ভারতে ফিরছে ২৬/১১-র মাস্টারমাইন্ড তাহাউর রানা, কীভাবে সাজিয়েছিল হামলার ছক?

Tahawwur Hussain Rana 26/11: তাহাউর রানা নিজেই ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে ভারত সফর করে। ১৩ থেকে ২১ নভেম্বর, অর্থাৎ হামলার মাত্র ক’দিন আগে, স্ত্রীর সঙ্গে ভারত ভ্রমণে আসে।

আমেরিকা থেকে ভারতে ফেরানো হচ্ছে ২৬/১১ মুম্বই হামলার অন্যতম চক্রী তাহাউর হুসেন রানাকে। নয়াদিল্লি সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার বিকেলে একটি বিশেষ বিমানে করে ভারতে নিয়ে আসা হবে রানাকে। সেই বিশেষ বিমান আমেরিকা থেকে রওনাও দিয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ-এর ঊর্ধ্বতন কর্তারা তাহাউর রানাকে সঙ্গে করে আনবেন বলে খবর। ভারতে এসে প্রথমে তাঁর একটি রুটিন মেডিকেল পরীক্ষা হবে এবং তারপর সরাসরি তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে এনআইএ সদর দফতরে। সেখানেই কিছুদিন থাকবে তাহাউর রানা। তারপর স্থানান্তর করা হবে মুম্বইয়ের তিহার জেলের বিশেষ এক সেলে। এর জন্য ইতিমধ্যেই তিহার জেলে তৈরি রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সেখানেই হয়তো বাকি সময়টা কাটাবে তাহাউর রানা। জানা যাচ্ছে, তাকে সরাসরি আদালতে নিয়ে আসা হবে না। তাহাউর রানা যাতে কোনওভাবেই পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না পায়, সেই জন্য অনলাইন ভিডিও কলের মাধ্যমে তার শুনানি হবে বলে জানা যাচ্ছে।

২৬/১১ মুম্বই হামলা ও তাহাউর হুসেন রানা

২৬ নভেম্বর, ২০০৮। ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বইয়ে নেমে আসে বিভীষিকার ছায়া। লস্কর-ই-তৈবার জঙ্গিরা ছুরি-কামান হাতে হানা দেয় তাজ হোটেল, লিওপোল্ড ক্যাফে, ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস এবং আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। ওই হামলায় ১৬৬ জন প্রাণ হারায়, আহত হয় শত শত। কিন্তু এই হামলার পেছনে যে আন্তর্জাতিক পরিসরের একটি সংগঠিত ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল, তা সামনে আসে ধাপে ধাপে তদন্তে। সেই ছায়ার ভেতরে এক মুখ নীরবে, দৃশ্যপটের আড়ালে ছায়ার মতো কাজ করছিল— তাহাউর হুসেন রানা।

তাহাউর হুসেন রানা: এক দ্বিমুখী পরিচয়

তাহাউর হুসেন রানা আদতে একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক। পেশায় ছিল চিকিৎসক। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছে কিছুদিন । তারপর অভিবাসনের নামে আমেরিকার শিকাগোতে খুলে বসে ‘First World Immigration Services’ নামক একটি সংস্থা। বাহ্যিকভাবে সাধারণ অভিবাসন সংস্থার কর্ণধার হলেও, রানার অফিস ছিল আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের এক ‘ক্রস রোড’, যেখানে যুক্ত হয়েছিল লস্কর-ই-তৈবা, আইএসআই, এবং পাকিস্তানি সামরিক গোপনচক্র।

আরও পড়ুন-ছিঁচকে চুরি থেকে মুম্বই হামলা, নৃশংস ঘাতক কাসভকে যেভাবে সবক শিখিয়েছিল ভারত

ডেভিড হেডলির সঙ্গে রানার সখ্য

তদন্তে উঠে এসেছে যে, তাহাউর রানা ছিল মার্কিন নাগরিক তথা লস্কর-ই-তৈবার অন্যতম মুখ ডেভিড কোলম্যান হেডলির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী। হেডলি নিজেই স্বীকার করেছে, সে পাকিস্তানে লস্কর-ই-তৈবার প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশ নিয়ে ভারতে হামলার জন্য তথ্য সংগ্রহে নিয়োজিত হয়েছিল। সে ছিল একজন ‘স্লিপার এজেন্ট’— যাঁর কাজ ছিল ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে হামলার জায়গাগুলোর রেইকি (গোপনে পর্যবেক্ষণ ও ছবি সংগ্রহ) করা। এই রেইকি মিশনেই তাহাউর রানার ভূমিকা ছিল অপরিহার্য।

ভারত সফরের ছদ্মবেশ: ভিসা, হোটেল আর অফিস

২০০৬ সালে হেডলি প্রথমবার ভারত সফরে আসে। সেই সময় তাহাউর রানার কোম্পানির নামে হেডলির জন্য ব্যবসায়িক ভিসা নিশ্চিত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ভারতে ‘Immigrant Law Centre’ নামে একটি অফিস স্থাপন, যাতে তাঁর যাতায়াত ও উপস্থিতি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। হেডলি ভারতে নামার পরই রানার নিযুক্ত একজন ব্যক্তি তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানায়, থাকার জায়গা, পরিবহণ, এমনকী অফিসের বন্দোবস্ত করে। এই প্রক্রিয়া ছিল চূড়ান্তভাবে পরিকল্পিত। হেডলি একাধিকবার ভারত সফর করেছে এবং প্রতিবারই রানার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রক্ষা করেছে— মোট ২৩১ বার। সফরভেদে ২৩ থেকে ৬৬ বার ফোন করা হয় রানাকে, যা পরিস্কারভাবে বোঝায়, প্রতিটি পদক্ষেপে রানা ছিল অবগত ও জড়িত।

প্রসারিত ষড়যন্ত্রের নীল নকশা

হেডলি শুধুমাত্র মুম্বই নয়, দিল্লি, পুনে, গোয়া, হায়দরাবাদ— এসব শহরেরও বিভিন্ন স্থান পর্যবেক্ষণ করে। এরপর পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে লস্করের মস্তিষ্ক হাফিজ সাঈদের সঙ্গে এসব তথ্য ভাগ করে নেয়। এই পর্যায়ে হেডলি রানাকে পরিচয় করিয়ে দেয় লস্করের অপারেশন প্রধান আবদুর রহমান ও সন্ত্রাসবাদী নেতা ইলিয়াস কাশ্মীরির সঙ্গে। দুবাইয়ে একটি গোপন বৈঠকে রানা ও রহমানের দেখা হয়, যেখানে পরবর্তী হামলার ছক কষা হয়।

এছাড়াও রানার মাধ্যমে হেডলি তাঁর ১০ বছরের বহুপ্রবেশযোগ্য ভিসা পায়, যার ফলে বারবার অবাধে ভারতে আসতে পারে সে। এই সুবিধাগুলো ছাড়া হামলার প্রস্তুতি এত দীর্ঘ সময় ধরে করা যেত না।

হামলার আগের সফর: রানা নিজে ভারতে

চূড়ান্ত ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, তাহাউর রানা নিজেই ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে ভারত সফর করে। ১৩ থেকে ২১ নভেম্বর, অর্থাৎ হামলার মাত্র ক’দিন আগে, স্ত্রীর সঙ্গে ভারত ভ্রমণে আসে— হাপুর, দিল্লি, আগ্রা, কোচিন, আহমেদাবাদ, মুম্বই। এই সফর নিছক পর্যটন সফর ছিল না— তদন্ত সংস্থা মনে করে, এটি ছিল শেষ ধাপের মাঠ পর্যবেক্ষণ, যেখানে হামলার লক্ষ্য ও গতিপথ চূড়ান্ত করা হয়।

ডেনমার্ক ষড়যন্ত্রে হেডলি-রানার জোট

২০০৮ সালে মুম্বই হামলার রক্তাক্ত স্মৃতি সতেজ থাকা অবস্থাতেই আরেকটি ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছিল ইউরোপের মাটিতে। পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার নির্দেশে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন এবং আরহুস শহরে অবস্থিত ‘মর্গেনাভিসেন জিউল্যান্ডস-পোস্টেন’ পত্রিকার অফিসে হামলার পরিকল্পনা শুরু করে ডেভিড কোলম্যান হেডলি। উদ্দেশ্য ছিল নবী মহম্মদের কার্টুন প্রকাশের 'প্রতিশোধ' নেওয়া।

২০০৫ সালে ডেনমার্কের পত্রিকা 'মর্গেনাভিসেন জিউল্যান্ডস-পোস্টেন' নবী মহম্মদের কার্টুন প্রকাশ করে, যা বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈবা (LeT) পত্রিকাটির ওপর হামলার পরিকল্পনা করে। এই ষড়যন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ডেভিড কোলম্যান হেডলি এবং তাহাউর হুসেন রানা।

ডেভিড হেডলি, একজন মার্কিন নাগরিক যে পাকিস্তানে লস্কর-ই-তৈবার প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশ নিয়েছিল, তাকে পত্রিকাটির অফিসের ওপর নজরদারি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই কাজে সহায়তা করে তাহাউর রানা। রানা হেডলিকে তার কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিয়ে ডেনমার্কে পত্রিকাটির অফিসে প্রবেশের অনুমতি দেয়, যাতে হেডলি বিজ্ঞাপন দেওয়ার ছলে অফিসের ভেতরের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।

ডেভিড কোলম্যান হেডলি

হেডলি দুইবার ডেনমার্কে গিয়ে পত্রিকাটির কোপেনহেগেন এবং আরহুস অফিসের ভিডিও করে এবং সেই তথ্য লস্কর-ই-তৈবার কাছে পাঠায়। এই পরিকল্পনার কোডনেম ছিল 'মিকি মাউস প্রজেক্ট'। তবে, এই হামলা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ২০০৯ সালের অক্টোবরে হেডলি গ্রেফতার হয়।

আরও পড়ুন-মুম্বইয়ের বস্তি থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাদশা! এখন কোথায় আছে দাউদ ইব্রাহিম?

যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার ও প্রত্যর্পণ

২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার হয় রানা। সেখানে তাঁকে ২৬/১১ মামলায় দোষী সাব্যস্ত না করা হলেও, ডেনমার্কে জঙ্গি হামলার ষড়যন্ত্রে তার দোষ প্রমাণিত হয় এবং ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ বছরের পর্যবেক্ষণের শাস্তি দেওয়া হয়।

২০১৯ থেকে তাহাউর হুসেন রানার প্রত্যর্পণ নিয়ে আমেরিকার উপরে চাপ বাড়াতে শুরু করে ভারত সরকার। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর এই মামলা আবার নতুন করে গতি পায়। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর আমেরিকার আদালত জানিয়ে দেয়, ভারতে ফিরবেন রানা। তবে, এরপরেও ভারতের শাস্তি এড়াতে চেষ্টা করে তাহাউর রানা। ভারতে প্রত্যর্পণের নির্দেশের উপরে স্থগিতাদেশ চেয়ে সম্প্রতি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে রানা। তবে, সেই আবেদন নাকচ করে দেয় আদালত। অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে ভারতে প্রত্যর্পণের নির্দেশ পুনর্বিবেচনার জন্য আর্জি জানিয়েছিল ৬৪ বছর বয়সি এই পাকিস্তানি কানাডিয়ান ডাক্তার। রানা লিখেছিল, "আমি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এবং মুসলিম। তাই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমার উপর অত্যাচার চালাবেন বলে আশঙ্কা করছি।’’ তবে, সে দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস, গত সোমবার জানিয়ে দেন, ভারতের হাতেই তুলে দেওয়া হবে তাহাউর হুসেন রানাকে। ভারতে প্রত্যর্পণের আদেশ কার্যকর হওয়ার পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

তাহাউর হুসেন রানার নাম হয়তো প্রথম সারির জঙ্গিদের মতো ভয়ঙ্করভাবে উচ্চারিত হয় না কিন্তু তার অবদান ভীষণই ভয়ঙ্কর। তাহাউর নিজে অস্ত্র হাতে নেয়নি ঠিকই কিন্তু হামলার ভিত্তিপ্রস্তর— ভিসা, নিরাপদ আশ্রয়, যোগাযোগের ধারা ও পরিচয়ের আবরণ — স্থাপন করেছেন। তার মতো ব্যক্তিরা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সন্ত্রাসবাদ শুধু বন্দুকধারীর গল্প নয়, বরং পেছনের সেই ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনাকারীদের চক্রান্ত, যারা কর্পোরেট আর পাসপোর্টের ছায়ায় বসেই গোটা এক শহরকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করতে পারে।

More Articles