শুধুই কি ঘৃণা? মাছে-ভাতে বাঙালিকে যেভাবে রোহিঙ্গা-বাংলাদেশি করে তুললেন পরেশ

Fish and Paresh Rawal: মুখের ভাষা বাংলা হওয়ার ভিত্তিতে অসমে ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালি ও ৫ লক্ষ মুসলমান বাঙালি, মোট ১৭ লক্ষ বাঙালিকে নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

বাংলার হুগলি জেলার রিষড়ার অনেক এলাকায় এখন আর কোনও বাঙালি নেই। সেই রিষড়ায় ২০১৯-এ একটি মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয়েছিল "বঙ্গাল সে বাঙ্গালি হাটাও"। এই স্লোগান শুরু হওয়ার পরে সেই মিছিলেরই পোড়খাওয়া ব্যক্তিরা বার্তা দেন, "বাঙ্গালি নেহি, বাংলাদেশি বোল"। স্লোগান পাল্টে হয়ে যায়, "বঙ্গাল সে বাংলাদেশি হটাও"। সম্পাদনা না করা কাঁচার পরিবর্তে এইটা পাতে দেওয়ার মতো। এবং এইটা পাতে নেওয়ার মতো বাঙালি আজ বাংলায় মজুত। হয়তো ওই সম্পাদনাটাও লাগত না। বাঙালির গর্ভে জন্মে, বাঙালির ঔরসে জন্মে, বাঙালির ঘরে জন্মে বাঙালিকে ঘৃণা করার মন-মানসিকতা তৈরি করা সহজ না। আত্মঘৃণা, স্বজাতিঘৃণা তো কোনও স্বাভাবিক অবস্থা না। তাই ২০২২ সালে যখন গুজরাতে হিন্দি সিনেমা অভিনেতা পরেশ রাওয়াল স্পষ্টভাবে বললেন বাঙালি বলতে তিনি রোহিঙ্গা ও অবৈধ বাংলাদেশি বোঝেন এবং বাঙালির মাছ রান্না যেন গুজরাতে না ছড়ায়, সেই সম্বন্ধে তিনি গুজরাতিদের আসলে প্রকাশ্যে সতর্ক করলেন। সেই নিয়ে শুরু বিতর্ক, আসলে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের দাসত্বে থাকা বাঙালি মননে বলিউড হিন্দি সিনেমার এক পরিচিত মুখ থেকে এই ঘৃণা বর্ষিত হবার কারণে কেবল বিতর্ক নয়, শুধু ঘৃণাটা ফ্যাক্টরই না।

দূরের প্রিয় মানুষ, যার মিম দিয়ে নিজের মনের ভাব বোঝাতে বাঙালিকে অভ্যস্ত করিয়েছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ, যার সিনেমা দেখে বাংলাভাষায় বাঙালিকে দিয়ে রিভিউ লিখিয়েছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ, তাঁর মুখ থেকে হিন্দির একতরফা প্রেমিকা বাঙালি জাতি হঠাৎ যখন আবিষ্কার করে যে সে আসলে ধর্ষিতা এবং শোনে সেই গোপন অট্টহাস্য, যেখানে তাঁর সকল ধর্ষক মিলে বাঙালি জাতির খাদ্য থেকে নাগরিকত্ব, সবকিছুকে অর্থহীন এমনকী বেআইনি করে দিয়েছে, তখন বাঙালি ভাবে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাসের মামলা ঠুকবে সে দিল্লির বিরুদ্ধে। কোন বাঙালি? সবাই না। কারণ কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বলছেন, পরেশ ভুল কী বলেছেন? অর্থাৎ গোদা বাংলায় দাঁড়ায়, মেয়েটারই চরিত্র ঠিক নেই- ধর্ষণ আবার কী! এই আত্মঘৃণা যেমন আগে ছিল না, তেমনই ছিল না আত্মপরিচিতি অর্থাৎ বাঙালি জাতীয় পরিচিতিকে ধারণ করে সচেতন রাজনৈতিক অবস্থান। একাধারে আত্মঘৃণায় ভোগা হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের স্বেচ্ছাদাস হতে চাওয়া বাঙালি, যার কাছে বাঙালিত্ব হল হিন্দি বলয় অর্থাৎ ভারতীয়ত্বের মূলধারায় বিলীন হওয়ার পথে অন্তরায়, অন্যদিকে রয়েছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদকে সাম্রাজ্যবাদ রূপে চিহ্নিত করে ক্রমশঃ বাঙালি জাতি হিসেবে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ভাবে সংগঠিত হয়ে ওঠা বাঙালি। এই দুই ধারা ভারতে বাঙালির রাজনীতিতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ধারা। বাংলার রাজনীতির ভবিষ্যৎ, সে যে দলীয় মোড়কেই হোক না কেন, তাতে যুযুধান হিসেবে এই দু'টি ধারাই থাকতে চলেছে। রিষড়া থেকে পরেশ রাওয়াল- বিভাজনরেখা স্পষ্ট।

আরও পড়ুন-যা বিশাল, বাঙালির কাছে তাই ‘পেল্লায়’! এই শব্দের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে তামিল ভাষা

বাঙালিকে রোহিঙ্গা ও অবৈধ বাংলাদেশি বলা এই ঘৃণা-মন্তব্যের পিছনে বাঙালি সম্বন্ধে যে সুতীব্র ঘৃণা, সেখানে পরেশ রাওয়াল একা নন। মূল বিষয়টা মাছ না, মূল বিষয়টা রোহিঙ্গা না, মূল বিষয় বাঙালির প্রতি ঘৃণা যা খাদ্য ও নাগরিকত্বের মশলা মাখিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে। এমন আরও মশলা রয়েছে। যথা, বাঙালি নারী, বিশেষ করে বিবাহিত হিন্দু বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করার ফ্যান্টাসি যুক্ত ভোজপুরি ভাইরাল 'বিনোদন' বা বাঙালি নারীর মুখে হিন্দি শব্দ বসানো পর্ন, বাংলা জুড়ে বাঙালি-শূন্য এলাকা, পাড়া, স্কুল, হাসপাতাল, কারখানা, শিল্পাঞ্চল, বন্দর, অফিস, রেল, পৌরসভা ইত্যাদি স্থাপন। 'বাঙ্গাল সে বাঙ্গালি হাটাও' - রিষড়ায় মুখ ফস্কে বলে ফেলা ওই স্লোগানের মধ্যে সব কিছু নিহিত আছে। আছে সোনার বাংলাকে বাঙালি-শূন্য শ্মশান বানিয়ে শিয়ালের মতো নিজেকে সেই শ্মশানের ভূমিপুত্র দাবি করে পূর্ণ দখল নেওয়ার লকলকে বাসনা। শ্মশান বলতে মনে পড়ল, রানিগঞ্জে, শিলিগুড়িতে, হাওড়ায়- বাংলার নানা জায়গায় এমন চুল্লি আছে যেখানে হিন্দু বাঙালিকে দাহ করা নিষিদ্ধ। কারণ বাঙালি নোংরা, নিচু, অস্পৃশ্য, মানবেতর। তাই তাদের মালিকানার ইস্কুলে টিফিনে আমিষ নিষিদ্ধ, তাদের মালিকানার হাসপাতালে রোগীর পথ্যে আমিষ নিষিদ্ধ, তাদের মালিকানাধীন কর্মস্থলে আমিষ নিষিদ্ধ এবং তাদের আবাসনে বাঙালি-নিষিদ্ধ, আমিষ নিষিদ্ধ। দুটো একই হল। এমনকী পিজি বা কাজের বিজ্ঞাপন দিয়েও বলা হয়, বাঙালি গণ্য হবে না, তাও প্রকাশ্যে এই পশ্চিমবঙ্গেই! ধরা যাক "কাজে মারাঠিদের নেওয়া হবে না, কর্মস্থল মহারাষ্ট্র" - এমন বিজ্ঞাপন মহারাষ্ট্রে দিলে মারাঠিরা ঠিক কী হাল করতেন?

বিষয়টা খাদ্য ছাড়িয়ে অনেক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বাঙালিকে অবৈধ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা বলা কোনও নিরীহ ইয়ার্কি না। মুখের ভাষা বাংলা হওয়ার ভিত্তিতে অসমে ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালি ও ৫ লক্ষ মুসলমান বাঙালি, মোট ১৭ লক্ষ বাঙালিকে নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। দুই শতাধিক বাঙালি আত্মহত্যা করেছে বাংলাদেশি তকমা পেয়ে বেনাগরিক ঘোষিত হবার উৎকণ্ঠায় - যার মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু বাঙালি। ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক করা হয়েছে হাজার হাজার বাঙালিকে যার মধ্যে অধিকাংশ হিন্দু বাঙালি। 'বাংলাদেশি' তকমা দিয়ে দিল্লি, ইউপি থেকে বেঙ্গালুরু, খেটে খাওয়া বাঙালির বস্তি উচ্ছেদ করা হয়েছে। এই বাংলার পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের জৌগ্রামের বাসিন্দা পলাশ অধিকারী, তাঁর স্ত্রী শুক্লা অধিকারী ও তাঁদের ১৮ মাসের সন্তান আদি অধিকারী এখন কর্ণাটকের জেলে বন্দি - 'বাংলাদেশি' তকমায়। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের ঘটি হিন্দু তপশিলী জাতির বাঙালি গঙ্গাধর প্রামাণিক ৬ বছর অসমের জেলে ছিলেন 'বাংলাদেশি' তকমায়, আদতে তিনি গিয়েছিলেন কামাক্ষ্যার দর্শন করতে। এই বাংলার মাটিতে বড়বাজার থেকে রেলপুলিশ, শিলিগুড়ি থেকে টিটাগড়, সর্বত্র বাঙালিকে রোজ 'বাংলাদেশি' বলা হয় বাংলায় কথা বলার জন্য। ভারতে বাঙালির অধিকার আদায়ের জাতীয় সংগঠন বাংলা পক্ষ নানা জেলায় ঘটা এমন একাধিক ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেছে। 

তবু ফিরি মাছে, অর্থাৎ খাদ্যে। বাঙালি নারীবিরোধী যে বিশাল রেডিট, ফেসবুক, টুইটার সামাজিক মাধ্যমর আছে, সেখানে বাঙালি নারীর 'যোনি থেকে মাছের গন্ধ আসা' থেকে শুরু করে বাঙালি নারীর পাঁঠার মাংসের নলির মজ্জা চুষে খাওয়ার সঙ্গে ইঙ্গিতপূর্ণ যৌন মন্তব্য, এমন অসংখ্য ক্যাজুয়াল জোকস-ঘৃণা জনপ্রিয় হিন্দি-উর্দু পরিসরে। এবং এই ঘৃণায় শিক্ষিত হিন্দি-উর্দুভাষী নারীরাও জড়িত। এরকম একটি বাঙালি-বিদ্বেষী মিম তৈরি সেলের কথা বাংলা পক্ষ ফাঁস করে যাতে জড়িতরা সবাই আইআইটি খড়্গপুরের ছাত্রছাত্রী। নিউটাউনের নারকেল বাগানের পাশে The New Town School- সেখানে আমিষ নিষিদ্ধ৷ বাংলা পক্ষ ডেপুটেশন দিতে গেলে জানানো হয় মালিক ও ডিরেক্টররা শাকাহারী, তাই স্কুলে আমিহ চলবে না। ওম তাঁতিয়ার আইএলএস হাসপাতালে আমিষ পথ্যর অনুমতি নেই। 

শিলিগুড়ির কাছে নকশালবাড়িতে চলতি বছরের অক্টোবরে ঘটে একটি ঘটনা। বহিরাগতদের আক্রমণ, ভেঙে দেওয়া হয় বাঙালি জাতির রাজবংশী সম্প্রদায়ের খাবারের দোকান। বাংলার রাজবংশী সম্প্রদায়ের ভাই অর্জুন বর্মন ও নিতাই রায় একটি অস্থায়ী ফাস্টফুডের দোকান চালাতেন মেইচি নদীর ধারে। সেখানে বহিরাগতরা আমিষ খাবার বিক্রির অজুহাতে দোকানে হামলা চালায়। বাংলার নিজস্ব সকল উৎসবের মেলাতেই আমিষ খাবারের স্টল থাকে অথচ বাংলার মাটিতেই কোথায় বাঙালি কী বেচবে তার অধিকারই হারাচ্ছে। শুধু বাংলায় না, গত কয়েক বছর ধরে গুজরাতে, হরিয়ানায়, দিল্লিতে, উত্তরপ্রদেশে দুর্গাপুজোয় নানা বাঙালি পুজো কমিটিকে আমিষ বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দোকানের কাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ। এইবার পুজোয় খোদ কলকাতার কাছে নিউটাউনে গ্রিন প্যালাজো নামক ফ্ল্যাটের পুজোয় বাঙালির আমিষ খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। আসলে ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে কোটি কোটি বাঙালি-বিদ্বেষী পরেশ রাওয়াল আছেন এবং এটি হিন্দি-দিল্লি কেন্দ্রের রাষ্ট্রীয় নীতি। 

২০১৮ সালে হঠাৎ রেল ঘোষণা করে যে, গান্ধীর জন্মদিন বলে ২ অক্টোবর বাংলায় কোনও ট্রেনে আমিষ খাবার দেওয়া হবেনা। বাংলা পক্ষ খাদ্যের নির্বাচনের অধিকার নিয়ে লড়েছিল সেবারও। বাঙালিকে জোর করে নিরামিষ খেতে বাধ্য করার যে প্রচেষ্টা চলছে, সেই চেষ্টার গলায় যেন মাছের কাঁটা বিঁধে যায়। অধিকার-ঘৃণার লড়াইয়ের গলায় যেন সেই তীব্র মাছের কাঁটা বিঁধে যায়।  

More Articles