অন্তঃসত্ত্বা সোনালি খাতুন বনাম ভারতরাষ্ট্র: পরিযায়ী শ্রমিকের যুদ্ধ চলছেই

Pregnant Migrant Worker Sunali Khatun: বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সরকারও চায়, সোনালি ও তাঁর পরিবার যেন নিজেদের দেশে ফিরতে পারে।” 

গর্ভে সন্তান, সঙ্গে আট বছরের শিশু— এই অবস্থায় বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সংশোধনাগারে  দিন কাটছে ভারতের পরিযায়ী শ্রমিক, তরুণী মা, সোনালি খাতুনের। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মুরারই নামের এক গ্রামে। কলকাতা হাইকোর্ট ২৬ সেপ্টেম্ৱর কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল সোনালি ও তাঁর পরিবারকে চার সপ্তাহের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। সম্প্রতি সরকার এখন সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে। ফলে, সোনালিদের দেশে ফেরা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আন্তজার্তিক মহল স্তম্ভিত হয়ে দেখছে, এক জন পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবর্তীর্ণ এক রাষ্ট্র। সোনালিকে নিয়ে এই ব্যাপক গড়িমসির দায় কার? ভদ্রবিত্ত নন, একজন পরিযায়ী শ্রমিক —সেই কারণেই কি তাঁর মানবাধিকার নিয়ে সুনাগরিকরা এখনও ততটা সোচ্চার নন, উঠছে এসব প্রশ্ন। সোনালির গর্ভের সন্তান কোন অপরাধে জেলকুঠুরিতে দিন কাটাচ্ছে, উত্তর খুঁজছেন সোনালির পরিজন।

দিল্লির রাস্তায় প্রায় দুই দশক ধরে কখনও কাগজকুড়ুনি এবং কখনও পরিচারিকার কাজ করে আসছেন সোনালির স্বামী দানিশ শেখ। বড়ো শহরে হয়ত ভালো রোজগার হবে, এই আশাতেই যাওয়া। সোনালি পরিবারও দীর্ঘকাল দিল্লিতে, বাবা রিকশাচালক, মা যখন যেমন কাজ জোটে। ছিল না স্থায়ী ঘর, ছিল না নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ। সবই অস্থায়ী।

সোনালি খাতুনের পরিবার (ছবি: ইনস্ক্রিপ্টের প্রতিনিধি মামুদ শাহ আলম)

পরিবারের অভিযোগ, গত ১৮ জুন দিল্লির কে. এন. কাটজু মার্গ থানার পুলিশ 'বাংলাদেশি নাগরিক' সন্দেহে সোনালি, তাঁর স্বামী দানিশ এবং আরও তিনজনকে আটক করে। কোনো তদন্ত ছাড়াই তাঁদের আটক করা হয় বলে দাবি পরিবারের। এরপর খুব দ্রুত তাঁদের অসম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করা হয় বলে অভিযোগ। সীমান্ত পেরোতেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পুলিশ আবার তাঁদের গ্রেফতার করে, আর সেখান থেকেই শুরু হয় সোনালি ও তাঁর পরিবারের বন্দিজীবন।

আরও পড়ুন

দেশ জুড়ে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক নির্যাতন কীভাবে থামাতে পারে সরকার?

সোনালির বাবা ভদু শেখ মেয়ের মুক্তির দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে ৬ সেপ্টেম্ৱর হেবিয়াস কর্পাস মামলা দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ জানান, সম্পূর্ণ অন্যায় ভাবে একজন ভারতীয় নাগরিককে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।এই ঘটনা সামনে আসতেই মানবাধিকার সংগঠনগুলিও আদালতের দ্বারস্থ হয়। সোনালিদের আইনজীবী কলকাতা হাইকোর্টে জানান, সোনালি বিবি ও তাঁর পরিবার বাংলাদেশের নন, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বাসিন্দা। আদালতে প্রমাণ হিসেবে জমির কাগজ, সোনালির বাবা ও ঠাকুরদার ভোটার কার্ড, এমনকি সোনালির আট বছরের সন্তানের জন্ম শংসাপত্রও জমা দেওয়া হয়েছে। সব দিক খতিয়ে দেখে কলকাতা হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয়, চার সপ্তাহের মধ্যে সোনালি ও তাঁর সঙ্গে আটক করা সকলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। তবু দিল্লি পুলিশের দাবি, সোনালিরা সত্যিই ভারতীয় নাগরিক কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের মতামত জানতে চাওয়া হলেও, এখনও পর্যন্ত কোনো উত্তর মেলেনি। দিল্লি পুলিশের আরও যুক্তি, মামলার প্রধান পক্ষ হলো− দিল্লি পুলিশ নিজে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং ফরেন রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস (FRRO)। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানই দিল্লিতে অবস্থিত, তাই মামলার শুনানিও হওয়া উচিত দিল্লিতেই।

সোনালি খাতুনের পরিবার (ছবি: ইনস্ক্রিপ্টের প্রতিনিধি মামুদ শাহ আলম)

কলকাতা হাইকোর্টের রায় সোনালির পরিবারকে একটু আলো দেখিয়েছিল। তাঁদের মনে হয়, হয়ত এবার দেশে ফেরা সম্ভব হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে। এর ফলে সোনালির দেশে ফেরার আশা আরও অনিশ্চিত হয়ে গেল। সোনালি এখন ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই অবস্থায়  সরকারের নীরবতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

সোনালির বাবা বলেন, “আমি সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে পারব না। শুধু চাই, আমার মেয়ে আর নাতি যেন নিরাপদে দেশে ফিরে আসে।” 

আরও পড়ুন

বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকের কাছে গোমাংস ছিলই না, শুধু সন্দেহের বশেই প্রবাসে হত্যা?

সোনালি বিবি যেহেতু অন্তঃসত্ত্বা, তাই তাঁর পরিবার আরও বেশি চিন্তায় রয়েছে। তাঁরা আশঙ্কা করছেন বিদেশের মাটিতে যদি সোনালির সন্তান জন্মায়, তাহলে সেই নবজাতকের নাগরিকত্ব কী হবে? সে কি ভারতীয় হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, নাকি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে? এই প্রশ্নই এখন নতুন করে জটিলতা তৈরি করেছে পুরো মামলায়। আইনজীবীদের মতে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিক বিদেশে সন্তান জন্ম দিলে সেই সন্তানের নাগরিকত্ব নির্ধারণে দেশভেদে ভিন্ন নিয়ম প্রযোজ্য হয়। কিন্তু যেহেতু সোনালি এখন বাংলাদেশে বন্দি, তাঁর নাগরিকত্ব নিয়েই যখন বিতর্ক চলছে, সেখানে নবজাতকের নাগরিকত্ব নিয়ে আরও অনিশ্চিয়তার জায়গা তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বারবার বলছেন, এই পরিস্থিতিতে সোনালিকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।

সোনালি খাতুনের গ্রামের সমাজকর্মী মফিজুল শেখ বাংলাদেশে গিয়েছেন সোনালিদেরই সাহায্য করতে। মফিজুল শেখ ইনস্ক্রিপ্ট-কে জানান, “চলতি মাসের ২৩ তারিখে সোনালি খাতুনের সঙ্গে আমার কোর্টে দেখা হয়। আমি ওর শারীরিক অবস্থা জানতে চাই। সোনালি জানায়, শরীর খুব একটা ভালো নেই— সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি হয়। ডাক্তার এসে দেখে যান, কিন্তু ইউএসজি (Ultrasonography) করার পরামর্শ দেওয়া হলেও সেই সুবিধা জেলখানায় নেই, তাই টেস্টও করা যাচ্ছে না।” বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সরকারও চায়, সোনালি ও তাঁর পরিবার যেন নিজেদের দেশে ফিরতে পারে। এ নিয়ে তারা চিঠি পাঠিয়েছে ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসে। কিন্তু দূতাবাসের তরফে এখনও কোনো জবাব মেলেনি।” শেষে তিনি বলেন, “সোনালি জিজ্ঞেস করে, ‘দাদা, কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের কী হলো? আমাদের কবে দেশে ফেরানো হবে?’—এই প্রশ্নের উত্তর আমরা কেউ দিতে পারি না।” বলতে গিয়ে মফিজুলের গলা ভারী হয়ে আসে।

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলির দৃষ্টি আকর্ষণ আবশ্যক। প্রশ্ন উঠছে, কেন সোনালি খাতুন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি ততটা সরব নয়? কেন মিডিয়া প্রাইমটাইমে সোনালি খাতুনের নাম নেই, সংখ্যালঘু বলে, মহিলা বলে নাকি পরিযায়ী শ্রমিক তাই?

More Articles