বিপজ্জনক সময়ের দিকে পা বাড়াচ্ছে ভারতীয় গণতন্ত্র
কপিল সিব্বলের মতো নেতারা যদি একের পর এক দল ছাড়তে থাকেন, ২০১৪ সালে যে 'কংগ্রেস-মুক্ত ভারত'-এর কথা মোদি বলেছিলেন, তাই সত্যি হবে। এবং তা হবে ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এক অভিশপ্ত দিন।
সম্প্রতি উদয়পুরে কংগ্রেসের যে চিন্তন শিবির হলো, সেখানে মল্লিকার্জুন খাড়গে বললেন, অন্যান্য দলগুলির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে, যাতে বিজেপি-বিরোধী জোটের সম্ভাবনা জারি থাকে। এই চিন্তন শিবিরের শেষ বক্তা ছিলেন রাহুল গান্ধী। মঞ্চে উঠে তিনি বললেন, স্থানীয় দলগুলি জাতিভিত্তিক রাজনীতি করে, এরা বিজেপিকে হারাতে পারবে না, পারলে কংগ্রেসই পারবে। একথা বলার কি আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা ছিল?
রাহুল গান্ধীর বয়স ৫১ বছর। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। নরেন্দ্র মোদি বারবার পরিবারতন্ত্রর অভিযোগ এনেছেন। অন্যদিকে রাহুল গান্ধী বলেছেন, তিনি পদ চান না, লড়াই করতে চান, তাঁকে বাদ দিয়ে যে কাউকে পদাধিকারী করতে পারে কংগ্রেস।
বাস্তবটা কী, তা যদি রাহুল গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী বুঝতে না পারেন, তাহলে কংগ্রেসের কিছুই করার থাকবে না আর। এই মুহূর্তে একের পর এক নেতা কংগ্রেস ছাড়ছেন। এর মধ্যে কপিল সিব্বল নামকরা আইনজীবী। তিনি রাজ্যসভায় থাকতে চেয়েছেন, সে-ব্যাপারে তাঁকে সমর্থন দিচ্ছে সমাজবাদী পার্টি। কংগ্রেসকে আইনগতভাবে দীর্ঘদিন সাহায্য তো করেইছেন, একই সঙ্গে তিনি সমাজবাদী পার্টির আজম খানেরও পাশে দাঁড়িয়েছেন। কপিল সিব্বলের মতো নেতারা যদি একের পর এক দল ছাড়তে থাকেন, ২০১৪ সালে যে 'কংগ্রেস-মুক্ত ভারত'-এর কথা মোদি বলেছিলেন, তাই সত্যি হবে। এবং তা হবে ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এক অভিশপ্ত দিন। ভারতীয় জনতা পার্টি ছাড়া কংগ্রেসই একমাত্র পার্টি, যাদের অস্তিত্ব ভারতের প্রতিটি রাজ্যে আছে।
আরও পড়ুন: আবার প্রকাশ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ও বিজেপির সম্পর্ক! সামনে আসছে যে চাঞ্চল্যকর তথ্য
ভারতে বহু স্থানীয় দল রয়েছে। একথা ঠিক বলা চলে না যে, তারা প্রত্যেকেই জাতির ভিত্তিতে রাজনীতি করে, বা সেভাবে ক্ষমতায় এসেছে। তামিলনাড়ুর ডিএমকে, অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেস, উড়িষ্যার বিজু জনতা দল, তেলেঙ্গানায় টিআরএস, মহারাষ্ট্রের এনসিপি বা আম আদমি পার্টি (এরা দুটো রাজ্যে ক্ষমতায় আছে)- এই দলগুলো কেবলই জাতিভিত্তিক রাজনীতি করে, এমন অভিযোগ অমূলক। হয়তো উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি বা বিহারের আরজেডি একসময় জাতিনির্ভর রাজনীতি করেছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই বক্তব্য রাখা যায় না আদৌ। কাজেই রাহুল গান্ধী কেন একথা বললেন, সেই যুক্তি আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
কংগ্রেসের বয়স ১৩৭ বছর। ডিসেম্বর, ১৮৮৫ সালে এই দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমরা সকলেই জানি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দল একেবারে সামনে ছিল। কিন্তু সেই কংগ্রেস কি এখন আর আছে? স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস প্রথম ক্ষমতাহীন হয় ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার পরেই। মার্চ '৭৭ থেকে জানুয়ারি ১৯৮০- কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল না। তারপর আবার ১৯৮৯ সালে ক্ষমতা হারায় কংগ্রেস, যখন রাজীব গান্ধীকে সরিয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ ক্ষমতাসীন হলেন। তারপর ১৯৯১ সাল অবধি ক্ষমতায় ছিল না কংগ্রেস। এরপর রাজীব গান্ধী হত্যা ঘটে, নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৬ সালে ফের কুর্সি হারিয়ে মে ২০০৪-এ সরকারে ফিরে আসে কংগ্রেস। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে কংগ্রেস টানা ক্ষমতায় নেই। ভারতের ইতিহাসে প্রথম আট বছরের বেশি ক্ষমতায় নেই কংগ্রেস। কেউ এই আশাও করছে না, আগামী বারেও এই সরকারের পতন হবে বা কংগ্রেস ফিরবে।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পর কিছুদিন, দু'বছরের একটু কম সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তারপরে ক্ষমতায় আসেন ইন্দিরা গান্ধী, তারপর রাজীব গান্ধী। ১৯৯১ সালে নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হলেন, আবার ২০০৪ থেকে টানা দুটো ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় সকলেই বলেছিল, বকলমে সরকার চালান সোনিয়া গান্ধী। ভোটের হার কংগ্রেসের সবচেয়ে বেশি ছিল ১৯৮৪ সালে। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর ভারতের সবচেয়ে কম বয়সি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই নির্বাচনেই অভিষেক ঘটে রাজীব গান্ধীর। সেই নির্বাচনে কংগ্রেসের ছিল ৪৮ শতাংশ ভোট। ২০১৪ সালে সেই ভোটের হার ১৯.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৯-এ তা ০.২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়াল ১৯.৭ শতাংশে। ২০১৪-র নিরিখে আসন বাড়ল আটটি, ৪৪ থেকে ৫২ হলো গোটা দেশে।
এসব নথি কেন প্রয়োজন? একটু সরেজমিনে দেখা যাক। কংগ্রেস আজ নিজের বলে ক্ষমতায় আছে দু'টি রাজ্যে, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ে। মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ও ঝাড়খণ্ডে জোটের অংশ হিসেবে ক্ষমতায় কংগ্রেস। রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়ে ৩১টি বিধানসভার মধ্যে দু'টি এখন কংগ্রেসের, যেখানে এই শতকের শুরুতে অর্ধেক বিধানসভা ছিল কংগ্রেসের দখলে। এই ২২ বছরে কংগ্রেসের অবনতি হয়েছে ক্রমে। ১৯৯১ থেকে '৯৮ পর্যন্ত হওয়া লোকসভা নির্বাচনগুলোতে কংগ্রেস ক্রমে দুর্বল হয়েছিল। ২০০৪ এবং '০৯-এ কংগ্রেসের অবস্থা ফেরে, কিন্তু তা ফের তথৈবচ এখন।
কংগ্রেস কেবলমাত্র একটা রাজনৈতিক দল ছিল না, ভারতে কংগ্রেসকে সবসময়ই বলা হয়েছে একটা 'সিস্টেম'। প্রসিদ্ধ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রজনী কোঠারি 'কংগ্রেস সিস্টেম' শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন প্রথমে। কংগ্রেস যেন একটা বটগাছের মতো, যেখানে বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন শ্রেণির, বিভিন্ন মতবাদ ও চিন্তাধারার লোক একত্রিত হয়েছে। ভারতের যে বিবিধতার চরিত্র, তা মাথায় রেখে বলা হতো, এই একটা পার্টিই পারবে এই দেশ চালাতে, কারণ সেই পার্টির ভেতরেই বিবিধতা রয়েছে। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা-হত্যার পর দিল্লিতে শিখ দাঙ্গা হলো। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ক্রমে ভারতীয় মুসলমানদের একাংশ অন্যান্য দলে চলে গেল কংগ্রেস ছেড়ে। বিগত তিন দশকে কংগ্রেসের যে স্বভাবজাত 'জোট'-চরিত্র, তা দুর্বল হলো।
কংগ্রেস নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছে বারবার, তৈরি করেছে নিজেদেরই অস্তিত্বের সংকট। যদি ধরেও নেওয়া যায়, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের জনপ্রিয়তা তলানিতে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে নানা গোলমাল, কিন্তু নির্বাচনের চার মাস আগে তাঁকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো কেন? নভজ্যোৎ সিং সিধু তো নিজের দলকে নিজেই দুর্বল করলেন। দলের তরফে চরণজিৎ সিং চান্নিকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হলো তিনি মজহাবি শিখ বলে। এও তো এক ধরনের জাতির রাজনীতি! দু'জায়গায় ভোটে দাঁড়িয়ে তিনি দু'টি আসনেই পরাজিত হলেন। এমন স্ববিরোধিতা ও আত্মধ্বংসে মেতে যে দল, তাকে কে বাঁচাবে?
এই মুহূর্তে ভারতে একটি শক্তিশালী বিরোধী অস্তিত্ব দরকার। কারণ দেশের গণতন্ত্র এই আট বছরে এক ব্যাপক অবক্ষয়ের মুখোমুখি হয়েছে, আরও হবে ভবিষ্যতে। সেই গণতন্ত্রকে আমার মতো বরিষ্ঠ নাগরিকরা আর চিনতে পারব না, হয়তো গণতন্ত্রই আর বলা যাবে না একে, একমেরু হয়ে যাবে এই দেশ। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় দলের সঙ্গে জোট না করে কংগ্রেস যদি ঠান্ডা ঘরে বসে রাজনীতি করতে চায় দিল্লির দরবারে, তাহলে ভারতীয় গণতন্ত্র, যাকে কিনা আমরা বলি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র, তা অচিরেই সমূহ সর্বনাশের মুখোমুখি হবে।