রোহিঙ্গা সংকট: বিপর্যয়ের নেপথ্য ইতিহাস ফিরে দেখা
Rohinha Crisis: বাংলাদেশের কক্সবাজার বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার আশা করেছিল যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।
বর্তমানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে তৈরি হওয়া সংকট শুধু রাজনৈতিক বা মানবিক নয়, বরং এর শিকড় আরও অনেক গভীরে প্রোথিত রয়েছে। অবিন্যস্তভাবে সেই শিকড়ের নানা শাখা ছড়িয়ে গিয়েছে নিরাপত্তা, আইনগত, ভাষাগত এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নানা ক্ষেত্রের ভিতর। মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিপুল পরিমাণে উচ্ছেদ এবং পালিয়ে যাওয়া কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি কয়েক শতাব্দী ধরে চলা নিপীড়নের একটি সাম্প্রতিকতম অধ্যায় মাত্র। এই সমস্যাটি বুঝতে হলে, প্রথমেই এর সূচনা পর্বটা ফিরে দেখতে হবে। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোদাপায়া আরাকান জয়ের পর থেকে এই সমস্যা শুরু হয়েছিল। সেই সময় থেকেই রোহিঙ্গারা বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। তারপর থেকেই বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। শেষ কয়েক দশকের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বাংলাদেশ মানবিক কারণে ১০ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার আশা করেছিল যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর একাধিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
গত আট বছর ধরে এই অনিশ্চয়তা আরও মারাত্মক আকার নিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে গভীর হতাশার জন্ম হয়েছে। ‘আর শরণার্থী জীবন নয়’ স্লোগান উঠেছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনূস এই সংকটকে দেশের জন্য ‘গলার কাঁটা’ বলে দাবি করেছেন। এর ফলে রোহিঙ্গাদের সংকট যে তীব্রতর হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। শুধু তীব্রতরই নয়, সংকটের শেষ কোথায়, সমাধান রাস্তার সন্ধানও আরও জটিলতর হয়েছে।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশে আশ্রয়শিবিরে যে জীবন বাঁচেন রোহিঙ্গা রিফিউজিরা
রোহিঙ্গা সংকটের ইতিহাস লিখতে গেলে গত আট বছরটি নিয়ে আলাদা অধ্যায় লিখতে হবে। ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যান। পশ্চিম মায়ানমারে পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি ছেড়ে তাঁরা আশ্রয় নিতে বাধ্য হন অজানা মাটিতে। 'নিরাপত্তার' নামে মায়ানমারে তখন ৩০০টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে তাঁদের জায়গা থেকেই বিতাড়িত করা হয়েছিল। যার ফলস্বরূপ বিশাল মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়। সেই সময় থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল মানবিক সংকট হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। যার কোনও সমাধান সূত্র এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
২০১৭ সালের এই সংকটের সময় মায়ানমারের প্রধান ছিলেন অং সান সু চি। এরপর বহু বছর কেটে গিয়েছে। মায়ানমার এখন তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। অন্যদিকে, বাংলাদেশও ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে রয়েছে। এর ফলে রোহিঙ্গা সংকট আর জটিল আকার নিয়েছে। জানুয়ারি ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) নির্দেশ দেয় যেন মায়ানমারে অবশিষ্ট ৬০ হাজার রোহিঙ্গার ওপর আর কোনও হিংসার ঘটনা না ঘটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অত্যাচার বিন্দুমাত্র কমেনি। জানা গিয়েছে, ২০২৪ সাল থেকে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে কাজে লাগাচ্ছে আরাকান আর্মি (AA)। তারা নাকি রোহিঙ্গাদের জোর করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করছে, এবং হিংসাত্মক কাজে নামতে বাধ্য করছে।
আরও পড়ুন- রোহিঙ্গা শিশুর কান্নাও ‘অবৈধ’?
নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তাই সেখানকার ক্যাম্পগুলোর অবস্থা এমনিতেই খারাপ। বিশেষ করে মহামারির পর থেকে যখন আন্তর্জাতিক সাহায্য ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে, তার পর থেকে ক্যাম্পের পরিবেশ চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর হয়েছে। বিভিন্ন রিপোর্টেও দাবি করা হয়েছে, এই সব ক্যাম্পে থাকা যৌন হিংসার শিকার কিশোরী মেয়ে ও শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। এর অর্থ কী দাঁড়াল? দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় থাকা রোহিঙ্গারা সীমান্তের একপাশে আরাকান আর্মি ও সেখানকার সরকারের মধ্যে পড়ে মারা পড়ছেন। আর অন্য পাশে সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সংকটের মোকাবিলা করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
রোহিঙ্গা সংকটের মোকাবিলা করার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলি নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভিন্নভাবে এই রোহিঙ্গা সংকটে সাড়া দিয়েছে— কখনও তাঁদের আশ্রয় দিয়ে, আবার পরিস্থিতি বুঝে কখনও সীমান্ত পারাপার এবং জনস্রোত আটকে। যেমন, ভারতে রোহিঙ্গা বিষয়টি প্রায়শই আদালতের মামলা এবং আলোচনায় উঠে এসেছে। দুঃখের বিষয় এটাই যে রোহিঙ্গারা আশ্রয়প্রার্থী মানুষ হিসেবে নন, বরং শুধুমাত্র ‘সংকট’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। বাংলাদেশে ক্যাম্পের জীবনযাত্রা খারাপ হওয়ায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ যেমন থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতে পাড়ি জমাচ্ছেন। ২০১৫, ২০১৯ এবং পরবর্তীতে অনলাইনে বাংলাদেশের ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দেখেছি যে, তাঁদের ভারতে আসাটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আকস্মিক ছিল। বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলিতে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে তাঁরা মূলত পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ভারতে আসেন। এখানে 'আকস্মিক' শব্দটি লেখার কারণ হল, বেশিরভাগ রোহিঙ্গার কাছে ভারত কোনও পছন্দের গন্তব্য নয়। তাঁরা কেবল নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং জীবিকার সন্ধানে ভারতে আশ্রয় নিতে এসেছেন।
প্রত্যাবাসন: সমাধান নাকি বিভ্রম?
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পথে সবচেয়ে বড় এবং ক্রমবর্ধমান বাধা হল মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অভ্যন্তরে চরমভাবে চলা অস্থিতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি। এক সময়ে মায়ানমারের সামরিক জান্তার দমন-পীড়নই ছিল রোহিঙ্গাদের কাছে প্রধান সংকট। কিন্তু এখন এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে, কারণ সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী, যার নাম আরাকান আর্মি এই এলাকায় ক্ষমতা বিস্তার করেছে। তারা রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে নিপীড়ন চালাচ্ছে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ– দুই রকম ভাবেই। তাই রোহিঙ্গারা জাঁতাকলের মধ্যে পড়ছেন। এটি তাঁদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এর ফলে ন্যূনতম নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী! বাড়ি ফিরতে পারবেন?
আরাকান আর্মির কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র সংঘাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা রোহিঙ্গা গ্রাম ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে এবং সম্প্রতি লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গাকে নতুন করে বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য করেছে। এই নৃশংসতা একটি সুসংগঠিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। আরাকান আর্মি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে মানব পাচার ও মুক্তিপণের মাধ্যমে অর্থ আদায় করছে, যা এই নিপীড়নকে একটি লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তরিত করেছে। এই পরিস্থিতি স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় যে, নিপীড়ন এখন কেবল রাজনৈতিক বা জাতিগত বিদ্বেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত অপরাধ। এবং তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থও। এমনকি এই নতুন বাস্তুচ্যুতদের সাগর পাড়ি দিতে বাধ্য করার ফলে অনেক নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর ফলে রোহিঙ্গাদেরও আর নিজেদের আদি ভূমিতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে গেছে।
গল্পটা এখানেই শেষ নয়। এই সংকটের সমাধানের পথে আরও একটি বাধা হলো মায়ানমারের সরকারের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে রাজি না হওয়া। শরণার্থীরা বারবার 'সমান অধিকার' এবং 'নাগরিকত্ব' নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, ‘আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই, যেখানে মায়ানমারের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো আমাদেরও সমান অধিকার থাকবে। তাঁরা মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে যে অধিকার উপভোগ করছেন, আমরাও সেই একই অধিকার পেতে চাই।’ তবে, মায়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে এই দাবি পূরণ করার কোনও সদিচ্ছা দেখা যায়নি। তারা প্রায়শই রোহিঙ্গাদের পরিচয় অস্বীকার করেছে। যারা এখনও মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রয়ে গিয়েছেন, তাঁরা সেখানে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন। এখানে বুঝে নেওয়া উচিত, মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি কেবল শারীরিকভাবে পাঠানো নয়, বরং নিজেদের ভূমিতে তাঁদের আইনি ও সামাজিক অবস্থান স্থাপন করাও বটে। নাগরিকত্ব ছাড়া তাঁদের জীবন পুনরায় সংকটের মুখে পড়বে, কারণ তাঁরা কোনও ধরনের অধিকার ও সুরক্ষা পাবেন না। মায়ানমার সরকারের নেতিবাচক মনোভাব তাই বর্তমানে সমাধানের পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
আরও পড়ুন- উদ্বাস্তুদের মানচিত্র কোথায়? কীভাবে বাংলাদেশে ভিটেহারা হয়ে এলেন রোহিঙ্গারা?
আরও একটি সমস্যা হলো, বাংলাদেশে এমন অনেক রোহিঙ্গা আছেন, যাঁরা নব্বইয়ের দশকে সেই দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই সময়ে তাঁদের অনেকেরই বয়স ছিল খুবই কম। তার চেয়েও বড় কথা– নিজের গবেষণার সময়ে বাংলাদেশে গিয়ে টের পেয়েছি– এই সব ক্যাম্পে এমন অনেকেই আছেন, যাঁদের জন্মই ওই সব ক্যাম্পে। তাঁদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি আরও জটিল। কারণ দেশ বলতে, তাঁরা মায়ানমার বোঝেন না, তাঁরা বরং বাংলাদেশকেই চেনেন। ফলে তাঁদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানো আদৌ কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়েও মানবিক প্রশ্ন থেকেই যায়। বর্তমানে বাংলাদেশ ও মায়ানমার— উভয় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগকে অনেকেই সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে ভাবছেন। কিন্তু আসলে কি তা স্থায়ী সমাধানের পথ দেখাবে?
সম্প্রতি সাদেক নামে একজনের সূত্রে কক্সবাজার ক্যাম্পের নুরুল আমিনের সঙ্গে আমার কথা হল। সাদেক এমন একজন, যাঁর সঙ্গে আমার গবেষণার সময় থেকে পরিচয়। দীর্ঘ দিন ধরেই চিনি তাঁকে। নুরুল আমিন (৪৪) একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের একটি ক্যাম্পে বাস করছেন। মায়ানমারের মংডু প্রদেশের বাসিন্দা তিনি। ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী (তাতমাদাও)-এর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। নুরুলের কথায়, তখন থেকে তিনি ‘সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ভিড়ে ঠাসা শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন।’ নুরুল আরও জানান, “২০২৩ সালে আমাদের নাম প্রথম পাইলট প্রত্যাবাসন প্রকল্পের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। আমরা আমাদের নিজভূমে ফিরতে চাই, আমরা মনের গভীর থেকে বিশ্বাস করি যে আমাদের এমনভাবে ফেরত পাঠানো উচিত, যাতে আমাদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং নাগরিকত্বের অধিকার সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হয়। ২০১৭ সালে আমরা চরম নির্যাতন, হিংসা এবং গণহত্যার শিকার হয়ে আরাকানে আমাদের বাড়িঘর থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলাম। বেঁচে থাকার জন্য আমরা আমাদের বাড়িঘর, জীবিকা এবং পরিচিত সবকিছু ফেলে এসেছি। তারপর থেকে আমরা এই আশায় বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে বাস করছি যে একদিন আমরা সম্মান এবং ন্যায়বিচার নিয়ে আমাদের দেশে ফিরতে পারব। ক্যাম্পের পুরো সম্প্রদায়ই নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু আমরা এমন একটি জায়গায় ফিরে যেতে পারি না, যেখানে আমাদের মৌলিক অধিকারের কোনও নিশ্চয়তা নেই, যেখানে আমাদের নিরাপত্তা অনিশ্চিত। আমাদের ফেরানোর প্রক্রিয়া স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে হতে হবে, যেখানে মায়ানমারের বৈধ নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আবেদন জানাই যেন এই ধরনের যে কোনও পদক্ষেপের আগে সেই শর্তগুলো পূরণ করা হয়। আমরা যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরতে চাই, তবে আমরা অধিকার, পরিচয় এবং ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করেই ফিরতে চাই।” নুরুলের এই কথাগুলো সাদেক এবং ক্যাম্পের বেশিরভাগ রোহিঙ্গার অনুভূতিরই প্রতিধ্বনি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বার বার সেটি টের পেয়েছি।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: ক্ষমতাধর দেশগুলির স্বার্থ
রোহিঙ্গা সংকট আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াইয়ের একটি ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য চিনের সমর্থন চেয়েছে। অন্যদিকে, ভারতও কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। যাঁরা ইউএনএইচসিআর-এর কাছে খাতায় কলমে নিবন্ধিত শরণার্থী, তাঁদেরও ফেরত পাঠানো হয়েছে। এটি থেকেই আভাস পাওয়া যায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভাগ্য তাঁদের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে গৌণ। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট বোঝা যায় যে, রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের পথে একাধিক জটিল প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। মায়ানমারের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা পরিস্থিতি চরমভাবে অস্থিতিশীল, সামরিক জান্তা এবং আরাকান আর্মির মধ্যে ঘটে চলা সংঘাত রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন করে বিপদ তৈরি করেছে। নাগরিকত্ব ও অধিকারের প্রশ্নে মায়ানমার সরকারের নেতিবাচক মনোভাব একটি মৌলিক আইনি বাধা তৈরি করেছে। একইসঙ্গে, গণহত্যার মতো অপরাধের জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতি শরণার্থীদের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরগুলোতেও মানবিক পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সাহায্যের অভাবে জীবনযাত্রার মান কমে গিয়েছে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে। এর পাশাপাশি, ভাষাগত জটিলতা এবং ভুল তথ্যের বিস্তার শরণার্থীদের মধ্যে প্রত্যাবাসন নিয়ে ভয় ও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। পরিশেষে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা এবং ক্ষমতাধর দেশগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থ এই সংকটকে দীর্ঘায়িত করেছে।
তথ্যসূএ:
Ranabir Samaddar, The Marginal Nation: Transborder Migration from Bangladesh to West Bengal (New Delhi: SAGE Publications, 1999), 45.
Samaddar, Ranabir. The Postcolonial Age of Migration. London: Routledge, 2020.
Paula Banerjee, "Borders, Histories, Existences: Gender and Beyond," in Unstable Populations, Anxious States: Mixed and Massive Population Flows in South Asia, ed. Paula Banerjee (New Delhi: Samya, 2013), 12–30.
Nasreen Chowdhory, Refugees, Citizenship and Belonging in South Asia: Contested Terrains (Singapore: Springer, 2018), 63–70.
(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)
Whatsapp
