দিঘা-পুরী-দার্জিলিং আর নয়, চেনা ছকের বাইরে সফর সারুন পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা শিমোগায়
Shimoga: চেনা ছকের বাইরে গিয়ে আপনার ভ্রমণ তালিকায় যোগ করুন নদী আর পাহাড়ে ঘেরা আধো চেনা একটা ছোট্ট শহর শিমোগা।
পর্বত কিংবা সমুদ্রের হাতছানি এড়িয়ে যাওয়া যে কোনও ভ্রমণপ্রেমীর পক্ষে অসম্ভব। আর কথায় আছে, ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি। কিছুদিন আগেই শেষ হলো দুর্গাপুজো। সকলেরই মনখারাপ, কারণ পুজো শেষ। কিন্তু তাতে কি এক পুজো শেষ হয়ে আরেক পুজো আসতেও বেশি বাকি নেই। সামনেই কালীপুজো। এই পুজোর মরশুমে কংক্রিটের জঙ্গল এড়িয়ে কয়েকটা দিন অন্যরকম কাটাতে কার না ভালো লাগে! দী-পু-দা তো অনেক হলো, এবছর না হয় কিছু অন্যরকম হোক। চেনা ছকের বাইরে গিয়ে আপনার ভ্রমণ তালিকায় যোগ করুন নদী আর পাহাড়ে ঘেরা আধো চেনা একটা ছোট্ট শহর শিমোগা।
ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের সুন্দর রাজ্য কর্নাটকের পশ্চিম প্রান্তে ছোট্ট শহর শিমোগা, আয়তনে সত্তর বর্গকিলোমিটার, ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫৭০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। জেলার নামও শহরের নামেই। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় তার ছবির মতো নিসর্গ শোভা নিয়ে, প্রতিনিয়ত শহরের সারস্বত সাধনার মান উন্নত করে চলেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কুভে বিশ্ববিদ্যালয়, জহরলাল নেহরু কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, শিমোগা ইন্সটিটিউট অফ মেডিকাল সায়েনা। সুন্দর ক্যাম্পাসগুলির একদিকে সুউচ্চ পাহাড়, অন্যদিকে অরণ্য। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, হাতি, এবং চিতাবাঘের স্যাংচুয়ারি। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিহরণ তুলে মাঝেসাঝে দু'-একটি চিতাবাঘের ছানা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও ছিটকে চলে আসে। ক্যাম্পাসগুলি এত বড় যে, গাড়ি-সাইকেল বা বাইক ছাড়া যাতায়াত করা সময় সাপেক্ষ।
শিমোগা-র অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হলো যোগ ফলস, শহর থেকে দূরত্ব একশো কিলোমিটার। এশিয়ার সর্বোচ্চ জলপ্রপাত হিসেবে যোগ ফলসের খ্যাতি। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা পর্যটকদের মুগ্ধ এবং আপ্লুত করবে এই বিশ্বাস নিয়েই ঘুরে আসুন। তবে গাড়ি ছাড়া যাতায়াতের অন্য মাধ্যম নেই, রাস্তার অবস্থাও ভালো নয়। এছাড়াও দর্শনীয় স্থান হিসেবে শিমোগার আকর্ষণ হলো, শিডাপ্পা নায়ক প্যালেস মিউজিয়াম, মাট্ট লেক, সেক্রেড হার্ট ক্যাথিড্রাল চার্চ। জাদুঘরের প্রশস্ত লনে ষোড়শ এবং অষ্টাদশ শতকে তৈরি হওয়া পাথরে কোদাচাদ্রির ভাস্কর্যগুলি সযত্নে রক্ষিত। প্রাকৃতিক শোভা ছাড়াও কুটিরশিল্প, চন্দনকাঠ ও রোজউডের তৈরি বিভিন্ন হ্যান্ডিক্রাফটের জন্য শিমোগা বিখ্যাত। স্মরণিকা হিসেবে এবং উপহার দেওয়ার জন্য সংগ্রহ করতে পারেন ওদের নিজস্ব বিপণি থেকে। ঘাসে ঢাকা সবুজ উপত্যকা, ছোট্ট গ্রাম, আর নাম না-জানা পাখির কলতানের মধ্যে কয়েকদিন হারিয়ে যেতে চাইলে চলে আসুন এই নির্জন শহরে।
কী কী দেখবেন
যোগ জলপ্রপাত
চারটি জলপ্রপাতের সমাহার এই যোগ জলপ্রপাত। ভারতের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। অবস্থান কর্নাটক। বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম জলপ্রপাত। ৮১০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে নীচের উপত্যকায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে সরাবতী নদী। সে এক দেখার মতো দৃশ্য।
স্থানীয়ভাবে এই জলপ্রপাতের নাম জোগাডা গুণ্ডি। পাহাড়ের বুক চিরে যোগ জলপ্রপাত একাধিক জলধারা তৈরি করেছে। এরমধ্যে চারটি প্রধান ধারার নাম; রাজা, রানি, রকেট ও গর্জনকারী বা রোভার। স্পষ্টত, রাজকীয় ও নির্মল জলপতনের জন্য প্রথমটির নাম হয়েছে রাজা। দ্বিতীয়টির পতন দেখে মনে হয়, কোনও সুন্দরী নারী যেন নাচার ছন্দে ছুটে চলতে চলতে পড়ে যাচ্ছে, তাই এর নাম রানি। বিপুল জলরাশি এসে একটি ছোট পথে যেন ভেঙে পড়ছে রকেটের গতিতে, তাই তৃতীয়টির নাম রকেট। জলপতনের প্রচণ্ড শব্দ আর গতি সিংহর কথা মনে করিয়ে দিতে পারে, তাই চতুর্থটির নাম গর্জনকারী। বর্ষাকালে কিংবা বৃষ্টিমুখর দিনে যোগ জলপ্রপাতের রূপ বিশাল ও ভয়ংকর। মনে হয়, এ-সময় হালকা জলীয় বাষ্পে পুরো এলাকা যেন ছেয়ে ফেলে। যোগ জলপ্রপাত দেখার সেরা সময় নিঃসন্দেহে বর্ষাকাল।
কোদাচাদ্রি
ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ঘন বনভূমিতে অবস্থিত পর্বতশৃঙ্গ হলো কোদাচাদ্রি। কর্নাটক সরকার একে হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটি কর্নাটকের ১৩তম সর্বোচ্চ শিখর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪,৪০৬ কিমি উচ্চতায় অবস্থিত এই শৃঙ্গ। এই শৃঙ্গটি নানা ধরনের গাছ, বন্যপ্রাণী এবং ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে এর সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। কোদাচাদ্রি ট্রেকিংয়ের জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এই অঞ্চলে ট্রেকিং করার সময় আপনি সঙ্গী পাবেন মুকাম্বিকা ন্যাশানাল পার্ককে। বর্ষাকাল বাদে বছরের যে কোনও সময় কোদাচাদ্রিতে যেতে পারেন।
তুঙ্গভদ্রা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
শিমোগা-কে প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য বললেও খুব একটা ভুল হয় না। এই অঞ্চলে রয়েছে ভদ্রা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরের এই বনে নানা প্রজাতির জীবজন্তু, পাখি আর প্রজাপতির বাসভূমি। আপনার কপাল ভালো থাকলে বাঘের দেখাও পেতে পারেন।
কেলাদি
কেলাদি গ্রাম তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত। শিমোগা জেলার এই গ্রাম তার বর্ণাঢ্য ইতিহাস আর সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। ইতিহাস বলে, ষোড়শ শতকের কাছাকাছি সময়ে এই অঞ্চল অঞ্চল শাসন করত কেলাদি নায়ক বংশের রাজারা। কেলাদি নায়করা ছিলেন বিজয়নগর রাজবংশের উত্তরসূরি। এই রাজপরিবারের সবথেকে বিখ্যাত রাজা ছিলেন কেলাদি শিভাপ্পা নায়ক। ইতিহাসে আগ্রহ থাকলে একবেলার জন্য ঘুরে আসতে পারেন শিভাপ্পা নায়কের প্রাসাদ। প্রাসাদের কোল ঘেঁষেই সাদা বালিপাথরের জমি, তারই মাঝখান দিয়ে মধ্যবয়সি কাঞ্চী নারীর মতো উদাসীন বয়ে চলেছে তুঙ্গভদ্রা। দোতলায় এই প্রাসাদের দরবার হলের কাঠের কারুকাজ দেখার মতো। বিশাল বিশাল কাঠের স্তম্ভ, জাফরি কাটা বারান্দা আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাস্কর্য-সহ কেলাদিরাজার এই প্রাসাদটি এই অঞ্চলের অন্যতম দর্শনীয় ভ্রমণস্থল।
কর্নাটকের আগুম্বে
কর্নাটকের আগুম্বে নামটি খুব কম লোকেই শুনেছেন। আচ্ছা দূরদর্শনের মালগুলি ডে'জ ধারাবাহিক দেখেছিলেন কি? কিংবা আর. কে. নারায়ণনের "মালগুড়ি ডে'জ" পড়ছেন? সেই নস্টালজিক ধারাবাহিক "মালগুড়ি ডে'জ"-এর শুটিং হয়েছিল এই আগুম্বে গ্রামটিতে। আজও এই গ্রামের সারল্য অটুট রয়েছে। গ্রামটি পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা যায়। এখান আছে আগুম্বে জাতীয় উদ্যান। বর্ষাকালে এর সৌন্দর্য অসাধারণ। কর্নাটকের উদুপি থেকে বাসে করেই যাওয়া যায় আগুম্বে-তে। জাতীয় উদ্যান ছাড়াও এখানকার জঙ্গলে ঘেরা প্রাকৃতিক হ্রদের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যর ভান্ডার হওয়া সত্ত্বেও আগুম্বের জঙ্গল বিশেষ জনপ্রিয় নয়। নরসিমা পর্বত ট্রেকিং-এর জন্য টিকিট বুক করতে হয়। ট্রেকিং-এর সময় সঙ্গে থাকেন প্রশিক্ষিত গাইড।
মুকাম্বিকা বন্যজীবন অভয়ারণ্য
মুকাম্বিকা বন্যজীবন অভয়ারণ্য ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্নাটক রাজ্যের একটি সুরক্ষিত অভয়ারণ্য। এটি জনপ্রিয় কল্লুর মুকাম্বিকা মন্দিরের উপাস্য দেবতা দেবী মুকাম্বিকা-র জন্য। কর্নাটকের উদুপি জেলার পশ্চিমঘাটে এই অভয়ারণ্যটি অবস্থিত। অভয়ারণ্যে বাঘ, চিতা, ঢোলে (বন্য কুকুর), কাঁঠাল, আলগা ভাল্লুক, ভারতীয় বুনো শুয়োর, ভারতীয় বারকোপাইন, সাম্বার, দাগযুক্ত হরিণ, মন্টজ্যাক, হরিণ, গৌড় (ভারতীয় বাইসান), খরগোশ, সিংহ লেজযুক্ত ম্যাকাও, বন্য ম্যাকাও, কাঠবিড়ালি, কিং কোবরা, পাইথন ইত্যাদি বন্য জীবজন্তুর দেখা পাওয়া যায়।
জঙ্গলের ময়না, পিয়াফুল, গ্রেট ইন্ডিয়ান হর্নবিল, মালাবার গ্রে হর্নবিল, হোয়াইট গাল বুলবুল, রেড ভেন্ট বুলবুল, লিটল করমোরেন্ট, কালো রঙের দোঙ্গো, জঙ্গলের কাক, ক্রো ফেরেন্ট, ধূসর জঙ্গল পাখি, মটর পাখি, হোয়াইট ব্রেস্টড কিং ফিশার, গোল্ডেন কাঠঠোকরা, স্কারলেট মিনিভেট, প্যারাডাইজ ফ্লাই ক্যাচার, ম্যাগপি রবিন, টেইলার পাখি, বেগুনি সানবার্ড, হোয়াইট-রোস্পড মুনিয়া, গোল্ডেন ওরিওয়েল পাওয়া যায়।
কর্নাটকের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় এই মুকাম্বিকা অঞ্চলে। প্রাকৃতিক কারণেই এই জঙ্গলের চরিত্র বেশ আলাদা। ঘন জঙ্গল, ছোট্ট ছোট্ট পাথুরে ঝরনা আর ঘাসে ঢাকা এই উপত্যকা বিখ্যাত বিষাক্ত শঙ্খচূড় সাপের জন্য। জঙ্গলের পথে চোখে পড়বে সিংহের মতো লেজবিশিষ্ট ম্যাকাও প্রজাতির বাঁদরদের দৌরাত্ম্য। এই জঙ্গলের বুকে দাঁড়িয়ে পশ্চিমঘাটের বুকে সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে আজীবন।
যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন, তাঁদের জন্যও হরেক পসরা সাজিয়ে রেখেছে এই শিমোগা। আশপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি অসাধারণ ট্রেকিং রুট। অরণ্য, ঘাসজমি আর ছোট ছোট পাহাড়ি ঝরনার পাশ দিয়ে সে পথে হেঁটে যাওয়ার রোমাঞ্চই আলাদা। ওয়াটার স্পোর্টসে আগ্রহ থাকলে দু'-একটা দিনের জন্য ক্যাম্প ফেলতে পারেন হোন্নেমারাডুর ব্যাকওয়াটারের আশপাশে।
কীভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে যশোবন্তপুর এক্সপ্রেস বা অমরাবতী এক্সপ্রেসে কর্নাটক। আর আকাশপথে যেতে চাইলে কলকাতা থেকে ম্যাঙ্গালুরুগামী বিমানে চেপে বসতে পারেন। সেখান থেকে বুক করে রাখা গাড়িতে বেরিয়ে পড়ুন শিমোগা-র উদ্দেশ্যে।