হু হু করে কমছে ফেসবুক ফলোয়ারের সংখ্যা? রইল আসল কারণ

Social Media: কেন কমছে ফেসবুকের ফলোয়ার?

সোশ্যাল-দুনিয়ার কাজ সাঙ্গ করে ঘুমোতে গিয়েছিলেন। সকাল হতেই দেখলেন সর্বনাশ! একধাক্কায় 'বন্ধু' কমেছে বহু! একজন, দু'জন বা কয়েকশো নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় 'বন্ধু' হারাতে হয়েছে কয়েক হাজার! মাথায় হাত অনেকের!

এমন ঘটনা শুধু এক জনের সঙ্গে নয়, বিশ্বজুড়ে একাধিকের সঙ্গে ঘটছে একইরকম। অজান্তেই কমে যাচ্ছে ফেসবুক পেজের অনুসরণকারীর সংখ্যা। পরিচিত অর্থে নিমেষেই কমছে হাজার হাজার ফলোয়ার! হ্রাস পাছে লাইক!

বেশ কয়েক মাস আগে থেকে এই ঘটনার কথা কেউ কেউ জানালেও অক্টোবর পড়তেই নাকি প্রবণতা বেড়েছে এর। মার্ক জুকেরবার্গের মেটা-র ওপর ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন কেউ কেউ।

আরও পড়ুন: জীবনে একটিও সেঞ্চুরি নেই! তবু কেন বিনিকেই বাছল জয় শাহ-র বোর্ড

একটি জনপ্রিয় বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমের পরিচিত মুখ পিউ রায়। রাত পোহাতেই অবস্থা তাঁরও প্রায় এক। ফেসবুক পোস্ট করে পিউ জানান, 'ভীষণ ভীষণ মন খারাপ! কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সকালে উঠে দেখলাম ৫০০০০ হাজারের বেশি ফেসবুক ফলোয়ার নেই। রাতারাতি কোথায় গেল? কাল রাতেও ৬১০০-র ওপর ছিল। রিপোর্ট করেছি। আপনারা গাইড করতে পারেন ?' প্রায় একই অভিজ্ঞতা তৃণমূল নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্যের। তিনি বলছেন, 'স্বয়ং মার্ক জুকারবার্গেরও এখন সাড়ে নয় হাজার ফলোয়ার! আমারও তাই। এটা কোনও টেকনিকাল এরর সম্ভবত।' আচমকা ফলোয়ার কমেছে ময়ূখরঞ্জন ঘোষেরও। তাঁর দাবি, 'সমাজতান্ত্রিক করে দিয়েছে এক নজরে। গভীরে গেলে বোঝা যাবে যা ছিল তাই আছে। আমারও ৯০০০। প্রায় প্রত্যেকেরই যাদের ভলিউমে ফলোয়ার আছে। কিন্তু ফলোয়ার ক্লিক করলে দেখা যাবে, যে ফলোয়ার সংখ্যা ছিল তাই আছে!'

প্রশ্ন উঠছে, এই ঘটনার পিছনে কি শুধুই প্রযুক্তিগত কারণ? ফলোয়ার প্রকাশ্যে কম দেখালেও ক্লিক করলেই কি ঠিক দেখা যাচ্ছে! কেন হচ্ছে এমন?

কারণ অনুসন্ধানে যেতে হবে অক্টোবরের প্রথম দিকে। যখন, সমগ্র আমেরিকাজুড়ে একাধিক সংবাদসংস্থা থেকে শুরু করে তারকা। একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন অনেকে। এই ঘটনার পর ফেসবুকের তরফে দাবি করা হয়, বট করেছে এসব। কেন, তার কারণ স্পষ্ট করা হয় মেটার তরফে। অর্থাৎ বটের তরফে এই কাজ হয়েছে নির্দিষ্ট নিয়মেই।

কী হয়েছিল তখন?
দেখা যায়, চলতি বছরের জুন মাসের ১০ তারিখের আগে থেকে কমতে থাকে ফলোয়ারের সংখ্যা। যা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এক ধাক্কায় কমে আরও ফলোয়ার হারান বহু মানুষ। হাজার হাজার কমে এই সংখ্যা। প্রথমত কেউ খেয়াল না করলেও পরে প্রকাশ্যে আসে এই তথা। অক্টোবরের ৩,৪ তারিখ নাগাদ নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ইউএসএ টুডে, নিউইয়র্ক পোস্ট, দ্য হিল, হাফিংটন পোস্ট-র মতো একাধিক সংবাদ সংক্রান্ত পেজের ফলোয়ার সংখ্যা কমে যায়। নিউজ উইকে-র একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকাশ্যে আসা এই ঘটনা জানা যায়, এক তথ্য বিশ্লেষক সংস্থা থেকে। যেখানে এক ধাক্কায় হাজার হাজার কম ফলোয়ার হয় ওই পেজগুলির। শুধু সংবাদ সংক্রান্ত পেজ নয়, ব্যক্তিগত বহু পেজের ক্ষেত্রেও এই তথ্য প্রকাশিত হয়। যেখানে মাত্র দু'দিনেই ইউএসএ টুডে-র ফলোয়ার কমে ২৫ হাজারের বেশি। নিউইয়র্ক টাইমসের ফলোয়ার কমে যায় ১১ হাজারের বেশি। দু'দিনের মধ্যেই নিউইয়র্ক পোস্ট হারায় ১২ হাজারের বেশি অনুসরণকারী। ওয়াশিংটন পোস্ট খুইয়ে ফেলে ৯ হাজারের বেশি। মাত্র দু'দিনের মধ্যে কমপক্ষে ৭০ হাজার ফলোয়ারের হদিশ হারায় একাধিক। কিন্তু কেন, এই কারণ বুঝে ওঠার আগেই যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।

কেন ঘটেছে এমন?
এই বিষয়ে মেটা কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করলে একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে মেটা জানায়, এই বছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছে ফেসবুক। কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম অনুযায়ী এই পরিমাণ অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে বটের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেখানে দেখা যায় অন্তত ১.৬ বিলিয়ন অ্যাকাউন্ট শুধু উঠে এসেছে ফেক হিসেবে।

মেটার তরফে আরও জানান হয়, 'আমরা চাই স্বচ্ছ রাখতে সবটা। এই ক্ষেত্রে এমন বহু অ্যাকাউন্ট রয়েছে যা ফেক। বহু জায়গায় নানা রকমের কাজের মাধ্যমে ফেসবুকের নিয়ম লঙ্ঘন করছে ওই সমস্ত অ্যাকাউন্ট। যারা ভুল প্রচার করে। আবার টাকা দিয়েও এদের কাজে লাগানো হয়। আমরা বেছে বেছে সেই সবটা রুখতেই সরিয়ে দিচ্ছি বহু ক্ষেত্রেই।'

ফেসবুকের মতে, গত এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে মোট সক্রিয় ব্যবহারকারীর নাকি গড়ে ৫ শতাংশই ফেক। এক্ষেত্রে তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তায় ওই সমস্ত অ্যাকাউন্ট সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়েও এই অনুসরণকারীর সংখ্যা কমতে পারে। যদিও এর নিশ্চিত কারণ এখনও জানাতে পারেনি মেটা। প্রযুক্তির ত্রুটির দিকে পরোক্ষে ইঙ্গিত করলেও আদতে কেন, তা জানায়নি এই সংস্থা।

ভিন্ন একটি গবেষণা
কেন এমন হচ্ছে, জানতে গবেষণা করেছিল, 'থ্রুলাইন মার্কেটিং' নামের একটি সংস্থা। এই ঘটনা ঘটেছে এদের ক্ষেত্রেও। তাদের গবেষণায় যা উঠে আসে, তা হল;

পেজ লাইক হ্রাস
কয়েক মাস আগে, তারা নিজেদের এক গ্রাহকের ফেসবুক পেজে লাইকের সংখ্যায় ব্যাপক হ্রাস দেখেন। তারপরই এর সম্ভাব্য কারণ শনাক্ত করার চেষ্টা হয়। অন্যান্য গ্রাহকদের সঙ্গে তুলনা শুরু করতে থাকে এই সংস্থা। দেখা যায়, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পেজের লাইক, ফলোয়ার কমতে শুরু করেছে।

ফেসবুক পেজের লাইক কেন কমেছে
ওই সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বলা হয়, ফেসবুক থেকে তথ্য এবং নির্দিষ্ট পেজের বা পৃষ্ঠায় যাঁরা ফলো বা লাইক করেছেন, তাঁদের উৎস গুলিকে খতিয়ে দেখা শুরু হয়। অর্থাৎ কীভাবে, কোথা থেকে এই ফলোয়ারের উৎপত্তি। তখন সমস্যাটি শনাক্ত হয়৷ তাঁরা জানান, অর্থ প্রদান করে এমন বিজ্ঞাপন-ক্ষেত্র এই ফলোয়ার বা লাইক কমে যাওযার অন্যতম কারণ হতে পারে। যেখানে পরিলক্ষিত হয় যে, খরচ করে (পেইড) লাইক আনার চেষ্টা হলেও বর্তমান নিয়মে ওই লাইক প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে অর্থ প্রদানের বিজ্ঞাপনের জন্য। যা সামগ্রিকভাবে এর কারণ। যদিও পুরনো ফলোয়ার কমেছে, এই ক্ষেত্রে পেইড লাইক আনা বা বিজ্ঞাপনের সম্পর্ক না থাকলেও অনেকেই বলছেন সামগ্রিকভাবে এই ফেসবুক বিজ্ঞাপনের প্রভাব পড়তে পারে এর উপরেও।

বিজ্ঞাপনে কী ঘটছে
অর্থ আসে এমন বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যা পরিবর্তন হয়েছে, তা হল; এই বিজ্ঞাপনের সঙ্গেই যে পেজ লাইক আসত, তা আর আসছে না। অর্থাৎ সেই অপশনই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি এই সংস্থার। অর্থ প্রদানের বিজ্ঞাপনগুলি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে অচিরেই। যা বিরাটভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে সামগ্রিক পেজের চলমানতায়৷  সমস্ত অর্থ প্রদানের বিজ্ঞাপনে আর অনুসরণ বা ফলোয়ার অথবা লাইক বোতাম অন্তর্ভুক্ত নেই৷ এই বোতামটি আগে একটি পৃষ্ঠা বা পেজ অনুসরণ করার অনুমতি দিত গ্রাহকদের, একই সঙ্গে ওই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পৃষ্ঠাটি পরিদর্শন করতে পারতেন তাঁরা। যে বোতামটি সরান হয়েছে। যেখানে অর্থপ্রদত্ত বিজ্ঞাপনগুলি থেকে পৃষ্ঠায় বা পেজে লাইক পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যে নেমে এসেছে। যদিও ফেসবুক থেকে আনুষ্ঠানিক কোনও ঘোষণা না করেই চুপিসারে বহুক্ষেত্রে সরেছে ফলো বোতাম বা অনুসরণকারী বোতাম, দাবি এই সংস্থার। যার কারণ হিসেবে নানা নিয়ম, প্রযুক্তিগত বিষয়ের দিকেই পরবর্তীতে ইঙ্গিত করেছে মেটা।

র‍্যামিফিকেশন
এর সবচেয়ে বড় প্রভাব হল যে, প্রতি মাসে পেজ লাইক এখন আগের তুলনায় কম হতে পারে।  অর্থাৎ বৃদ্ধি আগের মত আর হবে না! যদিও এর অর্থ এই নয় যে, সব হারিয়ে গিয়েছে। তবে গুরুত্ব বেড়েছে, ফেসবুক কীভাবে তার গ্রাহকদের বিশ্লেষণ করবে, এই বিষয়ে। যেখানে গুরুত্ব পাছে, ভিডিও। কত ভিডিও তৈরি করা হচ্ছে এবং ফেসবুকে পোস্ট করা হচ্ছে, সেই দিকে নজর থাকছে। প্রসঙ্গত, গত এক বছর ধরে ফেসবুক ভিডিওকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, অ্যালগরিদমে ভিডিও বেশি কার্যকরি ভূমিকা পালন করছে। এই ক্ষেত্রে অনুসরণকারীর বৃদ্ধি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং সেই শ্রোতাদের সঙ্গে কোন পোস্টগুলি অনুরণিত হয় তা দেখা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রেও একাধিক বিষয় মাথায় রেখে এই কাজ হয়ে থাকতে পারে বলে মত অনেকের।

আউটবাউন্ড ইঞ্জিন-এ টেইলর ল্যান্ডিসের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, একাধিক ভিডিও এবং অল্প সময়ের মধ্যে পোস্ট আর বিজ্ঞাপনের আধিক্যের জন্য অনুসরণকারী হারাচ্ছেন অনেকেই। সেক্ষেত্রে যেমন তার দিক থেকে ত্রুটি আসছে, কনটেন্ট পোস্ট করার ক্ষেত্রে। নিজের ফলোয়ারের রুচি না বোঝার ক্ষেত্রে। তেমনই ভিডিওয় একাধিক বিজ্ঞাপনের জন্য আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই। আবার অযথা কোনও পোস্টে রিপোর্ট করার ফলে ফেসবুকের অটোমেটিক প্রযুক্তির সাহায্যে কমছে অনুসরণকারী।

জানা যায়, বিজ্ঞাপন এবং বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রমোশনের ক্ষেত্রে মোট গ্রাহকের প্রায় ২১ শতাংশ তা পছন্দ করেন না। তবুও এইসমস্ত ব্রান্ডের বিজ্ঞাপন, ভিডিওয় তার প্রচার চলে আসে, যা সামগ্রিকভাবে শেষ করে ভিত্তি।

কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, একদিন বারবার পোস্ট, একাধিকবার কিছু জানানো হলেও কমছে অনুসরণকারীর সংখ্যা।

আবার সোশ্যাল-দুনিয়ায় কথোপকথন বা সক্রিয়তা গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে দেখা যায়, প্রায় ২৭ শতাংশ খুব তাড়াতাড়ি। আর ৮৩ শতাংশ গ্রাহক মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কোনও কিছুর রিল্পাই বা প্রতিক্রিয়া শুনতে, দেখতে পছন্দ করেন। কিন্তু তথ্য বলছে, এই কাজের ক্ষেত্রে পিছিয়ে অনেকেই। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই কমে যেতে পারে অনুসরণকারী।

আবার ফেসবুকের কথা অনুযায়ী, বহু ক্ষেত্রেই ফেক অ্যাকাউন্ট এর রমরমা। সেখানে দাঁড়িয়ে সেই অ্যাকাউন্ট যদি বন্ধ হয়, এক ধাক্কায় কমতে পারে ফলোয়ার সংখ্যা।

যদিও এই সমস্ত কারণ শুধু নয়। আসলে বর্তমানে ফলোয়ার বা লাইক কমার জন্য বেশিরভাগই দায়ী করছেন প্রযুক্তিকে। অনেকেই বলছেন, প্রযুক্তির ফেসবুক-অস্ত্র বট এসব করে ফেলছে না বুঝেই। যেখানে ভালো ছবিকেও সংবেদনশীল বলে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। আবার মজার কমেন্টকে বলা হচ্ছে 'ভায়োলেন্ট'। সবমিলিয়ে এই দশা দেখে কেউ কেউ কটাক্ষ করে বলছেন, সব যদি বট থুড়ি প্রযুক্তি পারত তাহলে আর আবেগ বা মানুষ কেন!

More Articles