রাহুল গান্ধির সঙ্গে দু' দশ মিনিট
Rahul Gandhi Exclusive : কুড়ি ফুট দূরত্ব থেকে দেখলে রাহুল কেমন? ক্লান্তিহীন। স্বতঃস্ফূর্ত। লাক্ষাদ্বীপের নিঃসঙ্গ ভ্রামণিক নন। বরং মানুষের মন বুঝতে মরিয়া। প্রতিটি বাড়িয়ে দেওয়া ফুল তিনি গ্রহণ করছেন সমান আন্তরিকতায়।
দীর্ঘদিন চারপাশে যা দেখছি, হিন্দিতে বললে, তা- ভারত তোড়ো। আর তিনি বলছেন, আমরা হাঁটব উল্টোদিকে। আমাদের যাত্রার নাম হবে-ভারত জোড়ো। আমাদের যাত্রাপথ ক্রমে জুড়ে দেবে দেশের বুকে জমে থাকা দগদগে ক্ষতসমূহ। ভাঙামনের শুশ্রূষা হবে। হক পাবে অপর। বলছেন, ঘৃণার বাজারে দোকান খুলবে ভালবাসা। শুধু মুখে বলছেন না। প্রথম দফায় চার হাজার কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছেন। মুখে মারিতং জগৎ রাজনীতিতে, ঘৃণার বাস্তুতন্ত্রে এসব কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম। তাই, ভারত জোড়ো যাত্রার এই দ্বিতীয় পর্বে, উত্তরবঙ্গে রাহুল গান্ধির কর্মসূচির দিকে তাকিয়ে ছিলাম আগ্রহভরে। ক্রমে দিন এগিয়ে এল। কর্তৃপক্ষ বলল, যাও, ঘুরে এসো। সাক্ষাৎকার পাবে তো? মুখে বলি, পাব। কিন্তু কীভাবে পাব! রাজ্যে কংগ্রেসের অবস্থা দরিদ্র মায়ের শতচ্ছিন্ন চাদরের মতো। এদিকে ঢাকলে ওদিক বেরিয়ে পড়ে। কেউ কারও সঙ্গে সমঝোতায়, সংযোগে রাজি নয়। সকলেই হোদলবনের শেয়ালরাজা। তবু, উত্তরবঙ্গে যাই। প্রশ্ন সাজাই মনে মনে, আম কাটকে খাতে হো অউর চুষকে খাতে হো জাতীয় বালখিল্য নয়। প্রশ্ন, যার উত্তর চেঞ্জ এজেন্ট হতে পারে। উত্তর হয়ত আসবে না, তবু প্রস্তুত থাকতে ক্ষতি কী! ভাই-বন্ধু, সহযাত্রী, অগ্রজদের কল্যাণে জায়গা হয়ে যায় রাহুলের গাড়ির আশেপাশেই। ২০ ফুট দূরত্ব থেকে তাঁকে দেখেছি দিন চারেক, দিনের অনেকটা সময় জুড়ে। উত্তরবঙ্গে দশ-এগারো ডিগ্রি ঠান্ডা। আমাদের গায়ে গরম কাপড়। আর রাহুলকে যতবার দেখলাম, ততবারই তাঁর পরনে সাদা হাফ হাতা টি-শার্ট, সাধারণ ট্রাউজার প্যান্ট। ঠান্ডা লাগে না ওঁর? ঘনিষ্ঠজন বলল, বিপাসনা আর কঠোর কসরতে গড়ে তোলা শরীর। পুরনো ভারী পাথরের মতো। কিন্তু আলফা-মেল নন তিনি। দেখেই মনে হবে, এ পাথরে ফুল ফুটবে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, মণিপুর থেকে মুম্বই, নানামাত্রিক জলহাওয়ায় ঘুরতে হলে যেমন শরীর দরকার, ঠিক তেমন।
কুড়ি ফুট দূরত্ব থেকে দেখলে রাহুল কেমন? ক্লান্তিহীন। স্বতঃস্ফূর্ত। লাক্ষাদ্বীপের নিঃসঙ্গ ভ্রামণিক নন। বরং মানুষের মন বুঝতে মরিয়া। প্রতিটি বাড়িয়ে দেওয়া ফুল তিনি গ্রহণ করছেন সমান আন্তরিকতায়। প্রতিটি বাড়িয়ে দেওয়া হাত ছুঁয়ে দিতে তিনি মরিয়া।
আরও পড়ুন: অক্লান্ত নির্ভীক গৌরী লঙ্কেশরা মরণজয়ী
দিন যায়। যে টেলিফোন আসার কথা আসে না। মালদহে দিনভর ঘুরলাম। কথা বললাম কানহাইয়া কুমার, জয়রাম রমেশদের সঙ্গে। ভাগ্যের শিঁকে এবার ছিঁড়বে না, যখন ধরেই নিয়েছি, ঠিক তখনই সংক্ষিপ্ততম মেসেজ এল, 'সুজাপুর টেন্ট, সন্ধে সাড়ে ছ'টা।' রাহুলের জনসভায় দাঁড়িয়ে আছি তখনও। মালদহ টাউন এমনিতেই ঘিঞ্জি জায়গা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাহুল গান্ধি- কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দুই ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে তখন যেন নাভিশ্বাস উঠছে শহরটার। পড়িমরি ছুট লাগাই। আমি, সঙ্গে নাগরিকের প্রতিনিধি, অনুজ অনির্বাণ।
সুজাপুর টেন্ট একটা অস্থায়ী গ্রাম মতো। একদিন রাত্রিবাসের এলাহি ব্যবস্থা। অন্তত আড়াইশো লোকের থাকাখাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে সেখানে। মাঠের গা লাগোয়া গ্যালারি। সেখানে আশপাশ থেকে রাজ্যের লোক এসে জড়ো হয়েছে রাহুলকে একবার দেখার আশায়। প্রবল নিরাপত্তার কড়াকড়ি। ফোনটাও নিয়ে নেওয়া হলো। মেটাল ডিটেক্টরে ছানবিন চলছে, আমার মনে পড়ছে, রাহুলের ঠাকুমা-বাবার মৃত্যুর দৃশ্যাবলী। যে পরিবার এই বীভৎসতার ঋতু পেরিয়েছে, তারা বজ্রআঁটুনিতে বিশ্বাস রাখবে তা তো স্বাভাবিক। কিন্তু সারা দিনমান রাহুল তো এসব নিরাপত্তা বলয়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যখন তখন বাস থেকে নেমে পড়ছেন, হুডখোলা জিপে চড়ছেন মাইলের পর মাইল। ওঁর ভয় করে না?
ভাবতে ভাবতে ঢুকে যাই মাঠের মাঝখানে। আমাদের কয়েকজনের জন্য বসার জায়গা করা হয়েছে এখানে। রাহুলের সেক্রেটারি এসে বুঝিয়ে দিলেন, বেশি সময় বরাদ্দ করা সম্ভব নয়। আর,কথাবার্তায় যেন আড্ডার মেজাজ থাকে। অতএব আমার এবার প্রশ্ন পরিমার্জনের পালা। মনে মনে ভাবছি,কী রাখব, কী বাদ দেব।
রাহুল এলেন, এই প্রথম তাঁকে জ্যাকেট গায়ে দেখলাম। উপস্থিত সকলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে পরিচয় পর্ব সেরে বসলেন। আমি তাঁকে যে'কটি প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছি, তা এখানে তুলে দেওয়া যাক-
প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলিকে এতটা জায়গা দেওয়ার জন্যে। তথাকথিত ছোট মিডিয়া আউটলেটগুলির সঙ্গে কথা বলছেন আপনি। এতে যেমন আপনারা একটা স্বচ্ছ ভাষ্য তুলে ধরতে পারছেন, তেমন আমরাও শক্তি পাচ্ছি। কিন্তু কিছু জটিলতাও আছে। আমাদের আইনি লড়াই লড়তে গিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। এ ব্যাপারে আমরা কি ভবিষ্যতে আপনাদের সাহায্য পেতে পারি?
দেখুন, একটা দুটো ক্ষেত্রে আইনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে কিন্তু মূল ছবিটা বদলানো যাবে না। ঘটনার শিকড় অনেক গভীরে। প্রথমেই ভাবতে হবে, যা করছি তা কেন করছি। এটা একটা সিরিয়াস আদর্শের লড়াই। এক দেশ, এক নেতা, এক ভাষা, এক ধর্ম-এই আদর্শ মেনে নিলে কেউ আঘাত করবে না। সবরকম সুবিধে পাবে। আর তুমি যদি বলো না, আমার দেশ বহুস্বরের, বহুভাষার, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর, তাহলে সমানে বাধা আসবে। আরও একটা কথা ভাবার। বাঙালি মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরলে আঘাত আসবে। ওরা ইতিহাস, সাংস্কৃতিক মূলটাকে আক্রমণ করে। আর একটা কথা ভাবার। শুধু বিজেপি নয়। অনেক বহিরাগত শক্তিও আছে। মতপ্রকাশের জন্য ইউটিউব, ফেসবুক, এই ধরনের সমাজমাধ্যমগুলিই তো আমাদের ভরসা। দু'টো সংস্থারই সদর দফতর আমেরিকায়। খুব আক্ষেপের সঙ্গে বলতে হয় আমাদের কোনও দেশি মিডিয়া সিস্টেম নেই। মার্ক জুকারবার্গ, নীল মোহনরা আমাদের ভাষ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলি কিন্তু সবসময় আপনি যা বলতে চান বলতে দেবে না। আমার পেজও বারবার থমকে গিয়েছে। ফলে আপনারদেরটাও আটকাবে, এ তো স্বাভাবিক। কাজেই পুরো সিস্টেমটাতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করতে হবে। নিজেদের তথ্য বিতরণ ব্যবস্থা গড়তে হবে। রাশটা নিজেদের হাতে রাখতে হবে।
আমি একটা প্রশ্ন সব বড় নেতাকে করি। আজ সকালে কানহাইয়াকেও করেছি। আপনাকেও করছি। এক কোটির বেশি গিগকর্মী রয়েছেন আমাদের দেশে। আপনারা যখন যুবার জন্যে ন্যায় কথাটি বারবার উচ্চারণ করছেন, কেন ওদের কথা আলাদা করে বলছেন না? কেন ওদের জন্য বৃহত্তর আন্দোলনের কথা ভাবছেন না?
দেখুন, আমরা রাজস্থানে কী করেছিলাম আপনারা দেখেছেন। আমরা কাজটা পরীক্ষামূলক ভাবে কর্ণাটক, তেলেঙ্গানাতেও শুরু করতে চাইছি। আমরা চাইব সমস্ত গিগ লেবাররা ন্যূনতম মজুরি পান আর পরিকাঠামো পান। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য আপনাকে পাঠাব আমরা।
বিজেপির রামমন্দিরের মতো আফিমের সঙ্গে লড়ার মতো কোনো একটি মানুষের ইস্যু আপনাদের হাতে আছে?
একটা কেন বলছেন? দেশের যে কোনো কমবয়সি ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞেস করুন না। সে বলবে চাকরি চাই। কর্মসংস্থান এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। বাজারে জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। আমি সর্বত্র নারী নিরাপত্তা, মেয়েদের ক্ষমতায়নের কথা বলি। আমরা যেখানে বসে আছি, রাতবিরেতে সেখান থেকে আমি যত সহজে বেরোতে পারব, তত সহজে অনেকেই বেরোতে পারবে না।
এই রাজ্যে দেখেছি, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। আমাদের রাজ্যে এমন বহু বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা বিজেপি বিরোধী আবার সে অর্থে তৃণমূল সমর্থকও নন। আপনারা, আপনি সরাসরি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেন না কেন?
যোগাযোগ বলতে আপনি কী বলতে চাইছেন?
বলতে চাইছি, ওদের প্রত্যক্ষ ভাবে জুড়ে নেওয়া।
দেখুন প্রত্যক্ষ ভাবে প্রথম থেকেই তো বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সঙ্গে আছেন। আমাদের কাছে বাংলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ শুধু ব্রিটিশ-বিরোধী লেখালিখিই করেননি, আদর্শগত ভাবেই বিরোধিতায় শামিল হয়েছেন। বাঙালির ডিএনএ, অন্তত এর একটা বড় অংশই আরএসএস সংস্কৃতি আর আদর্শের পরিপন্থী। ওরা বিবেকানন্দকে উদ্ধৃত করে কথায় কথায়। কিন্তু কেউ কি বিশ্বাস করবে বিবেকানন্দ বিজেপি সমর্থক? বিজেপি যা করছে, বিবেকানন্দ তার উল্টোকথাই তো বলে এসেছেন!
আরও পড়ুন:অধীরের গড় কি অধীরেরই রইবে? রাহুলের ন্যায় যাত্রায় যা প্রমাণ পেল বহরমপুর
সমান অভিনিবেশে রাহুল অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেন।
এই সময়ে আমি তাঁকে আমার এবং পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার লেখা বই- ফেসবুক মুখ ও মুখোশ তুলে দিই। রাহুল গান্ধি বাংলা পড়তে পারেন না, আমাদের বই পড়বেন না এই তো স্বাভাবিক। আমি তো কেবল একটা ভদ্রতা করলাম। কিন্ত অবাক হই ওঁর সৌজন্যবোধে। খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আমরা কী খুৃঁজে পেলাম। দেখি ধুলাগড়, বসিরহাট দাঙ্গার বিষয়ে তিনি ওয়াকিবহাল। আমি বলতে থাকি আমরা ফেসবুককে কী প্রশ্ন করেছিলাম, ফেসবুক কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। দেখি, রাহুলের চোখ চকচক করছে। কথা দিই, এই যাত্রায় আরেকবার দেখা হবে।
রাহুলের ম্যানেজার আমারই বয়সি একটি মেয়ে। মিষ্টি হেসে বলে, যাওয়ার আগে খেয়ে যাও। অফিসে বলে দিই, পেয়ে গিয়েছি। এবার ফিরব। শাহি টুকরাটা কেমন খেলাম, সে কথা না হয় অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে লিখব।