এসআইআর শেষে বিহারের চূড়ান্ত ভোটার লিস্ট: অজস্র অসঙ্গতির উত্তর নেই
SIR: এইসব গোঁজামিল, অসম্পূর্ণতা ছাড়াও বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় এমন কিছু আছে যাকে কাকতালীয় বলে মেনে নেওয়া মুশকিল। এই এসআইআর নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্ক দানা বেঁধেছে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া (deletion) নিয়ে।
বিহারে বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর)-এর কাজ চারমাসের বেশি সময় ধরে চলার পর প্রকাশিত হয়েছে চূড়ান্ত ভোটার লিস্ট। এসআইআর নিয়ে চলমান বিতর্ক অবশ্য শেষ হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত নেই, এই পরিস্থিতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই নিয়ে চলা মামলাটি। চূড়ান্ত ভোটার লিস্ট প্রকাশ করতে গিয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন যে বাইশ বছর পরে বিহারের ভোটার লিস্ট পরিশোধিত (purified) হলো। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ২৪৩টি আসন বিশিষ্ট বিহার বিধানসভার নির্বাচন এই 'পরিশুদ্ধ' তালিকা মেনেই হবে। বর্তমান নিবন্ধে আমরা দেখব সঠিক ভোটার লিস্টের দাবি কতখানি সত্য!
বিহারে এসআইআর পর্ব চালু হওয়ার সময় থেকেই একাধিক অসঙ্গতি, বিএলওদের কাজকর্ম নিয়ে অস্বচ্ছতা এবং খসড়া ভোটার লিস্টে নানান ধরণের কারচুপির অভিযোগ উঠছিল। বিহারের চিফ ইলেকটোরাল অফিসার খসড়ায় ভুলের কথা স্বীকার করে নিয়ে জানিয়েছিলেন, চূড়ান্ত তালিকায় এই সমস্ত গরমিলগুলো সংশোধন করে নেওয়া হবে। আজ যখন চূড়ান্ত ভোটার লিস্ট প্রকাশিত হয়েছে তখন সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে রিপোটার্স কালেকটিভ (Tne Mess called, ECI's Final Voter List in Bihar/ oct 6,2025) এক জরুরি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যা নির্বাচন কমিশনের বাগাড়ম্বরকে ভুল প্রমাণ করছে। স্বচ্ছতার স্বার্থে এই তথ্যগুলো সবার জানা দরকার।
আরও পড়ুন- ‘ভোট চুরি’ বা এসআইআর! নির্বাচন কমিশনের সেম-সাইড গোল?
রিপোটার্স কালেকটিভ এর প্রতিবেদন অনুসারে :
• বিহারের চূড়ান্ত ভোটার লিস্টে ১৪.৩৫ লক্ষ ভোটারের নাম রয়েছে যারা সম্ভাব্য ডুপ্লিকেট ভোটার।
• এদের একই নাম,আত্মীয়ের নামও এক এবং বয়সের পার্থক্য ০-৫ বছর।
• ১৪.৩৫ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ৩.৪২ লক্ষ ডুপ্লিকেট ভোটারের দুটো পরিচয়পত্রে একই বয়স রয়েছে।
• বেশ কয়েক হাজার এমন ভোটার আছেন যাদের নামে তিনটি সচিত্র পরিচয়পত্র (এপিক কার্ড) রয়েছে।
• ১.৩২ কোটি ভোটারের ঠিকানা সন্দেহজনক।এক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে গৃহহীন বা অরেজিস্ট্রি কৃত ঠিকানায় থাকা মানুষদের জন্য নির্বাচন কমিশন যে বিশেষ ধরণের ঠিকানা (Notional Address) দেয়, এগুলো সেই ধরণের নয়। এরকম একটা উদাহরণ পিপড়া বিধানসভা কেন্দ্র। এখানে ৫০৫ জন মানুষ যাদের পরিবার, জাত, সম্প্রদায় আলাদা, তাদের একটা ভুয়ো ঠিকানায় নথিবদ্ধ করা হয়েছে।
• বাল্মিকীনগর বিধানসভা কেন্দ্রে ৫০০০ ভোটারের নাম রয়েছে যাদের নাম আবার পার্শ্ববর্তী উত্তরপ্রদেশের এক বিধানসভায় নথিবদ্ধ রয়েছে।
• বিহার বিধানসভার তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে (পিপড়া, বাগহা ও মোতিহারি) ৮০,০০০ ভোটার ভুয়ো ঠিকানায় নথিভুক্ত।
• অভিযোগ রয়েছে ৮০,০০০ মুসলিম ভোটারের নাম বাদ দেওয়ার।
• বরাচট্টি বিধানসভা কেন্দ্রে একটি বাড়ির নম্বর ৬, যেখানে ৮৭৭ জন ভোটারের নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে। পারশা বিধানসভা কেন্দ্রে একটি বাড়ির নম্বর ২৩ যেখানে ৮৫৩টি ভোটার রয়েছেন।
• প্রতিবেদনে মৃত লোকদের নাম ভোটার তালিকায় রেখে দেওয়ার অজস্র উদাহরণ রয়েছে।
আরও পড়ুন- কেন ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন সন্দেহজনক?
সমাজতাত্ত্বিক তথা গবেষক যোগেন্দ্র যাদব ৯ অক্টোবর (২০২৫) দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এসআইআর নিয়ে চলা মামলায় বিহারের চূড়ান্ত ভোটার লিস্ট নিয়ে এক উপস্থাপনা করেছেন যা নির্বাচন কমিশনের কাজকর্ম নিয়ে একাধিক সন্দেহের অবকাশ তৈরি করেছে—
• যোগেন্দ্র যাদব দেখিয়েছেন নিখোঁজ ভোটারের তালিকা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে এসএসআর (স্পেশাল সামারি রিভিশন) হওয়ার পরে নথিভুক্ত ভোটার নয় এমন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ যা এসআইআরের পর বেড়ে হল ৮১ লাখ।
• এই না মেলা ভোটারদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা জানুয়ারি (২০২৫) মাসে ছিল ৭ লাখ, এসআইআরের পর তা বেড়ে হলো ১৬ লাখ। ২০২০ সালের পর এই প্রথম বিহারে প্রতি ১০০০ পুরুষ ভোটার পিছু মহিলা ভোটারের অনুপাত হলো ৯০০-র কম, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
• ভোটারের পরিচিতি ভুল, এমন সংখ্যা যোগেন্দ্র যাদবের হিসাব অনুসারে ৫,১৭,২১৬। এর মধ্যে নামের ভুল ২৫,৪৩২ জনের, আত্মীয়ের সম্পর্ক ভুল ৫৭,৭৫১ জনের, বাতিল এপিক নম্বর ৩,৭৪২ জনের, বয়স ১৮-র কম বা অস্বাভাবিক কোন সংখ্যা ১১,৬০৪ জনের, সিরিয়াল নম্বর নেই ১,৮৫৮ জনের, বাড়ির নম্বর শূন্য বা অবাস্তব সংখ্যা ৪,২১,২১৬ জনের, লিঙ্গ পরিচিতি ভুল ৩,৬৯৯ জনের।
• এই উপস্থাপনার সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো ডুপ্লিকেট এপিকধারীর সংখ্যা খসড়া তালিকায় যত ছিল, চূড়ান্ত তালিকায় তার থেকে বেশি হয়েছে। অগাস্ট ২০২৫ খসড়াতে একই বিধানসভার অন্তর্গত দুটো এপিক আছে এমন সংখ্যা ছিল ৪,৯০,৯৫৪— যা চূড়ান্ত তালিকায় বেড়ে হয়েছে ৫,২৪,২১০। আর সব বিধানসভার নিরিখে অগাস্টে সংখ্যাটা ছিল ৫৯,৩৫,৮০১— যা চূড়ান্ত তালিকায় বেড়ে হয়েছে ৬৩,০৮,৭৭৭।
• ভোটার তালিকায় যে নতুন ভোটারদের নাম নথিভুক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে ৬১-৮০ বছরের মধ্যে আছে ৭২,৭৩২। ৮০-১০০ বছরের মধ্যে ৬,২১৮ ভোটার, ১০০-১১৮ এর মধ্যে ৯৬। এমনকি ১১৮ বছরের বেশি বয়স, এমন নতুন ভোটারের সংখ্যা ১৯।
আরও পড়ুন- কেন বিহারের ভোটার তালিকায় ‘নিবিড় সংশোধন’ নিয়ে বিতর্ক?
এইসব গোঁজামিল, অসম্পূর্ণতা ছাড়াও বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় এমন কিছু আছে যাকে কাকতালীয় বলে মেনে নেওয়া মুশকিল। এই এসআইআর নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্ক দানা বেঁধেছে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া (deletion) নিয়ে। সেই বাদের ধরণ, সংখ্যা, গড়, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের (মুসলিম) বাদ পড়ার প্যাটার্ন নিয়ে আলোচনা জরুরি। আমরা সবাই জানি, ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি সহ নীতিশকুমারের এনডিএ জোট পায় ১২৫টি আসন এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দল, জাতীয় কংগ্রেস, সংসদীয় বাম দলগুলোর জোট মহাগাঁটবন্ধন পায় ১১০টি আসন। এবারে চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় দেখা যাচ্ছে এনডিএ জোটের আসনগুলোতে গড়ে বাদ পড়ার সংখ্যা ১৩৪০ কিন্তু মহাগাঁটবন্ধনের জেতা আসনগুলোতে গড়ে ভোটার বাদ পড়ার সংখ্যা ১৫৪৮। আসন পিছু মুসলিমদের বাদ পড়ার সংখ্যা এনডিএ জোটের আসনগুলিতে ২২৪ (১৬.৭%) অথচ মহাগাঁটবন্ধনের জেতা আসনগুলোতে মুসলিমদের বাদ পড়ার সংখ্যা গড়ে ৪১২(২৭.২%)। আবার যদি অঞ্চলভেদে হিসাব করা যায় যেমন সীমাঞ্চল (আসন সংখ্যা ২৪) যা কংগ্রেস ও আরজেডির গড় হিসাবে চিহ্নিত, সেখানে আসন পিছু বিয়োজন গড়ে ২,৭৩৫ এবং মুসলিমদের ক্ষেত্রে গড়ে ১,৩৮৮। অথচ বিজেপির শক্তিশালী ক্ষেত্র মগধে (৪৪ আসন) আসন পিছু গড় বিয়োজন ১১৭৬ এবং মুসলিমদের ক্ষেত্রে গড়ে মাত্র ১৭৯। বিজেপির আরেক ঘাঁটি ত্রিহুত অঞ্চল (৫৩ আসন) সংখ্যাটা যথাক্রমে ১২২১ এবং ২২৮। আবার গতবারে দলভিত্তিক জেতা আসনের যদি বিচার করা যায় তবে দেখা যাবে রাষ্ট্রীয় জনতা দল (জেতা আসন ৭৫)-এর আসনগুলোতে গড় বিয়োজন ১৬৪৩, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (জেতা আসন ১৯)-এর আসনগুলোতে গড় বিয়োজন ১৭২৭, যা সবচেয়ে বেশি। এনডিএ জোটের বড় শরিক বিজেপি (জেতা আসন ৭৪)-এর গড় বিয়োজন মাত্র ১২৮৯, নীতিশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড (জেতা আসন ৪৩)-এর ক্ষেত্রে গড় বিয়োজন মাত্র ১৩৫৩। এর থেকে এটা স্পষ্ট যে এসআইআরের মাধ্যমে ভোটার বাদ দেওয়ার প্রভাব সবচেয়ে বেশি হবে মহাগাঁটবন্ধনের দলগুলোর ক্ষেত্রে।
এই সামগ্রিক পরিসংখ্যান ভিত্তিক আলোচনার শেষে এটা স্পষ্ট যে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অজস্র ত্রুটিযুক্ত। তাহলে এত ঢক্কা নিনাদ করে, মানুষকে নথিপত্রের জন্য উত্যক্ত করে, চারমাসের মধ্যে তৈরি করা এই এসআইআর নির্ভুল না করতে পারার দায় কার? মূল বিষয়টা হলো রাজনৈতিক, যা আদতে এসআইআরকে সামনে রেখে এনআরসির প্রস্তুতি নেওয়া। সবচেয়ে বড় কথা হলো বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গার ভূত দেখানো কেন্দ্রের শাসকদল ও তথাকথিত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন সরকারি ভাবে বিহারে কতজন বিদেশির নাম বাদ পড়ল, তাদের পরিচয় কি— সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে অস্বীকার করেছে। করদাতাদের পয়সায় এই বিপুল যজ্ঞের পরে আজ নাগরিকদের এই এসআইআর করার আসল উদ্দেশ্যকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।

Whatsapp
