বাড়তে চলছে চকলেট বোমার রমরমা, বঙ্গবাজারে এই কালীপুজোয় পাওয়া যাবে যে যে বাজি
Firecrackers in Diwali 2023: এ রাজ্যেও বাজি পোড়ানো নিয়ে জারি হয়েছে একাধিক নিষেধাজ্ঞা। তবে বাজি পোড়ানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ নয় বাংলায়।
মাত্রাছাড়া দূষণ। ভর দুপুরেই দিল্লি জুড়ে নেমেছে সন্ধের আঁধার। এতই ধোঁয়াশা যে এক মিটার দূরের বস্তুকেই দেখা যায় না ভালো করে। দূষণের এই অতি বিপজ্জনক পরিস্থিতি সামাল দিতে দিল্লি জুড়ে জারি হয়েছে আংশিক লকডাউন। সামনেই দীপাবলী। আলোর উৎসব। আতসবাজির রশনাইয়ে ছেয়ে যাবে আকাশ। আর বাতাসের গুণগত মান নেমে যাবে আরও আরও নিচে। স্বাভাবিক ভাবেই এ বছরের দেওয়ালি নিয়ে একটু বেশিই স্পর্শকাতর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। সুপ্রিম কোর্ট সটান জানিয়ে দিয়েছে, শুধু দিল্লিতে নয়, গোটা দেশ জুড়েই এ বার নিষিদ্ধ আতসবাজি।
বেরিয়াম সল্ট এবং অন্যান্য বাতাসে দূষণ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দিয়ে তৈরি আতসবাজির ব্যবহার বন্ধ করার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজস্থান সরকার। সেই মামলার শুনানিতে রুদ্রং দেহি মনোভাবে দেখা গেল শীর্ষ আদালতকে। বিচারপতিদের বেঞ্চ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তাদের পর্যবেক্ষণ, এখন বাজি মোটেই ছোটরা পোড়ায় না আর। বরং সাবালকদের উল্লাসের একটি পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বাজি উৎসব। পরিবেশ দূষণকে আটকানো শুধু শীর্ষ আদালতের দায়িত্ব নয়। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব দেশের প্রতিটি নাগরিকের। তবে কি সত্যিই এ বছর দিওয়ালি হতে চলেছে গোটা দেশের জন্য আতসবাজিহীন? নাকি কিছু কিছু বাজি থাকছে সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞার বাইরে!
আরও পড়ুন: কোথায় বাঁধা অবৈধ বাজি কারখানার টিকি! রাজ্যে যে ভাবে রমরমিয়ে চলে বারুদ-ব্যবসা…
২০২১ সালে বাজিতে আংশিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। বেরিয়াম সল্ট দিয়ে তৈরি আতসবাজিকে নিষিদ্ধ ঘোণা করা হয়েছিল। তবে সেই নিয়মের লঙ্ঘন হয়েছিল গোটা দেশ জুড়ে। বাতাসের পক্ষে ক্ষতিকর বাজিও বেআইনি ভাবে বিক্রি হয়েছিল দেদার। ২০১৮ সালে বাজি পোড়ানোর নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। দিওয়ালির দিন সন্ধে আটটা থেকে দশটা, এবং ক্রিসমাসের দিন রাত ১১.১৫ থেকে ১২.৩০ পর্যন্ত বাজি পোড়ানোর সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে তাতে পরিবেশ দূষণ রোখা যায়নি। বরং গত কয়েক বছরে পাল্লা দিয়ে নেমেছে বাতাসের গুণগতমান। যা নিয়ে প্রবল উদ্বেগে পরিবেশ বিশেষজ্ঞেরা।
এ রাজ্যেও বাজি পোড়ানো নিয়ে জারি হয়েছে একাধিক নিষেধাজ্ঞা। তবে বাজি পোড়ানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ নয় বাংলায়। কালী পুজো আসতে এখনও বাকি কয়েকটা দিন। তবে এর মধ্যেই সন্ধে হতে না হতেই আকাশে নানা ধরনের বাজির মেলা। ইতিমধ্যেই আনন্দে মেতেছেন বঙ্গবাসী। এ বছর বাজি বিক্রির হাটের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়েছে রাজ্য সরকার। ৬ নভেম্বর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত খোলা থাকবে বাজির বাজার। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকবে সেই বাজার।
সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায় জানিয়েছেন, কলকাতার প্রধান বাজির বাজারের জন্য টালা, ময়দান, বেহালা ও কালিকাপুর- এই চারটি জায়গাকে ধার্য করা হয়েছে। মোট ৪৪টি দোকান থাকছে টালায়, ময়দানে থাকছে ৩২টি, ২১টি বেহালায় এবং কালিকাপুরেও ২১টি। তবে এই সবকটি দোকানেই শুধুমাত্র পরিবেশ বান্ধব গ্রিন ক্র্যাকার বিক্রি করা যাবে। এ বছর দীপাবলীতে শুধুমাত্র কিউআর কোড বিশিষ্ট গ্রিন ক্র্যাকার বিক্রিতেই সায় দিয়েছে রাজ্য। যে সব বাজির প্যাকেটে ওই কিউআর কোড থাকবে না, সেগুলি বেআইনি বলে ধার্য করা হবে। গ্রিন ক্র্যাকার ছাড়া সমস্ত বাজি নিষিদ্ধ এ রাজ্যেও বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির পক্ষ থেকে।
সিএসআইআর-ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (CSIR NEERI) দ্বারা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে মানদণ্ড। যেখানে ছোট আবরণ ব্যবহার করা হবে। পাশাপাশি সবুজ রং আনতে বেরিয়াম যৌগ ব্যবহার করা হবে না, এই ধরনের আতসবাজিকেই গ্রিন ক্র্যাকার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইতিমধ্যেই এ রাজ্যে বেশ কয়েকটি বাজি কারখানা বিস্ফোরণের মতো বিপর্যয় ঘটেছে। যার জেরে গত তিন মাসে বহু বাজি কারখানাকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এ রাজ্যে বাজিশিল্পের বাজার বেশ মার খেয়েছে এ বছর। সে কারণে চাহিদা অনুযায়ী বাজিও তৈরি করা যায়নি এই মরসুমে। জানা গিয়েছে, মোট চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ গ্রিন ক্র্যাকার তৈরি করা গিয়েছে এ বছর, যা উৎসবের মরসুমে আদপেই যথেষ্ট নয়। যে কারণে এ বছর ভিন রাজ্য থেকে বাজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিবকাশি থেকে এ রাজ্যে আসবে ৪০ শতাংশ সবুজবাজি, বাকি ২০ শতাংশ আসবে অন্যান্য রাজ্য থেকে।
তবে এ বছর সবুজ বাজি বিক্রির ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত কিউআর কোড। ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট তার জন্য তৈরি করেছে বিশেষ একটি কিউআর কোড, যা বলে দেবে আদৌ সেই বাজি পরিবেশবান্ধব কিনা। আর সেই কিউআর কোড থাকলে তবেই বিক্রি করা যাবে সেই বাজিটি।
তবে আশ্চর্যজনক ভাবে এ বছর এ রাজ্যে শব্দবাজির শব্দমাত্রা বাড়ানো হয়েছে এ রাজ্যে। আলোকবিহীন শব্দবাজির সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা আগে এ রাজ্যে ছিল ৯০ ডেসিবেল। এ বছর সেই মাত্রা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২৫ ডেসিবেল। তবে দিওয়ালি, ছটপুজো ও ক্রিসমাস উপলক্ষে বাজি পোড়ানোর সময়সীমা বেঁধে দিয়ছে রাজ্য সরকার। তবে সাইলেন্স জোনের ১০০ মিটার রেডিয়েন্স পর্যন্ত জায়গায় কোনও ধরনের শব্দবাজির ব্যবহার বেআইনি বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকী তা ১২৫ ডেসিবেলের মধ্যে থাকলেও তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে জানানো হয়েছে।
তবে মুশকিল অন্য জায়গায়। শব্দবাজির সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ বহু বাজিই এ বছর ছাড়া পেয়ে গিয়েছে এ রাজ্যে। চকলেট বোমার মতো যেসব বাজি ব্যবহার এতদিন এ রাজ্যে বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল, এ বছর বাজারে দেদার বিকোচ্ছে সে সব। শব্দমাত্রা বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ওয়াকিবহাল মহলের একটি অংশ। ১৯৯৬ সালে ক্যালকাটা হাইকোর্টের তরফে শব্দবাজির সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিস ৯০ ডেসিবেল। তার বিরোধিতা করে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতি। তার শুনানিতে বিশেষজ্ঞদের মতামত জানতে চায় সুপ্রিম কোর্ট। সেই রিপোর্টে ফিজিক্যাস ল্যাবরটারিসের তরফে নির্ধারিত শব্দমাত্রা জানানো হয় ১৩৫ ডেসিবেল, ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি জানিয়েছিল ১৪৫ ডেসিবল এবং পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড জানায় ১২৫ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ মানুষ ও পশুপাখির জন্য ক্ষতিকর নয়। তার পরেই সুপ্রিম কোর্টের তরফে ১২৫ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দমাত্রা বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়। বহু বছর ধরেই শব্দমাত্রা বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সম্মত হয়নি রাজ্য সরকার। অবশেষে এ বছর গোটা দেশ জুড়ে শব্দবাজির শব্দমাত্রা বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সিলমোহর পড়েছে।
আরও পড়ুন: সবুজ রঙের বাজি মানেই কি পরিবেশবান্ধব? জানুন গ্রিন ক্র্যাকারের আসল সত্য
যদিও এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারেনি পরিবেশবিদদের একাংশ। যেখানে গোটা দেশ জুড়ে আতসবাজি পোড়ানোতেই নিষেধাজ্ঞা জারি করছে সুপ্রিম কোর্ট পরিবেশ দূষণের কথা মাথায় রেখে, সেখানে শব্দবাজির শব্দমাত্রা বাড়ানো দ্বিচারিতা বলেই মনে করছেন তাঁরা। বায়ুদূষণ যতটা দুশ্চিন্তার, শব্দদূষণকে কি সেই গুরুত্ব দিচ্ছে না শীর্ষ আদালত, উঠেছে প্রশ্ন।