NCERT-এর নতুন বই থেকে উধাও দক্ষিণ ভারত! পাঠ্যপুস্তক রাজনীতি নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে

NCERT Class 8 Textbook Controversy: হায়দর আলি এবং টিপু সুলতান উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে প্রথম বড় প্রতিরোধ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের নিয়ে কোনো আলাদা অধ্যায় নেই।

ভারতের স্কুলশিক্ষার ভিত গড়ে দেয় যে পাঠ্যপুস্তকগুলি, তার মধ্যে অন্যতম NCERT-র বই। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে অষ্টম শ্রেণির নতুন একটি সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তক— 'Exploring Society: India and Beyond (Part 1)। বইটি বাজারে আসার পরই একের পর এক শিক্ষাবিদ, গবেষক ও ইতিহাসবিদদের অভিযোগ, দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস প্রায় পুরোপুরি উধাও। এই বইয়ে নাকি 'উত্তর ভারত-কেন্দ্রিক ভারতের ইতিহাস' লেখা, সেই অভিযোগও উঠছে।

বইটি পড়তে শুরু করলে প্রথমেই চোখে পড়ে দিল্লির সুলতান, মুঘল সাম্রাজ্য, উত্তর ভারতের প্রশাসনিক কাঠামো, ঔপনিবেশিক শাসন এগুলোই ইতিহাস অংশের কেন্দ্রে। কিন্তু ভারতের ইতিহাস তো শুধু দিল্লি, আগ্রা, পাটনা অথবা লখনউ-এর গল্প নয়। ভারতের ঐতিহ্য, বিজ্ঞানচর্চা, সাম্রাজ্য নির্মাণ, সামুদ্রিক বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই দক্ষিণ ভারত ছিল অগ্রগণ্য। অথচ এই বইয়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্য নেই বিস্তৃতভাবে। চোল, পাণ্ড্য, চেরা— এই তিন প্রাচীন ও মহান রাজ্যের প্রশাসন, স্থাপত্য, বাণিজ্য, শিল্প আর সামাজিক কাঠামো প্রায় গায়েব।

হায়দর আলি এবং টিপু সুলতান উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে প্রথম বড় প্রতিরোধ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের নিয়ে কোনো আলাদা অধ্যায় নেই। চারটি অ্যাংলো-মহীশূর যুদ্ধ ভারত ও ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এর একটিও নেই পাঠ্যবইয়ে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ ভারতের সাহিত্য, জ্ঞানচর্চা, দ্রাবিড় ভাষার বিকাশ, সমুদ্রপথের বাণিজ্য কোনোটিকেই বিস্তারিত অধ্যায়ে রাখা হয়নি। অর্থাৎ, দক্ষিণ ভারতের পুরো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস একধরনের ছায়াপথে তোলা হয়েছে।

আরও পড়ুন

ইতিহাস ও ইতিহাসচর্চার আলোকে পলাশীর যুদ্ধ ও সিরাজদ্দৌলা  

ইতিহাসবিদদের মতে, একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজেদের সংস্কৃতি চেনার অনেকটাই নির্ভর করে তারা স্কুলজীবনে কী শেখে তার উপর। এখানেই সমস্যার শুরু। দক্ষিণ ভারতের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারছে না। আর অন্যদিকে উত্তর ভারতের ছাত্রছাত্রীরাও ভাববে, ভারতের ইতিহাস মানেই উত্তর ভারতের ইতিহাস। এতে ভারতের বহুত্ববাদী চেতনাকে একরকম দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে NCERT-র এই বই।

সমালোচকরা বলছেন, ইতিহাস তো শুধু যুদ্ধ বা রাজবংশের গল্প নয়; ইতিহাস হলো মানুষের, সমাজের, ভাষার, নদীর, স্থাপত্যের গল্প। দক্ষিণ ভারত বাদ পড়লে ভারতের ইতিহাস মানেই ‘দিল্লি-আগ্রা কেন্দ্রিক একখানি গল্প’ এটাই মনে গেঁথে যাবে। তবে NCERT-এর ব্যাখ্যা, এই বইটি ‘খণ্ড ১’। পরবর্তী খণ্ডে নাকি দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস ও অন্যান্য বাদ পড়া অধ্যায় যোগ করা হবে। তাদের দাবি, বইটিকে খুব বেশি জটিল না করতে কিছু অধ্যায় কমানো হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা সহজে বুঝতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে, সেগুলো কি সত্যিই বইটিকে জটিল করত? নাকি এই বাদ দেওয়ার পেছনে রয়েছে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য?

শিক্ষাবিদদের দাবি, এই পরিবর্তনগুলি আকস্মিক নয়। কয়েক বছর ধরে পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের কাঠামো বদলানো, কিছু বিষয় বাদ দেওয়া ও কিছু বিষয় বাড়ানো এসব চলছে একটি নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য নিয়েই। দক্ষিণ ভারতের সমৃদ্ধ ইতিহাস বাদ দেওয়া আসলে সেই পরিবর্তনেরই অংশ।

আরও পড়ুন

ইতিহাসে উপেক্ষিত রয়ে গেলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের যে শহিদ নারীরা

এই বাদ দেওয়া কেন বিপজ্জনক? ভারতকে বোঝার জন্য শুধু দিল্লি জানলেই হয় না। কেরল, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিও ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাঠ্যবই সেই ইতিহাসকে স্থান না দিলে জাতীয় পরিচয় একপেশে হয়ে যায়। আর উপনিবেশ-বিরোধী ইতিহাসও বিকৃত হবে; কারণ ভারতের প্রথম সংগঠিত প্রতিরোধ— টিপু সুলতানের লড়াই এই বইয়ে নেই। তাহলে উপনিবেশবাদের প্রকৃত গল্প কীভাবে জানবে শিক্ষার্থীরা?

এছাড়া দ্রাবিড় স্থাপত্য, দক্ষিণ ভারতীয় লিপি, মন্দিরশিল্প, করমণ্ডল উপকূলে সামুদ্রিক বাণিজ্য এসব বাদ গেলে ভারতকে বোঝাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এতে অঞ্চলভিত্তিক বঞ্চনা তৈরি হয়; যে অঞ্চলের মানুষরা দেশের জন্য এত ভূমিকা রেখেছে, তাঁরা পাঠ্যপুস্তকে এগুলোকে বঞ্চনা বলেই উল্লেখ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

NCERT-এর নতুন ক্লাস ৮ পাঠ্যপুস্তক ভারতের ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরলেও দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসকে কার্যত অদৃশ্য করে দিয়েছে। এটি একদিকে যেমন শিক্ষাগত ত্রুটি, তেমনই দেশের ইতিহাস-চরিত্রকে একমুখী করে দেওয়ারও আশঙ্কাজনক প্রবণতা। ভারতকে বোঝার জন্য দক্ষিণ ভারতকে বাদ দেওয়া যায় না। পাঠ্যপুস্তক যখন সেই প্রয়োজনীয়তাকেই অস্বীকার করে, তখন তার ক্ষতি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, সমস্ত প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলে।

প্রশ্ন উঠছে, সমালোচকদের আশঙ্কাই কি ঠিক? ভারতের ইতিহাস কি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? ভারতের বহুত্ববাদী, বহু-অঞ্চলীয় ইতিহাসকে কি সত্যিই ধীরে ধীরে একক ও উত্তর-কেন্দ্রিক ভাবে সাজানো হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলি শুধু শিক্ষাব্যবস্থার নয়, এগুলি দেশের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ইতিহাসচর্চা এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত।

More Articles