ভারতীয়দের তথ্য হাতিয়ে চড়া দামে বিক্রি! কোন 'ষড়যন্ত্রের' আভাস দিচ্ছে চ্যাটজিপিটি?
ChatGPT Accounts Hacked: চ্যাটজিপিটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি তথ্য চুরি হয়েছে যে দেশ থেকে, তার নাম ভারত।
লক্ষ রোগের এক মলম। না, বোরোলিন নয়। তবে ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে তাকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ এআই বলতেই পারেন নির্দ্বিধায়। এআইয়ের মাধ্যমে কী না সম্ভব? বিংশ শতাব্দীতে বসে লিখে ফেলা যায় নতুন বাইবেল। কিংবা পঞ্চাশ বছর আগে মৃত গায়ককে দিয়ে গাইয়ে ফেলা যায় আনকোরা নতুন গান। যে কোনও সময় এঁকে ফেলা যায় যা খুশি ছবি, মনের মতো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এমন অনেক কিছুই সম্ভব, যা ভাবনার বাইরে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে ২০২২ সালে ঘটে গিয়েছে এক বিপ্লব। সানফ্রান্সিকোর সংস্থা ওপেনএআই নিয়ে এসেছে এমন এক চ্যাটবট পরিষেবা, যা বদলে দিয়েছে দুনিয়ার সমস্ত সমীকরণই। আপনার সব প্রশ্নের জবাব রয়েছে তার কাছে। লঞ্চ হওয়ার দিন কয়েকের মাথায় দশ লক্ষ মানুষ ব্যবহার করেছেন পরিষেবাটি। মাত্র দু'বছরের মাথায় ছাপিয়ে গিয়েছে দশ কোটি ইউজারের সীমা। এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ এতদিনে সকলেরই জানা হয়ে গিয়েছে। চ্যাটজিপিটি পারে না, এমন কাজ দুনিয়ায় নেই। বোতল থেকে বের হওয়া জিন যেন! শুধুমাত্র প্রশ্ন পাওয়ার অপেক্ষা। আপনার এক নির্দেশে সে কষে দিতে পারে পৃথিবীর সমস্ত জটিল অঙ্ক। লিখে দিতে পারে তাক লাগানো কোড। এখানেই শেষ নয়। আপনার সৃষ্টিশীলতার বারোটা বাজিয়ে আপনার জন্য লিখে দেবে তুখোড় সাহিত্যও। কবিতা, গল্প, উপন্যাস বাদ যাবে না কোনওটাই। চতুর্দশপদী কবিতা হোক বা শেকসপিয়রীয় ভঙ্গিতে নাটক, সব কিছুই চোখের পলক ফেলতেই লিখে দিতে পারে চ্যাটজিপিটি।
স্বাভাবিক ভাবেই চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েছে। আরও আধুনিক ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল জিপিটিফোর চ্যাটজিপিটিকে করে তুলেছে আরও বাহুবলী। জিপিটি-থ্রি ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের ভার্সনটি সকলের জন্য অবারিত করে রেখেছিল ওপেনএআই। কিন্তু জিপিটিফোর মডেলটি আর তেমন রইল না। শুধু প্লাস সদস্যদের জন্যই বেঁধে দেওয়া হল সেই পরিষেবা। অর্থাৎ চ্যাটজিপিটির আরও আধুনিক পরিষেবা পেতে গুনতে হবে এবার ট্যাঁকের কড়ি। সানফ্রান্সিসকোর সংস্থা ওপেনএআই তাদের পথচলা শুরু করে ২০১৫ সালে। মূলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়েই তাদের কাজ। জন্মলগ্নে পাশে ছিলেন টেসলা প্রধান ইলন মাস্ক। পরে অবশ্য ওপেনএআই থেকে নিজেই সরে আসেন ইলন। ২০২২ সালের শেষের দিকে আত্মপ্রকাশ করে ওপেনএআইয়ের চ্যাটবট পরিষেবা চ্যাটজিপিটি। আর গোটা পৃথিবীটাকে উল্টেপাল্টে দেয় একনিমেষে। গোড়া থেকে ওপেনএআই-এ বিনিয়োগ করেছিল মাইক্রোসফট। যার ফলে মাইক্রোসফটের সার্চ ইঞ্জিন বিং-য়ের সঙ্গে অচিরেই জুড়়ে গেল চ্যাটজিপিটি। প্রতিযোগিতা টের পেয়ে ময়দানে নামল গুগলও। ইতিমধ্যেই তারা নিজস্ব চ্যাটবট পরিষেবা 'বার্ড' আনতে উঠেপড়ে লেগেছে। পিছিয়ে নেই ইলন নিজেও। একদল এআই গবেষকদের নিয়ে তিনি ইতিমধ্যেই গড়ে ফেলেছেন একটি বিশেষ দল। খরচ করে বানাতে চলেছেন একটি এআই ল্যাবও। যেখানে একদিন জন্মাবে চ্যাটজিপিটির যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী।
আরও পড়ুন: চাকরির বাজারে বাতিল মানুষ! ৫ বছরে চাকরি যাবে কাদের, ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এল সমীক্ষায়
এদিকে চ্যাটজিপিটি-এর এই দুর্দান্ত কার্যকারিতা কিন্তু ভাঁজ ফেলেছে বিশেষজ্ঞদের কপালে। গোড়াতেই অনেকে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন, অদূর ভবিষ্য়তে মানুষের বহু পেশাই খেতে চলেছে এই এআই পরিষেবা। মানুষের বহু কাজই সেরে দেবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। তার জন্য আর দরকার হবে না মানুষের। ফলে জীবিকাহীন হয়ে পড়বেন অনেকেই। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলার লাইভ ট্রান্সমিশন সম্ভব হয়েছে এআই টুলের মাধ্যমে। এত বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও মানুষ নয়, কোর্টের যাবতীয় কথাবার্তা, মামলার শুনানির অডিও লিখিত আকারে নথিভুক্ত করেছে এআই টুল। কবি-লেখকদেরও বিকল্প হয়ে উঠতে পারে চ্যাটজিপিটির মতো এমন দুর্দান্ত 'স্মার্ট' এআই চ্যাটবট। শুধু কি চাকরি খাওয়ার ভয়! পাশাপাশি চ্যাটজিপিটির সাহায্য় নিয়ে পড়াশোনাতেও বিস্তর ফাঁকি দিতে পারে পড়ুয়ামহল। এমন আশঙ্কাও করেছেন অভিজ্ঞরা। অঙ্ক হোক বা স্কুলের রচনার হোমটাস্ক, সে-ও তো এক নিমেষে সেরে দেবে চ্যাটজিপিটি। এই সুযোগে বাড়বে কুম্ভীলক বৃত্তি। মানুষের সৃষ্টিশীলতা ডকে উঠবে সেই আশঙ্কা তো রয়েইছে।
প্রযুক্তির সাহায্যে যত বলবান, যত আধুনিক হয়েছে মানুষ, তার সঙ্গে সে জড়িয়ে নিয়েছে আনুষাঙ্গিক বিপদও। ইন্টারনেটের ব্যবহার মানুষের সামনে খুলে দিয়েছিল নতুন দিগন্ত। স্মার্টফোনের সাহায্যে দুনিয়া আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। এক ক্লিকে সম্ভব ব্যাঙ্ক থেকে বাজার, খাবার থেকে আসবাব। অতিমারি পরবর্তীকালে সেই নির্ভরতা বেড়েছে কয়েকগুণ। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই বেড়েছে সাইবার হামলার মতো সমস্যাও। চ্যাটজিপিটির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা কিছুমাত্র আলাদা নয়। প্রযুক্তির দুনিয়ায় যুগান্তকারী আবিষ্কার চ্যাটজিপিটি। ২০২২ সাল পরবর্তী পৃথিবীর উপরে বিশাল বড় প্রভাব থাকতে চলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। এমন আশঙ্কা অবশ্য আজকের নয়। চাকরি কেড়ে নেওয়া, সৃষ্টিশীলতা নষ্ট করে দেওয়ার পাশাপাশি সম্প্রতি চ্যাটজিপিটির আরও একটি ভয়ঙ্কর রূপ ধরা পড়েছে।
সম্প্রতি জানা গিয়েছে, চ্যাটজিপিটির প্রায় ১ লক্ষ ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেছে সাইবার অপরাধীরা। চ্যাটবট পরিষেবা, তা-ও আবার হ্যাকারদের দখলে! এ-ও আবার হয় নাকি? আসলে প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, যতই বাড়ানো হচ্ছে নিরাপত্তা, ততই নতুন নতুন ফাঁক খুঁজে বের করছে হ্যাকাররা। তবে চ্যাটজিপিটির ক্ষেত্রে ব্যাপারটি অপ্রত্যাশিত কারণ গোড়া থেকেই ওপেনএআই দাবি করেছিল, চ্যাটজিপিটি-তে সাইবার হামলার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। সেভাবেই ব্যাপারটিকে তৈরি করেছে সংস্থাটি। তবে যা হওয়ার নয়, তাই ঘটে। 'আনসিঙ্কেবল' জাহাজ টাইটানিকও ডোবে। সিঙ্গাপুরের একটি সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা অন্তত ১,০১,১৩৪টি হ্যাকড ডিভাইস চিহ্নিত করেছে, যেখানে চ্যাটজিপিটির ক্রেডেনশিয়াল সেভ করা রয়েছে। ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য। আর সেসব ডার্কওয়েবে বিক্রি হয়েছে চড়া দামে।
রিপোর্ট বলছে, চলতি বছরের মে মাসে তথ্যচুরির হার ছিল সবচেয়ে বেশি। সিঙ্গাপুরের ওই সাইবার নিরাপত্তা সংস্থার থ্রেট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দাবি, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে। অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়া দেশের তালিকায় রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপও। তবে আপনাকে অবাক করবে যে তথ্য, তা হল চ্যাটজিপিটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি তথ্য চুরি হয়েছে যে দেশ থেকে, তার নাম ভারত। তার পরে তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান, তার পর ব্রাজিল এবং তার পরেই বাংলাদেশ। আর এ কাজ শুরু হয়েছে বহু দিন আগে থেকেই। যে সময় চ্যাটজিপিটি লঞ্চ পর্যন্ত হয়নি, তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ডেটা-চুরির কারনামা। সম্ভবত বেটা ইউজাররাও রেহাই পাননি সেই বিপদ থেকে। সিঙ্গাপুরের ওই সংস্থার রিপোর্টেই জানানো হয়েছে, ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত হরদম চলেছে ডেটা চুরি। কিন্তু অবাক করা বিষয়, ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর দুনিয়ার সামনে আত্মপ্রকাশ করে চ্যাটজিপিটি। হ্যাক হওয়া যেসব অ্যাকাউন্টের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তথ্য ডার্কওয়েবে বিক্রি হয়েছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলগুলি থেকেই।
গত কয়েক মাসে হু হু করে বেড়েছে চ্যাটজিপিটির জনপ্রিয়তা। প্রায় সকলেই ছোটো-বড় নানা কাজে ব্য়বহার করছেন চ্যাটজিপিটি। চোখের নিমেষ ফেলার আগেই সমাধান এনে হাজির করছে ওপেনএআইয়রে এই তাজ্জব আবিষ্কার। লেখালিখি থেকে সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট, এমনকী ব্যবসায়িক কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে এই চ্যাটজিপিটি। জানা গিয়েছে, ব্যবহারকারীর প্রশ্ন ও এআইয়ের দেওয়া উত্তরের যে কথোপকথন, তা সেভ করে রাখছে চ্যাটবটটি। কার্যত তা হয়তো করা হচ্ছে, পরবর্তীকালে আরও ভালো পরিষেবা দেওয়ার জন্যই। তবে সেই সুযোগটাই ব্যবহার করছে সাইবার অপরাধীরা। বেআইনি ভাবে তারা ঢুকে হাতিয়ে নিচ্ছে নানা তথ্য। যা পরবর্তীকালে কোনও সংস্থা বা তাঁর কর্মীদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হবে না, তা কিন্তু হলফ করে বলা যায় না।
আর এই কাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে 'ইনফো স্টিলার্স' নামে এক ধরনের ম্যালওয়্যার। কীভাবে কাজ করে এই ম্যালওয়্যারটি? কোনও একটি ব্রাউজারের মধ্যে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করে এটি। কুকিজ, ব্রাউজিং হিস্ট্রি, ব্যাঙ্ক কার্ডের তথ্য বা ক্রিপ্টো ওয়ালেটস তথ্যের মতো অনেক সংবেদনশীল তথ্যই বেহাত হয়ে যেতে পারে এর মাধ্যমে। এমনকী ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জার বা ই-মেইল থেকেও এইসব ডেটাচুরি করতে সক্ষম এই ধরনের ম্যালওয়্যার। বর্তমানে এই ধরনের তথ্যচুরির জন্য হ্যাকারদের ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে উঠেছে এই 'ইনফো স্টিলার্স'। আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ও সাইবার অপরাধদমন শাখার জন্য ত্রাস।
আরও পড়ুন: ২০২৪ সালে আপনি কাকে ভোট দেবেন, গোপন তথ্য আগেভাগেই বলে দিচ্ছে চ্যাটজিপিটি?
যদিও ওপেনএআইয়ের সাফাই, এর জন্য দায়ী যান্ত্রিক ত্রুটিই। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আদৌ কি যান্ত্রিক ত্রুটি, না এর পিছনে রয়েছে আরও বড় কিছু। কেন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির চ্যাটজিপিটি ইউজারদেরই বেছে বেছে নিশানা করছে হ্যাকাররা? নিছকই কাকতালীয় ঘটনা, না এর পিছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র? আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়ার মতো শক্তিশালী দেশগুলিতে হামলার সংখ্যা হাতে গোনা। কোন বলে বেঁচে গেল সেখানকার অ্যাকাউন্টগুলি হ্যাকারদের হাত থেকে। যেখানে চ্যাটজিপিটির ব্যবহার সেই সব দেশে কয়েক গুণ বেশি। তবে কি এর পিছনে রয়েছে আদতে কোনও সাইবার যুদ্ধের আভাস। এই সব প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে 'অসুর' নামে একটি ওয়েব সিরিজের দ্বিতীয় সিজন। বলাই বাহুল্য, প্রবল জনপ্রিয়তাও পেয়েছে সেটি। যেখানে পুরাণের সঙ্গে প্রযুক্তিকে মিশিয়ে একটি ক্রাইম থ্রিলার দর্শকদের সামনে হাজির করেছেন পরিচালক ওনি সেন। সেখানে দেখানো হয়েছে, কলিযুগে অসুরের কীভাবে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রযুক্তি। কীভাবে মানুষের সমস্ত মনুষত্ব, মানবিক বোধগুলিকে হারিয়ে জিতে যাচ্ছে 'কলি' অসুর। আর এই চ্যাটজিপিটি হ্যাকের ঘটনা যেন বারবার সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। এই যে প্রযুক্তির ডানায় ভর করে ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার লাগাতার চেষ্টা করছে মানুষ, তা আদতে আমাদের কোথাও উল্টোদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে না তো!
তবে এ রাস্তায় একবার বেরিয়ে পড়লে ফেরা মুশকিল। 'মহীনের ঘোড়াগুলি'-র সেই বিখ্যাত গানের লাইনটির মতোই... "ফিরবো বললে ফেরা যায় নাকি পেরিয়েছো দেশ কাল জানো নাকি এ সময়..।" ঠিক তেমনই প্রযুক্তির রাস্তায় আমাদের হাঁটা বাকি আরও অসীম পথ, ফেরার উপায় নেই।