সালঁ, সেলুন আর খুর-কাঁচির কিসসা
Salon in France: ফ্রান্সে এসে প্রথমবার চুল কাটতে গিয়ে মহা বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম। এ দেশে মেয়েদের সেলুনে একেবারে রিস্ক নিতে চায় না। কুচিকুচি করে চুল কেটে দিতে বললে সন্দেহজনক চোখে তাকায়।
সেলুনের রেডিও আমার ভালো লাগত। তার ভিন্টেজ গলায় ঘড়ঘড়ে সুর। খবর পড়লে মনে হয় অনেক দূর থেকে আসছে, মাঝেমাঝে ঝিরঝির আওয়াজ। আর গান বাজলে মনে হয় অন্য দেশে এলাম। সেলুনে হিন্দি গান বাজে, আমাদের বাড়ির রেডিওটা হিন্দি জানতো না। সে বাংলা নাটক জানত, বাংলা গান জানত, বাংলা আর ইংরেজি খবর শোনাত। আমার ৪ নম্বর রু ভ্যকন এর বাড়িতে মিশেল এসে চুল কাটতে কাটতে হিন্দি গান করে। ছোটবেলায় টেলিভিশনে দেখা বলিউডের গান। গুনগুন করে, "গোরো কা না কালো কা, দুনিয়া হ্যায় দিলওয়ালো কা..." ।
মানব ইতিহাসে প্রাচীনতম ব্যবসাগুলির মধ্যে পড়ে চুল কাটার ব্যবসা। গ্রিক রোমান সভ্যতাতে চুল কাটার সেলুনগুলি গুলতানির আখড়া হয়ে উঠেছিল। সমাজবিজ্ঞানী মিশেল মেসু-র লেখায় পাই, ফ্রান্সে একটি বহুপ্রচলিত প্রবাদ - সেলুনে নাপিত যখন জিজ্ঞেস করে, কীভাবে চুল কাটবো, রসিক খদ্দের বলেন, খ্রিস্টপূর্ব ৫ শতক থেকে যেভাবে কাটা হয়ে আসছে, সেভাবেই কাটুন!
এইসব সেলুন ছিল ছেলেদের একচেটিয়া। পাবলিক স্পেসে বসে মেয়েদের চুল কাটা, সাজগোজের জন্য সেলুনে যাওয়ার পর্ব অনেক পরে শুরু হয়।
ফরাসি ভাষায় সালঁ শব্দের নানান অর্থ। কিছু আক্ষরিক, কিছু প্রতীকী। বাড়ির বৈঠকখানাকে বলে সালঁ। ষোলো শতকে যার অর্থ ছিল সভাঘর, অথবা লুকিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা করার ঘর। মেয়েদের সালঁগুলি কীভাবে নারী চিন্তা মুক্তি এবং ফরাসি বিপ্লবে মেয়েদের জায়গা করে নেওয়ার সূক্ষ্মতর উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল, সে কথা লিখব পরে। আমরা যাকে সেলুন বলে চিনি, সেই চুল কাটার দোকান বোঝাতে ফরাসিতে বলতে হবে সালঁ দ্য কোয়াফো/কোয়াফিউস অর্থাৎ নাপিত/নাপিতানির বৈঠকখানা।
আরও পড়ুন: রেডিওর সুরে এক হয়ে যায় আজও ফরাসি আর বাঙালিরা?
বাঙালির সেলুন এসেছে এই সালঁ থেকে। আমরা সেলুন মানে বুঝেছি পাড়ার মোড়ে চুল কাটার দোকান। বা গাছের তলায় ইট-টালি পেতে ইতালিয়ান জোগাড়। বৈঠকখানাকে বৈঠকখানা বা বসার ঘর হিসেবেই শুনেছি, যদিও বাংলার বৈঠকখানাও অনেক বিপ্লবের জন্ম এবং অকালমৃত্যু দেখেছে। সে কথাও না হয় পরে লেখা যাবে। মেয়েদের জন্য আবার বাংলায় ‘সেলুন’ বলা যায় না, ‘পার্লার’ বলতে হয়। পার্লার শব্দও ফরাসি, যার অর্থ ছোট ঘর বা অ্যান্টিচেম্বার।
ফ্রান্সে এসে প্রথমবার চুল কাটতে গিয়ে মহা বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম। এ দেশে মেয়েদের সেলুনে একেবারে রিস্ক নিতে চায় না। কুচিকুচি করে চুল কেটে দিতে বললে সন্দেহজনক চোখে তাকায়। কিছুতেই বেশি কাটবে না। নানা কায়দা করতে বলে। একদিন সেলুনের বয়স্ক মালকিন জিজ্ঞেস করলেন, "কী করো তুমি?" বললাম। উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "তোমাদের লাইনে বোধহয় মেয়েদের ঠিক মেয়েদের মতো না দেখালেও বিশেষ অসুবিধা হয় না, তাই না?" খানিক বুঝলাম, আবার ভুল বুঝছি কিনা এই ভয়ে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করি, তার মানে? বললেন, "ব্র্যাড পিট-এর ছবি দেখিয়ে তার মতো চুল কাটতে চাও, তাই ভাবলাম, তোমার পেশা এমন যেখানে তোমাকে মেয়েলি না দেখালেও লোকে মানবে।" কলকাতায় আমার চুল কাটতেন লিন্ডা। সদা হাসিখুশি লিন্ডা একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত ছোট করে ছেলেদের মতো চুল কাটো (সেবার জার্মান ফুটবলার-এর মতো এরকম ছাঁট চাইছিলাম), তোমার বয়ফ্রেন্ড আপত্তি করে না? লিন্ডার প্রশ্ন আর ফরাসি কোয়াফিউস-এর প্রশ্নের প্রেক্ষিত আলাদা, অন্তর্নিহিত ইঙ্গিত নিঃসন্দেহে এক। মেয়েদের মেয়েদের মতো না দেখালে পেশা বা ব্যক্তিগত জীবনে সবাই মেনে নিচ্ছে তো?
সেই থেকে এ দেশে একটা ঠিকঠাক সেলুন খুঁজছিলাম, পার্লার নয়।
একদিন, একটা ছেলেদের সেলুনের বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখলাম, কুচিকুচি করে চুল কেটে দিতে এদের হাত কাঁপে না। মায়া পড়ে না। কিন্তু সেখানে আমার চুল কাটানো যাবে না শুনে লক্ষ্মীবাবুর সেলুনের জন্য মন কাতর হয়ে উঠল।
চাঁপাডালি বাস স্ট্যান্ডের উল্টোদিকে গীতা মার্কেট। দিনের বেলাতেও অন্ধকার মার্কেটের করিডোর দিয়ে ঢুকে লক্ষ্মীবাবুর সেলুন। বাবার সঙ্গে যেতাম চুল কাটাতে। বাবার পাশে চেয়ারে আমাকে বসানো হত, শতচ্ছিন্ন মেরুন ফেক-লেদার জড়ানো বিশাল চেয়ারের মধ্যে পড়ে নিজেকে আরও ছোট মনে হত। মনে হত, আশেপাশের লোকগুলো কত দূরে, কত উঁচুতে তাদের মাথা। এরপর ক্যাঁচকোঁচ শব্দে ম্যাজিকের মত চেয়ার লম্বা হয়ে উঠলে লক্ষ্মীবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট অপটু হাতে আমার চুল কেটে হাত মকশো করত। সে জানত কেবল একটাই কাট, যার নাম বেবি-কাট। কপালের উপর ঝিরিঝিরি চুল পড়ে থাকবে আর ঘাড় বরাবর গোল। নো-ননসেন্স বেবি-কাট। সেলুনের গন্ধ ভালো লাগত। গোল প্লাস্টিকের বাটি সাবানে শেভিং ব্রাশ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেনা করার গন্ধ। বাড়িতে বাবার আছে ওরকম শেভিং ব্রাশ আর গোল বাটির সাবান, যা আমাকে ধরতে দেওয়া হয় না। মুখে মাখতে দেওয়া হয় না। আর ওই মহার্ঘ রেজার, যার মাথাটা প্যাঁচ দিয়ে খুলে দারুণ কায়দায় ব্লেড বদলাতে হয়, সেটাতো ধরতে দেবেই না। গালে ঘষে দাড়ি কাটতে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এইসব সরঞ্জাম কাছ থেকে দেখার লোভ ছিল। সেলুন ভালো লাগত আমার। আর একটা জিনিস, যা আমাদের বাড়িতে নেই। ফোল্ডিং ছুরির মত জিনিস, স্যাট করে পকেট থেকে বের করে হেব্বি কায়দায় জুলপি মেপে দিতে দেখতাম, ঘাড়ে গোল বর্ডার না চৌকো বর্ডার এইসব কারসাজি করতে পারে ওই জিনিসটা। বাবা বারণ করত, আমাদের ঘাড়ে জুলপিতে খুর চালানো যাবে না। আমি আড়চোখে বাঁ-পাশে চেয়ারে দেখতাম খুরের কাজ।
মিশেল, এ পাড়ার ছেলেদের সেলুনের মালিক, দোকানের বাইরে আমাকে দেখে নিজেই তার বিজনেস কার্ড দিয়ে বলেছিল, "ফোন করো, একটা ব্যবস্থা করা যাবে।" সেই থেকে মিশেল আমার সালঁ অর্থাৎ বৈঠকখানাতে এসে মনমতো কায়দায় চুল কেটে দিত।
জীবনে প্রথমবার চুল কাটার স্মৃতি আমার নেই। বড়দের গল্পে শুনেছি, ধুবুলিয়ার সুপারিন্টেন্ডেন্ট কোয়ার্টার্সে এক দাদু বাড়িতে আসতেন আমার আর বাবার চুল কেটে দিতে। সেই দাদুর হাতেই নাকি আমার কানে বিঁধানোও হয়। এ যেন সার্ত্র-র লেখার পুনরাবৃত্তি। যেখানে লিখেছিলেন, চুল আমাদের আইডেন্টিটি গড়ে ওঠার সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ- "One enters an age or a gender, a social category, often passing through the hands of the hairdresser." ঠাকুরদার হাত ধরে সার্ত্র প্রথম সেলুন যান সাত বছর বয়সে। তার মাথাভর্তি লম্বা ঢেউ খেলানো চুল দেখে ঠাকুরদা নির্দেশ দেন , "মেয়েদের মতো চুলগুলো কেটে দাও। আমাদের ছেলেকে ছেলের মতো করে বড় করতে হবে।"
কান বিঁধিয়ে হয়তো আমার মেয়ে জন্ম শুরু হয়েছিল ধুবুলিয়ার দাদুর হাতে। এখন আমার কানে লাইন দিয়ে দুল দেখে মিশেল বলেছিল, প্রয়োজন পড়লে ও কান বিধিঁয়ে দিতে পারে। "ভ্রুর উপর একটা দুল পরবেন নাকি? পরেরদিন ব্যবস্থা করে দেব তবে।"
আরও পড়ুন: হার্ডকভার মস্তিষ্ক, হৃদয় পেপারব্যাক! দু’য়ে মিলেই গড়াচ্ছে ফরাসি বইবাজারের চাকা
ধীরে ধীরে মিশেল হয়ে উঠেছিল এ পাড়ায় আমার লক্ষ্মীবাবুর সেলুন যে বুড়ো দাদুর মতো বাড়ি বয়ে আসে যন্ত্রপাতি নিয়ে।
ফরাসি ইতিহাসবিদ মিশেল পিয়েরো লিখেছিলেন, মহিলাদের সঙ্গে তাদের নাপিত-নাপিতানিদের একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয। যেভাবে চার্চে কনফেশন করতে যাওয়া হয়, বা মনোবিদের কাছে মনের কথা অকপটে বলা যায়, মহিলারা, যারা সচরাচর প্রাণ খুলে কথা বলার সুযোগ পেত না, তাদের সঙ্গে কোয়াফো/কোয়াফিউসদের গোপন এক বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়। সে ট্র্যাডিশন এখনো চলছে। মনের কথা বলার সুযোগ কতটুকু আছে জানিনা, সেলুনের লোকজনের সঙ্গে আত্মীয়তা তৈরি হয়। অনেকদিন হল, মিশেল আর আমার বাড়িতে আসে না, তার এখন অন্য পাড়ায় কাজ। একদিন পানশালায় দেখে হাওয়ায় কুশল বিনিময় চলছে, যেন কতদিনের চেনা বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা। আমার মাথার দিকে তাকিয়ে বললো, "আজকাল চুল নিজে কাটছ নাকি আর কাউকে পেয়েছ?" প্রশ্নে যেন সামান্য অভিমানের সুর। বলতে বাধ্য হলাম, "পেয়েছি আরেকজন মনের মতো মানুষ। সে আমার কথা বোঝে, কী চাই, কী চাইনা বোঝে।" একটু গম্ভীর গলায় মিশেল বলল, “তা ভালো, কিন্তু সেই লোক যতই ভালো হোক, চুল মোটেই ভালো করে কাটেনি।”