতের সাজা পেয়েছেন।

নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তিনি কারাবন্দি। নোবেল পুরস্কার প্রদানের মঞ্চের আলোর নীচে যখন ততোধিক আলো হয়ে বসে আছেন অন্যান্য ক্ষেত্রের পুরস্কার বিজয়ীরা, তাঁর আসন শূন্য। ভরা মঞ্চে একটি শূন্য আসনই যেন প্রতিবাদ। নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী নার্গেস মহম্মদির হয়ে সম্মান গ্রহণ করেন তাঁর সন্তানরা। সন্তানরাই জানান, ইরানে অত্যাচারী, নারীবিরোধী ধর্মীয় সরকারের নিন্দা করেছেন নার্গেস মহম্মদি। ইরানের জনগণ ঠিকই একদিন এই স্বৈরাচারের উচ্ছেদ ঘটাবে, বিশ্বাস করেন তিনি।

ইরানে বাধ্যতামূলক হিজাব পরা এবং মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন নার্গেস মহম্মদি। ২০২১ সাল থেকেই তেহরানের এভিন কারাগারে বন্দি তিনি। তিনি নেই, তাঁর পরিবর্তে, তাঁর ১৭ বছর বয়সি যমজ সন্তান আলি এবং কিয়ানা এই সম্মান গ্রহণ করে। দুই সন্তানই ২০১৫ সাল থেকে ফ্রান্সে থাকেন। তাঁরা নিজেদের দেশ থেকে নির্বাসিত। জেলে বন্দি অবস্থাতেও কোনও রকমে একটি বক্তব্য লুকিয়েচুরিয়ে পাঠিয়েছেন নার্গেস। নোবেল পুরস্কার প্রদানের মঞ্চে সেই বক্তৃতাই পড়ে শোনানো হয়।

"আমি একজন মধ্যপ্রাচ্যের মহিলা। আমি এমন এক অঞ্চল থেকে এসেছি যেটি সমৃদ্ধ সভ্যতা হওয়া সত্ত্বেও এখন যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদের আগুন এবং চরমপন্থার কারণে স্তব্ধ। আমি একজন ইরানি নারী, এই সভ্যতায় আমারও গর্বিত এবং সম্মানজনক ভূমিকা আছে। অথচ আমি এখন স্বৈরাচারী ধর্মীয় সরকারের নিপীড়নের কবলে," লিখেছেন নার্গেসি।

২২ বছরের ইরানি কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর কারণে ইরান জুড়ে যে বিক্ষোভ চলে তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহম্মদি। ২০২২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মারা গিয়েছিলেন আমিনি। ইরানের ধর্মীয় পুলিশ মহিলাদের জন্য হিজাব ও বোরখা বাধ্যতামূলক করার কথা বলে। আমিনি সেই বিধি না মানায় তাঁকে আটক করা হয়। আমিনির মৃত্যুর পর যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা ইরানের সমস্ত মহিলাদের হিজাব পরা বাধ্যতামূল করা এবং তেহরানে মুসলিম ধর্মগুরুর নেতৃত্বাধীন সরকারের অবসান চেয়েছিল।

 

নিজের লিখিত বক্তব্যে মহম্মদি বলেন, সরকার কর্তৃক আরোপিত বাধ্যতামূলক হিজাব কোনও ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই নয়। এটি সমাজে কর্তৃত্ব বজায় রাখার এবং বশ্যতা বজায় রাখার একটি উপায় মাত্র। ইরান সরকারি দমনপীড়ন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অভাব, বাধ্যবাধকতা এবং দুর্নীতির মধ্যে ফেলে রেখেছে এর জনগণকে। ইরান বিশ্ববিচ্ছন হয়ে পড়েছে।

অসলোতে যখন নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের ধুমধাম, নার্গেস মহম্মদি তখন বাহাই সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে অনশন পালন করছেন। ইরানের বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু বাহাইরা জানাচ্ছেন বৈষম্যের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন তারা।

মহম্মদি নোবেল শান্তি পুরস্কারের ১২০ বছরেরও দীর্ঘ ইতিহাসে পঞ্চম বিজয়ী যিনি বন্দি অবস্থায় এই পুরস্কার পেয়েছেন। এর আগে জার্মানির কার্ল ফন ওসিয়েটস্কি, মায়ানমারের অং সান সু চি, চিনের লিউ জিয়াওবো এবং বেলারুশের আলেস বেলিয়াতস্কিও বন্দি অবস্থাতেই এই সম্মান পেয়েছেন।

নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির পক্ষে বেরিট রেসিস অ্যান্ডার্সন বলেন, নার্গেস মহম্মদির লড়াই আলবার্ট লুটুলি, ডেসমন্ড টুটু এবং নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে এই লড়াই। নার্গেস ১৩ বার গ্রেফতার হয়েছেন, পাঁচবার সাজা পেয়ে মোট ৩১ বছর জেলে কাটিয়েছেন এবং ১৫৪ বেত্রাঘাতের সাজা পেয়েছেন। নার্গেস মহম্মদি গত দুই দশকের বেশির ভাগ সময়ই জেলে এবং জেলের বাইরেই কাটিয়েছেন। তাঁর যমজ সন্তানরা প্রায় নয় বছর তাঁদের মাকে দেখেনি। সন্তানরা জানেও না মাকে আবার জীবিত দেখতে পাবেও কিনা। মেয়ে কিয়ানা খুব একটা আশা দেখেন না, ভাই আলি অবশ্য আশাতেই বাঁচেন।

ইরানের মানবাধিকার সংস্থা বলছে, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নারী ও শিশুসহ ৫৫১ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন এবং হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমিনির পরিবারের আইনজীবী জানান, আমিনির বাবা-মা এবং ভাইতের ১৩ ডিসেম্বর একটি অনুষ্ঠানে একটি পুরস্কার লাভের কথা ছিল। ইউরোপিয় পার্লামেন্টের সাখারভ পুরস্কার, আমিনির জন্য। অথচ ইরান ছেড়ে কোথাও যেতে নিষেধ করা হয়েছে তাঁদের।

More Articles