ডায়লগ মাথায়! নলিনকাকু স্টেজেই চেঁচিয়ে উঠল, "এই ছুরি ফেরত দে, খেলিস না..."
Winter Theatre Nostalgia: 'সতরঙ্গি রে' টাইপের নাচ যে আসতে চলেছে আমি জানতাম, আমি বাবাকে উইংসে নাচতে দেখেছি সেদিন, রাগে।
এই সময় আমাদের মতো ছোট দলে ব্যস্ততা বাড়ে। নাটকের কম্পিটিশনের মরসুম না এটা! এখন আর কত হয় আমি জানি না, তখন আমরা গোটা বাংলা চষে ফেলতাম কম্পিটিশনে নাম দেওয়ার জন্য। আমি চার বছর বয়স থেকে আমার দলের লক্ষ্মী। আমাকে নেওয়া মানে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী বাঁধা। তাই আমাকে নাটকে রাখার চেষ্টা করা হত। এক কম্পিটিশনে পরপর এক নাটক করা যায় না, তাই একাধিক নাটক তৈরি রাখতে হতো, প্রস্তুত করতে হতো সেই সেই নাটকের সেট আর প্রপস। আর এইসব নাটকের সেটও খুব বুদ্ধি করে করতে হতো। সেট লাগাতে ও খুলতে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয় এবং তা কখনই বেশি নয়। এক মরসুমে একাধিক নাটক তৈরি রাখা শুনতে যত সহজ, একই লোকজন নিয়ে কাজ করা অত সহজ না। অন্তত আমরা চাপ খেয়ে যেতাম! ফলে যেটা হতো, হয় নতুনটা কাচা আর আগেরটা তৈরি থাকতো অথবা উল্টোটা। আরা আমরা যে যা চাপ খেতাম নলিনকাকুর কাছে জমা করে দিতাম কারণ আমার বাবার যাবতীয় উৎপাত সহ্য করার দায়িত্ব ছিল দু'জনের, নলিনকাকু আর দীপকাকু। দীপকাকুর কথা অন্য কোনও দিন। আজকের এই অধ্যায় থাক নলিনকাকুর। নলিনকাকু আশ্চর্য এক মানুষ। একদম শৈশবে পিতৃহারা যৌথ পরিবারের উপেক্ষিত ছোট ছেলে। একটু সাদাসিধে বলে পাড়া থেকে শুরু করে সব জায়গায় খোরাক! তাই বোধহয় আমাদের দলে সম্মানের অক্সিজেন পেত, যার বিনিময় নলিনকাকু সব করতে রাজি ছিল। আমরাও তার সুযোগ নিতাম। আমাদের ভ্রান্তি বাবার থেকে লুকোতে গিয়ে ভুগত নলিনকাকুর পারফরম্যান্স।
'লাশ ঘুইর্যা যাউক'-এর প্রথম শো! নলিনকাকু ইয়াকুব, সেই খারাপ গুন্ডা যে দাঙ্গার সুযোগ নিয়ে লুঠ করে। আলতাফ হচ্ছে সেই ভালো গুন্ডা যে এটা থামায়। ইয়াকুব বলে, “বাড়িওয়ালা কাঁহা?” নলিনকাকুকে সরিয়ে সুভাষ পোদ্দারের এন্ট্রি আলতাফ হয়ে- ”বাড়িওয়ালা ইয়াঁহা”। এখন ফার্স্ট শো, সুভাষ কাকুর হয়তো 'জোশ' বেশি হয়ে গেছে, বেশি জোরে হাত চালিয়েছে, নলিনকাকু উড়ে সেটের ডাক্তারের চেম্বারের ডাক্তারের টেবিলে গিয়ে পড়েছে। পড়েছে সেটাও সমস্যা নয়, সেই মুহূর্তে নলিনকাকুর মনে হয়েছে বিশুদা (আমার বাবা) এরকম টেবিল দেখলে রেগে যাবে। যেই না ভাবা তেমনি কাজ! গুন্ডার চরিত্র থেকে সরাসরি বেরিয়ে গিয়ে একজন সার্থক নাট্যকর্মীর মতো ডায়লগ ভুলে টেবিল পুনরায় দাঁড় করিয়ে গোছাতে শুরু করেন। 'সতরঙ্গি রে' টাইপের নাচ যে আসতে চলেছে আমি জানতাম, আমি বাবাকে উইংসে নাচতে দেখেছি সেদিন, রাগে।
আরও পড়ুন- বাবা বলেছিল, এই দুঃখটা কখনও ভুলবি না
হদ্দ গ্রামে শো। লাইটের রিকোয়ারমেন্ট শুনে হাসতে হাসতে চারটে হ্যাজাক জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে লোকে। সেখানে আমরা করছি, 'প্রসঙ্গ রুগ্নশিল্প'। নলিনকাকুর রোল আকবরের। একজন লক আউট হওয়া মুসলিম কর্মচারী। প্রথম দৃশ্যে চাকরি পেয়ে মলিনকাকু নকল দাড়ি চোমড়ালেন, দ্বিতীয় দৃশ্যে চাকরি যাওয়ার দুঃখে। ব্যাস হয়ে গেল! দৃশ্য এগোয়, শ্রমিকদের কষ্ট বাড়ে, আমাদের দুশ্চিন্তা আর নলিন কাকুর দাড়িও! শেষ দৃশ্যে ইচ্ছাশক্তিতে ঝুলছিল। এছাড়া ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনও কারণ নেই। বিচারকেরা বারবার প্রশংসা করেন, আকবরের দাড়ি যেভাবে বেড়েছে গল্পের সঙ্গে!
শীর্ষেন্দুদের পাড়ায় লাশ ঘুইর্যা যাউকের দ্বিতীয় শো। নলিনকাকুর হাত থেকে মারপিট করতে গিয়ে ছুরি ছিটকে দর্শকের মাঝে! আর দর্শক মানে এই ধরনের শো-তে একদম সামনে ত্রিপল পাতা থাকে, যেখানে বাচ্চারা বসে থাকে, তা সে যত কঠিন নাটকই হোক। তাদের সামনে গিয়ে পড়েছে নলিন কাকুর ছুরি! তারা ওটা নিয়ে খেলছে, নলিনকাকুর ডায়লগ মাথায়! সোজা বলতে শুরু করল, "এই ফেরত দে, খেলিস না..." বাচ্চারা নলিনকাকুকে ছুরি ফেরত পাঠিয়েছিল আর বিচারকরা আমাদের দলকে। সেদিন নলিনকাকু সেটের সব দায়িত্ব দীপ কাকুকে দিয়ে পালিয়েছিল। বাবা দেখলে যদি মেরে ফেলে সেই ভয় আর দলকে ডোবানোর কষ্টে মিলিয়ে যেতে চেয়েছিল নলিনকাকু কুয়াশায়। হেরে যাওয়া মানুষরা যেমন যায়।
আরও পড়ুন- হাতকাটা দুঃখরা ফুলহাতা হয় শীতেই, খোসা ছেড়ে আসে কমলালেবু, না হওয়া প্রেমরা…
আর বিপদ সত্যি বলতে নলিনকাকুকে তাড়া করত। বাড়িতে ফিস্ট, মাংস ভাত খেয়ে আমরা ছোটরা ঘুম আর বড়দের হই হল্লা চলেছে, তারপর তারা ফিরেও গেছে। পরেরদিন নলিনকাকুকে পাওয়া গেল পিসির ঘরে ঘুমোচ্ছে, হাতে হুড়কো! বিষয় আর কিছুই না, নলিনকাকু যখন বাথরুম থেকে ফিরছিল, আমার ছোট পিসি যিনি একজন স্পেশাল চাইল্ড ছিলেন, তিনি নলিনকাকুকে পাকড়াও করেছেন। যদিও আমার পিসি নলিনকাকুর চেয়ে অনেক বড় কিন্তু আমাদের দেখাদেখি পিসিও নলিনকাকুই ডাকতেন। পিসি তখন মশারির তিন দিক টাঙিয়ে ফেলেছেন,বাকি একদিক টাঙাতে না পেরে সেটা দরজার হুড়কোতে লাগিয়েছেন। হুড়কোই বা শুনবে কেন? পিসি সরে গেলেই সে পড়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় দৃশ্যে নলিনকাকুর আগমন এবং পিসির হাতে জবরদখল! নলিনকাকুর হাতে হুড়কো ধরিয়ে মশারি গুঁজে পিসি ফর্সা! নলিনকাকু যতবার হুড়কো নামাতে যায় বালিশ থেকে কঁকিয়ে ওঠে পিসি। এই চলতে চলতে ঘুম। তবে জীবনের কোনও কিছুই ফেলা যায় না, নলিনকাকুর প্রহরীগিরিও যায়নি।
থিয়েটার সেন্টার ছিল খুব সম্ভ্রান্ত প্রতিযোগিতার জায়গা। কলকাতার হৃদয়ে অবস্থিত জায়গায়। সেখানে আমরা করলাম 'আখের স্বাদ নোনতা'। কিউবা নিয়ে অনবদ্য কাজ। নলিনকাকুকে কোনও টকি রোল দেওয়া গেল না, বডিগার্ড। পুরো নাটক দাঁড়িয়ে থাকা। বাকিরা ভালো পার্ট। নাটকের শেষে ভিড়! নাহ, ভালো পার্ট করা কাউকে দেখার জন্য নয়। সবাই বডিগার্ডকে দেখবে, যার পলক পড়েনি। সত্যি সেদিন নলিনকাকু অবিশ্বাস্য কাজ করেছিল। এক ঘণ্টার নাটকে সেপাই সেজে হাতে স্টেনগান নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, প্রস্তরীভূত হয়ে যাকে বলে। না বললে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। নলিনকাকু তো এত প্রশংসায় অবাক। তারপর খুব লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেল।
সেদিন সেট গুছিয়ে নলিনকাকু বলেছিল, "আমি আজ একটু একলা হাঁটি বিশুদা?"
তারপর, অনুমতি পেয়ে কুয়াশায় মিলিয়ে গেছিল। যেভাবে একজন নক্ষত্র যায়।