দেশজুড়ে অপুষ্টি, অনাহার! দারিদ্র কমার শুকনো পরিসংখ্যান হাসি ফোটাবে ভারতীয়দের মুখে?
Poverty in India: যে দেশের মানুষ অপুষ্টি, অনাহার সঙ্গী করে বেঁচে আছেন, তাঁদের কতটা খুশি করতে পারে শুকনো পরিসংখ্যান?
দারিদ্র হ্রাস নিয়ে কি উল্লাস করার সময় এসেছে? এই নিয়ে কথান্তরে না গিয়েও বলা যায়, পরপর যে রিপোর্ট সামনে এসেছে, তাতে ভারতের পক্ষে শ্লাঘার কারণ আছে। এক, উল্লাসের কারণ, এপ্রিলের বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষা। স্মিতা সিন্হা রায় এবং রয় ভান ডার ওয়েডের করা এই সমীক্ষাটি এপ্রিলে প্রকাশ করেছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। তাতে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ২০১১ সাল থেকে ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে ১২.৩ শতাংশ। এই রিপোর্ট অবশ্যই শ্লাঘার। দুই, ১৭ অক্টোবর রাষ্ট্রসংঘ-র তরফে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ভারতে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষের পরিসংখ্যান নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেই রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ২০০৫-'০৬ সাল থেকে ২০১৯-'২১ এর মধ্যে ভারতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪১৫ মিলিয়ন কমেছে। রাষ্ট্রসংঘ-র তরফে আশা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র দূরীকরণে ভারত বিশ্বের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে।
কী রয়েছে রাষ্ট্রসংঘ-র রিপোর্টে
রাষ্ট্রসংঘ-র ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে একটি প্রতিবেদন করা হয়। সেখানে ভারতের দারিদ্র সূচকের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। ১৭ অক্টোবর সেই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ২০০৫-'০৬ সাল থেকে ২০১৯-'২১ সালের মধ্যে ভারতে দরিদ্র নাগরিকের সংখ্যা ৪১৫ মিলিয়ন কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করে ২০৩০ সালের জানুয়ারির মধ্যে ভারতের দরিদ্র মহিলা, পুরুষ ও শিশুর পরিসংখ্যান অর্ধেক হয়ে যাবে। এই পরিসংখ্যান ভারতের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ঠ ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্রসংঘ একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, ১৫ বছরের মধ্যে ভারতে ৪১৫ মিলিয়ন নাগরিক দারিদ্র থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
এর আগে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষা কী বলেছিল?
আরও পড়ুন: ক্ষুধার প্রশ্নে পাকিস্তান-বাংলাদেশের চেয়েও পিছনে, কেন সত্যিটা মানতে চাইছে না ভারত
বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট
ভারতে দারিদ্র কমছে! এপ্রিলে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষায় এমন আশার কথা উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে দেশে দারিদ্র ১২.৩ শতাংশ কমেছে। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের দাবি, চূড়ান্ত দারিদ্র প্রায় দূর করে ফেলেছে ভারত। এদিকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেখা যাচ্ছে গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র হ্রাসের হার শহরাঞ্চলের তুলনায় বেশি। গ্রামীণ এলাকায় ২০১১ সালে দারিদ্র ছিল ২৬.৩ শতাংশ। সেটা ২০১৯ সালে কমে দাঁড়ায় ১১.৬ শতাংশ। শহরাঞ্চলে দারিদ্র সেই সময়কালের মধ্যে ১৪.২ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল ৬.৩ শতাংশ।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষা বলছে ২০১১-২০১৯ সালের মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র কমেছে ১৪.৭ শতাংশ পয়েন্ট। শহরাঞ্চলে সেই দারিদ্র কমেছে ৭.৯ শতাংশ পয়েন্ট। অর্থনীতিবিদ স্মিতা সিন্হা রায় এবং রয় ভান ডার ওয়েডের উদ্যোগে এই পেপার তৈরি হয়েছে।
বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য উঠে এসেছে এই সমীক্ষায়। দেখা যাচ্ছে, ছোট জমির মালিক এমন কৃষকদের আয়ের হার কিছুটা বেড়েছে। সমীক্ষা অনুসারে দেখা যাচ্ছে, ছোট চাষিদের বার্ষিক আয় প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। অন্যদিকে, সেই সময়কালে বড় চাষিদের আয় মাত্র ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে গোটা পরিসংখ্যানটাতেই করোনা পরিস্থিতির আগের হিসেব উল্লেখ করা হয়েছে।
এরপরেও কেন এখনই উল্লাস নয়?
ভারতে সবথেকে বেশি দরিদ্র মানুষের বাস
গত ১৫ বছরে ৪১৫ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্রের জ্বালা থেকে মুক্তি পেলেও জনসংখ্যার হিসেব অন্য তথ্য দিচ্ছে। রাষ্ট্রসংঘ-র তরফে জানানো হয়েছে, ২০২০ সালে জনসংখ্যার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে, ভারতে সবথেকে বেশি দরিদ্র মানুষ বাস করেন। ভারতের দরিদ্র নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ২২৮.৯ মিলিয়ন। তারপরেই রয়েছে নাইজেরিয়া। নাইজেরিয়ায় দরিদ্র নাগরিকের সংখ্যা ৯৬.৭ মিলিয়ন। দরিদ্র শিশুদের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে উল্লেখযোগ্য হ্রাস পেয়েছে। ভারতে দরিদ্র শিশুর সংখ্যা ৯৭ মিলিয়ন। ০-১৭ বছরের মধ্যে ভারতে দরিদ্র শিশুর সংখ্যা বিশ্বের ২১ শতাংশ। বিশ্বে সবথেকে বেশি দরিদ্র শিশু ভারতেই রয়েছে বলে রাষ্ট্রসংঘ-র পরিংসখ্যান জানাচ্ছে।
ভারতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সবথেকে বেশি। ২০২০ সালে করোনা অতিমারীর পর এই সংখ্যাটা আরও বেড়ে যায়। করোনা অতিমারীর জেরে বহু মানুষ চাকরি হারান, বহু মানুষের বেতন কমে যায়। এই সময় নতুন করে বহু মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েন। এরপরেও ভারতে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যর দাম বৃদ্ধির জেরে দেশে দারিদ্রের সংখ্যা অনেকটা বেশি।
বাংলা কোথায় দাঁড়িয়ে
ভারতের দারিদ্র দূরীকরণ প্রচেষ্টার প্রশংসা করে রাষ্ট্রসংঘ-র প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিহার ২০০৫-'০৬ সালে সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য ছিল। সেই সময়ে মোট দারিদ্র প্রায় ৭৭.৪ শতাংশ ছিল। সেখান থেকে ২০১৫-'১৬ সালে ৫২.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এরপর ২০১৯-'২১ সালে ৩৪.৭ শতাংশে নেমে এসেছে, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ভারতের রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি জুড়ে, আপেক্ষিকভাবে সবচেয়ে দ্রুত গোয়া, তারপরে জম্মু ও কাশ্মীর, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানে দারিদ্র হ্রাস পেয়েছে।
২০১৫-'১৬ সালে দেশের ১০টি দরিদ্রতম রাজ্যের তালিকা থেকে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ বেরিয়ে এসেছে। ২০১৯-'২১ সালেও পশ্চিমবঙ্গ দেশের ১০টি দরিদ্রতম রাজ্যের মধ্যে ছিল না। বাকি বিহার, ঝাড়খণ্ড, মেঘালয়, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, অসম, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থান আগের মতোই ১০টি দরিদ্রতম রাজ্যের মধ্যে রয়ে গিয়েছে।
দারিদ্র দূরীকরণে ভারত ও বাংলা উভয়েই ভালো ফল করেছে। তারপরেও উদ্বাহু নৃত্য করার সময় আসেনি। কারণ কিছুদিন আগেই প্রকাশ হয়েছে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স। সেখানে দেখা যাচ্ছে ভারত আরও নিচে নেমে এসেছে। ফলে এটা উল্লাসের সময় নয়। এই দেশেই ঋণের পাহাড় মাথায় নিয়ে প্রতিটি শিশু জন্ম নেয়। এই দেশের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি। কীভাবে?
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত
সদ্য প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছরের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স, তথা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক। রিপোর্ট বলছে, ভারত তার আগের অবস্থানের চেয়ে কয়েক ধাপ নেমে গিয়েছে। ক্ষুধা-পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে ভারতে। সোজা কথায়, খিদের জ্বালা আরও বেড়েছে ভারতে। ২০২২ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার সূচকে ১০৭তম স্থানে নেমে গিয়েছে ভারত। একমাত্র যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত দেশের পিছনে চলে গিয়েছে ভারত। এই সূচকে আগের থেকে ৬ ধাপ পিছিয়েছে ভারত। ২০২১ সালে বিশ্ব খাদ্য সূচকে ভারতের স্থান ছিল ১০১। এখন ১২১ দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে ১০৭তম স্থানে।
এরপরেও কি চিন্তার কারণ থাকে না?
উল্লাস নয়, সময় উদ্বেগেরও। কারণ দারিদ্র দূরীকরণে ভারত ভালো স্কোর করছে ঠিকই। এই নিয়ে দেশের অন্তরে শ্লাঘা জন্ম নিতে পারে। একথাও ঠিক। এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, দারিদ্র আপেক্ষিক। বড়লোকের দেশে যাকে দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, গরিবের দেশে তিনিই কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত হিসেবে পরিচিত হতে পারেন। তাহলে যে দেশের মানুষ অপুষ্টি, অনাহার সঙ্গী করে বেঁচে আছেন, তাঁদের কতটা খুশি করতে পারে এই শুকনো পরিসংখ্যান?