আর দার্জিলিং-গ্যাংটক নয়, গরমের ছুটি কাটান কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে এই গ্রামে
গোটা চৈত্র এবং বৈশাখ মাস পেরিয়ে যেতে চলল, কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের মানুষ এখনও অবধি একবারের জন্য কালবৈশাখীর দেখা পেল না। যদিও এই সপ্তাহে কয়েক পশলা বৃষ্টির দৌলতে গ্রীষ্মের অত্যাচার থেকে সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ খানিকটা হলেও রেহাই পেয়েছে। তবে গ্রীষ্মের তাপদাহ যে একেবারে কমে গেছে, তা কোনওভাবেই বলা চলে না। কিছুদিন পরে আবার বরুণ দেবতার কৃপা হারালেই যে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পার করবে, এই কথা আশা করা যায়, ইতিমধ্যেই বুঝে গেছেন। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের চাপ শেষ হতে না হতেই গরমের ছুটির ঘোষণাও করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দক্ষিণবঙ্গের প্যাচপ্যাচে গরমের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আর গরমের ছুটির সদব্যবহার করার জন্য বাঙালি যে এবার পাহাড়ে ছুট লাগাবে, তা বোধহয় আর বলার অবকাশ রাখে না। তাহলে বরং এইবারের গরম ছুটিতে দার্জিলিং বা গ্যাংটক নয়, চিরাচরিত ছন্দের পতন ঘটিয়ে বরং রওনা দেওয়া যাক, সিতং কিংবা অহলদারার পথে।
সিতং হল দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত কার্শিয়াং বিভাগের একগুচ্ছ গ্রামের নাম। স্থানীয়ভাবে এই জায়গাটি সিতং খাসমহল নামে পরিচিত। আপনি যদি নিস্তব্ধ প্রকৃতির কোলে, একেবারে নিরিবিলিতে ছুটির ক'টা দিন কাটাতে চান, তাহলে আপনার জন্য সিতং একেবারে আদর্শ জায়গা। চারদিকের ঘন সবুজ জঙ্গল, দূরের তিস্তা নদী আবার অন্যদিকে ঘুমন্ত বুদ্ধ– সব মিলিয়ে সিতং নিজেকে একাই একশো বলে দাবি করতে পারে। সিতং কিন্তু আরও একটি কারণে আপনার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। আপনি যদি সীমাহীন কমলালেবুর বাগান দেখতে আগ্রহী হন, তাহলে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে পুজোর ছুটিতে বেরিয়ে পরতে পারেন সিতং-এর উদ্দেশে। বলা হয়, মিরিক-এর পরেই কমলালেবু উৎপাদনে সিতং-এর স্থান।
আরও পড়ুন: দিঘা-পুরী-দার্জিলিং নয়, বাঙালির মনে জায়গা পাকা করছে চটকপুর
কীভাবে যাবেন ?
সিতং মোটামুটি তিনভাবে যাওয়া যেতে পারে। প্রথমটি হল ‘হিল কার্ট রোড সাইট’ থেকে এবং দ্বিতীয়টি হল তিস্তা নদীর ওপর দিয়ে। আপনি যদি নেহাৎ দার্জিলিং-এর মায়া এখনও না কাটিয়ে উঠতে পারেন, তাহলে বরং দার্জিলিং-এ দু'দিন কাটিয়েই সেখান থেকে একটি গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি রওনা দিতে পারেন সিতং-এর উদ্দেশে। দার্জিলিং থেকে সিতং-এর দূরত্ব মাত্র ৫৩ কিলোমিটার এবং যেতে সময় লাগবে প্রায় আড়াই ঘণ্টার কাছাকাছি। এক্ষেত্রে আপনাকে আসতে হবে ‘হিল কার্ট রোড সাইট’ দিয়ে। এছাড়া আপনি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে একটি গাড়ি ধরে, তিস্তা নদী পার করে চলে আসতে পারেন সিটং। এনজেপি থেকে সিটং-এর দূরত্ব ৩২ কিমি মতো। এছাড়াও, শিলিগুড়ি থেকে যাঁরা যাবেন বলে ভাবছেন, তাঁরা কার্শিয়াং থেকেও আসতে পারেন আবার গ্যাংটক রোড ধরে বিরিক অবধি গিয়ে, বাঁ-দিকের রাস্তা ধরেও এগিয়ে গেলেই পৌঁছে যাবেন সিতং।
কী কী দেখবেন সিতং-এ ?
কমলালেবুর বাগান: প্রথমেই বলেছি, সিতং কমলালেবু চাষের জন্য বিখ্যাত। কমলালেবু উৎপাদনের কথা মাথায় রেখে, সিতংকে ‘কমলালেবুর গ্রাম’ নাম দেওয়া হয়েছে। শীতের সময়, চাষের এলাকাগুলোতে কমলার ফলন দেখে আপনি নিশ্চিত দৃষ্টি ফেরাতে পারবেন না।
বাঁশের গির্জা: সিতং-এর রাস্তায় প্রতি পদে আপনি কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে সক্ষম হবেন। সিতং খাসমহলে বহু পুরনো একটি গির্জা রয়েছে। প্রথমদিকে এটি একটি বাঁশের গির্জা হিসেবে থাকলেও, পরবর্তীতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের পরিবর্তে ইটের ব্যবহার করা হয়েছে। পাহাড়ঘেরা ছোট্ট গির্জাটি দেখে আশা করি আপনি আশাহত হবেন না।
বৌদ্ধ মঠ: এছাড়াও রয়েছে ছোট্ট একটি বৌদ্ধ মঠ। উত্তরের অন্যান্য বৌদ্ধ মঠগুলির মতো এই মঠে না থাকলেও বিশেষ চাকচিক্য, এই মঠে ঢুকলে আপনার একটা টাইম ট্রাভেল কিন্তু হয়ে যেতেই পারে। উচ্চতায় অন্যান্য মঠের থেকে এটি বেশ অনেকটাই কম, দেখতে খানিকটা কুঁড়েঘরের মতো। দেওয়ালে আঁকা পুরনো ছবিগুলি আজ প্রায় মুছে গেছে বলেই চলে। ছবিগুলি দেখতে খানিকটা মধ্যযুগীয় ফ্রেস্কো পেন্টিং-এর মতোই। কপাল ভালো থাকলে, আপনি এই মঠ থেকেই দেখা পেতে পারেন কাঞ্চনজঙ্ঘার।
অহলদারা ভিউ পয়েন্ট: সিতং-এর একটি মূল আকর্ষণ হল অহলদারা ভিউ পয়েন্ট। যদিও অহলদারা ভিউ পয়েন্ট এখন নিজেই একটি ‘হলিডে ডেস্টিনেশন’। অহলদারা ভিউ পয়েন্টটি অবস্থিত সেলফু পাহাড়ে। এই অঞ্চলের আরও একটি বিশেষত্ব হল অসংখ্য সিঙ্কোনা গাছ। থমাস অ্যান্ডারসনের হাত ধরে ১৮৬২ সালে সিঙ্কোনা গাছের রোপণ শুরু হয় এই অঞ্চলে। অহলদারা চেক পোস্টের কাছে জনপ্রতি ১০ টাকার টিকিট কেটে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে মূল ভিউ পয়েন্টের উদ্দেশে। যদি আপনি গাড়ি নিয়ে যান, সেক্ষেত্রে গাড়ির জন্য ৫০ টাকা দিলেই হবে, জনপ্রতি কোনও টিকিট আর প্রয়োজন নেই। অহলদারা ভিউ পয়েন্টের চারিদিকের ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে তিস্তা নদী, গোটা কাঞ্চনজঙ্ঘা, কালিম্পং শহর আবার অন্যদিকে শিলিগুড়ি শহর। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে এত কিছু একসঙ্গে দেখতে দেখতে কখন যে সূর্য পশ্চিম দিগন্তে পাড়ি দেবে, তা আপনি বুঝতেও পারবেন না। অহলদারা ভিউ পয়েন্টের কাছেই কিছু হোম স্টে রয়েছে। আপনি চাইলে সিতং-এর পরিবর্তে এই বাড়িগুলোতেও থাকতে পারেন। তবে অহলদারা অঞ্চলে পানীয় জলের সমস্যা কিছু রয়েছে বটে। তাই অহলদারার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাক্ষী থেকে বরং সিতং-এর কোনও স্থানে রাত্রিবাস করাই শ্রেয়।
লেপচা ঝরনা: লোয়ার সিতং থেকে যোগীঘাট যাওয়ার রাস্তাতেই পরবে এই অপরূপ ঝরনা। তবে এই ঝরনার দর্শনলাভ করতে গেলে খানিকটা কসরত আপনাকে করতে হবে। লেপচা ঝরনায় আপনাকে যেতে হবে পায়ে হেঁটে, গাড়ি যাওয়ার পথ এখানে নেই। চারিদিকে ঘন সবুজে ঢাকা পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো রাস্তায় মিনিট দশেক হাঁটার পরেই আপনার সঙ্গে দেখা হবে আকারে বিরাট এই ঝরনাটির।
ইন্টারনেটের যুগে আপনি কোথায় থাকতে পছন্দ করবেন, কিংবা খরচ কত পড়তে পারে, সেসব না হয় নাই-ই বললাম। তবে সিতং বা অহলদারার মতো কোনও জায়গায় ঘুরতে গেলে, হাতে কিছু সময় নিয়ে যাওয়াই ভালো। তাহলে আর দেরি না করে চটপট টিকিট কেটে, ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেনে চেপে পরুন, শুভ কাজে দেরি কীসের!