১১ বছর ধরে মহাকাশ স্ক্যান করে মানচিত্র! গায়া যেভাবে বদলে দিচ্ছে বিজ্ঞানীদের ধারণাও

Gaia Spacecraft: মহাকাশের স্ক্যানিং ও ম্যাপিংয়ের সময়, গায়া একটি নতুন ধরনের কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কার করে, যেটি পৃথিবীর খুব কাছাকাছি অবস্থিত।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মহাকাশের অসংখ্য তারার গতিবিধি বিচার বিশ্লেষণ করার পর গত ২৭ মার্চ অবসর গ্রহণ করেছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ)স্পেস ক্রাফ্ট, ‘গায়া’। এক্স হ‍্যান্ডেলে ইএসএ জানিয়েছে, "মহাকাশযানটিকে সফলভাবে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে"। অর্থাৎ কোনওরকম আভ‍্যন্তরীণ শক্তি উৎস থেকে শক্তি নিয়েও পুনরায় চালু হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। কিছুদিন আগে অবশ্য এটি সুর্যের চারপাশে অবসরকালীন কক্ষপথে যাওয়ার জন্য থ্রাস্টার ব‍্যবহার করেছিল।

ছায়াপথ বা গ্যালাক্সির সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট, ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরির লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গ্লোবাল অ‍্যাস্ট্রোমেট্রিক ইন্টারফেরোমিটার (GAIA) বা গায়াকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। জ‍্যোতির্বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ‍্য ছিল এর সাহায্যে কাছের ও দূরের নক্ষত্র এবং অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুর অবস্থান এবং গতিবিধির সুনির্দিষ্ট পরিমাপ করা।

২০১৪ সালের ২৪ জুলাই থেকে পর্যবেক্ষণ শুরু করে অবশেষে ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি শেষবারের মতো তথ্য সংগ্রহ করে গায়া। এই এক দশকে, স্পেস ক্রাফ্টটি অন্তত ৩ ট্রিলিয়ন সফল পর্যবেক্ষণ করেছে, যার ফলস্বরূপ ২ বিলিয়ন নক্ষত্র ও দেড় লক্ষ অ‍্যাস্টরয়েড বা গ্রহাণুর তথ্য আজ বিজ্ঞানীদের হাতের নাগালে। সেসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ১৩,০০০ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র! এই বিপুল তথ্যের মাত্র একটি ভগ্নাংশ দিয়ে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের ছায়াপথকে ঘিরে থাকা অন্ধকার পদার্থের ভর অনুমান করতে সক্ষম হয়েছেন এবং ১০ বিলিয়ন বছর আগে অন্য একটি ছায়াপথ থেকে অনধিকারভাবে আমাদের ছায়াপথে প্রবেশকারী হাজার হাজার নক্ষত্রকে চিহ্নিত করেছেন।

গায়া পৃথিবী থেকে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার 'পিছনে' ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট ২ (L2)-তে অবস্থিত ছিল। kI এই ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট? পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে এমন পাঁচটি বিন্দু রয়েছে, যেখানে কোনO ক্ষুদ্র বস্তুকে প্রতিস্থাপন করতে পারলে তার ওপর ক্রিয়াশীল বলের মান শূন্য, অর্থাৎ বস্তটি প্রায় স্থির থাকে। এই বিন্দুগুলোর নাম ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট। ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট ২-তে (L2) অবস্থান করার ফলে এটি গ্রহ, সূর্য, এমনকী চাঁদের বাধা ছাড়াই বৃহত্তর মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করেছে।

আরও পড়ুন- এবার মহাকাশে বিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন! যে অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করছে চিন

মহাকাশে ঘুরতে থাকা এই স্পেস ক্রাফ্টে একজোড়া টেলিস্কোপ রয়েছে, যার প্রতিটির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে প্রায় এক বিলিয়ন পিক্সেল বিশিষ্ট অত্যাধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরা, যাদের কাজ হলো সর্বদা আকাশকে স্ক্যান করা।

এছাড়াও এই নভোযানে একটি অ্যাস্ট্রোমিটার, একটি ফটোমিটার এবং একটি স্পেকট্রোমিটার লাগানো আছে, যাদের মাধ্যমে নক্ষত্র এবং অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুর অবস্থান, বেগ এবং রঙ পরিমাপ করা যেত। এই তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা তাপমাত্রা, ভর এবং রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে তথ্য অনুমান করেছেন।

গায়া মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। কেবল ছায়াপথের ত্রিমাত্রিক মানচিত্রই নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কীভাবে পরিবর্তিত হয় তাও দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এর সাহায্যে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতপক্ষে আমাদের ছায়াপথ যে সর্পিলাকার, তা বুঝতে সক্ষম হন। এর প্রান্ত থেকে দেখলে, ছায়াপথকে একটি স্ফীত ডিস্ক হিসাবে দেখা যায়। গায়া দেখায় যে, এই ডিস্কটি বিকৃত এবং খুব ধীরে ধীরে এটি বাম থেকে ডান দিকে কাঁপছে — সম্ভবত কোনও ছোট উপগ্রহ গ্যালাক্সির সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে এমনটা লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটিশ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অধ্যাপক ক্রিস লিনটটের মতে, এই সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট তরঙ্গগুলি এখনও বিদ্যমান এবং এর ফলে সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র সৃষ্টি হতে পারে। এই বছর ফেব্রুয়ারির শেষে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, "এটি দেখায় যে গায়া কীভাবে প্রকাশ করছে যে মিল্কিওয়ের ইতিহাস আমাদের ধারণার চেয়ে আরও গতিশীল ও জটিল"।

গায়া স্পেসক্রাফ্টের তোলা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির পূর্ণাঙ্গ ছবি

মহাকাশের স্ক্যানিং ও ম্যাপিংয়ের সময়, গায়া একটি নতুন ধরনের কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কার করে, যেটি পৃথিবীর খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ইউরোপিয়ান এজেন্সির মতে, গায়া স্পেস ক্রাফ্ট যে কৃষ্ণগহ্বরগুলিকে আবিষ্কার করেছে, তা কেবল মহাকর্ষীয় প্রভাব দ্বারাই শনাক্ত করা যায়। অন্যদিকে, পূর্বে আবিষ্কৃত কৃষ্ণগহ্বরগুলি ধ্বংসাবশেষ থেকে নির্গত আলো দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। তবে মিশনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে, বিজ্ঞানীরা মহাকাশে এক দশক ধরে ব্যবহার করা প্রযুক্তির মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যতের মিশন তৈরিতে সহায়তার জন্য ক্রমশ পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন- SPADEX মিশন: নতুন বছরে প্রথম মহাকাশ অভিযানে সফল হবে দেশ?

গত দশ বছরের অধিকাংশ সময় ব‍্যয় হয়েছে মহাজাগতিক বস্তুর তথ্য সংগ্রহ করতে, যার পুরোটা এখনও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি। ইএসএ-র বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর ধরে মহাকাশযান সংগৃহীত সমস্ত তথ্যকে পদ্ধতিগতভাবে ডাউনলিংক করছেন, যা আগামী বছরগুলিতে প্রকাশিত হবে, যার ফলে আরও নতুন নতুন আবিষ্কারের দরজা উন্মুক্ত হবে বলে আশাবাদী গবেষকরা। ইএসএ জানিয়েছে মিশনের প্রথম সাড়ে পাঁচ বছরের তথ্য ২০২৬ সালের মধ্যে প্রকাশ করা হবে। এই দশকের শেষের দিকে আরও একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটা সেট বা তথ্য ভাণ্ডার প্রকাশ করা হবে। এর ব্যাপক পরিধিব সত্ত্বেও, এই সময়ের মধ্যে গায়া গ্যালাক্সির ১০০ বিলিয়ন তারার মাত্র ২% ম্যাপ করে ফেলেছিল, অনেক কিছু এখনও অজানা।

গায়া স্পেস ক্রাফ্টের শুধু তথ‍্যই নয়, তার এই এক দশকের অভিজ্ঞতা জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীদের আগামী দিনের পাথেয়। ভেরা সি রুবিন অবজারভেটরি এবং ইওরোপের এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপের সাথে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এবং ইউক্লিড মিশন, গায়ার ডেটা ক্যাটালগ ব্যবহার করে তাদের পর্যবেক্ষণগুলিকে আরও বৈজ্ঞানিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। ইউরোপিয় বিজ্ঞানীরা ইনফ্রারেড আলো সংগ্রহের জন্য অদূর ভবিষ্যতে একটি মহাকাশযানের পরিকল্পনা করছেন। এসব এক সফল স্পেস ক্রাফ্টের পরিচয় বহন করে। গায়ার বিজ্ঞানী সাহলম্যানের বক্তব্যে সে কথাই উঠে এসেছে, "…আমাদের নক্ষত্রদের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য গায়াকে ধন্যবাদ। আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ। আমাদের ভবিষ্যৎকে অনুপ্রাণিত করার জন্য ধন্যবাদ।"

More Articles