হাহাকার, মৃত্যু, কান্না! ফিরে দেখা নোটবন্দির বিভীষিকাময় দিনগুলো

Demonetisation: রাত পোহালেই নোট বাতিলের জন্মদিন! ৬ পূর্ণ করে ৭-এ পা দেবে সে! কিন্তু উচ্ছ্বাস?

লকডাউন! ২০২০ সালের প্রথম পর্ব থেকে এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিল বিশ্ব। করোনা-শত্রুর মোকাবিলায় অবশেষে ভারতও ব্যবহার করে এই অস্ত্রই। তার পরের পরিস্থিতি সকলেরই প্রায় জানা! হাহাকার-মৃত্যু আর অর্থনীতির অবনমনের উপন্যাসে চরিত্র হয়েছিলেন সাধারণ জনতাই!

কিন্তু নোটবন্দি? ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর রাত ৮টার আগে পর্যন্ত যা বেশ নতুনই ছিল এই যুগের জনতার কাছে। এই সময়ের আগে যে সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি এই দেশ। এই শব্দের তীব্রতা, এই শব্দের প্রভাব কী, সবকিছু বোঝা তো দূর, লকডাউনের আচমকা উত্থানের মতোই নোটবন্দির পাথরবৃষ্টি হয়েছিল, শীতের আমেজের সেই রাতে! সেদিন সেই আকস্মিক নোট-বিপর্যয় ভয়ংকর করে তুলেছিল পরিবেশ। কালো-সাদার দোলাচলে সুনামি উঠেছিল ভারতজুড়ে। বিশ্বেও ফের আলোচনার উপজীব্য হয়ে উঠেছিল মোদি-র ভারত।

যখন সবেমাত্র দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দু'বছর পূর্ণ করেছেন মোদি। গুজরাত ছাড়িয়ে তখন যিনি দেশের শীর্ষ নেতা। বিজেপি-র নির্বাচনী ইস্তাহারে কালো টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতিকে হাতিয়ার করলেন নরেন্দ্র মোদি। ৮ নভেম্বর, ২০১৬, জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার মধ্যেই ঘোষণা করলেন নোট বাতিলের।

আরও পড়ুন: নোটবন্দির ছ’বছর পরেও ভারতে কালো টাকার রমরমা

স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে যা ছিল ঐতিহাসিক। ১৯৭৮ সাল এবং জনতা সরকারের ক্ষমতার পর্ব বাদ দিলে প্রায় কোনও দিনই এ-দেশে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আর এই সিদ্ধান্তের পরেই, 'কালো টাকা এবার উদ্ধার হবেই,'- এমন আশায় বুক বাঁধলেন কেউ কেউ।

কিন্তু তারপর? কালো টাকা উদ্ধারের তত্ত্বে বেগ দিলেন খোদ দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তারাই। ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, দেশের মোট ১৫.৪১ ট্রিলিয়ন নোটের মধ্যে ১৫.৩ ট্রিলিয়ন নোটই সেই সময় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘরে ফিরেছে। অর্থাৎ, প্রায় ৯৯.৩ শতাংশ টাকায় জমা হয়েছে ব্যাঙ্কে। তাহলে কালো টাকা! এই প্রশ্নের দোলাচলেই ফের সামনে এসেছে নোট বাতিলের সেই দিনের কথা। আসুন আমরাও জেনে নিই, ঠিক কী কী ঘটেছিল সেদিন?

৮ নভেম্বর, ২০১৬। বিকেল ৫টা নাগাদ জরুরি বৈঠকে বসলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তারা। জানা গেল, কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রকের তরফে কিছু একটা বিষয়ে আলোচনা হতে পারে ওই বৈঠকে। এদিকে বিভিন্ন দিক থেকে খবর আসা শুরু হলো, দেশে চালু হচ্ছে ২০০০ হাজার টাকার নোট। কিন্তু তখনও আঁচ করা যায়নি কিছুই! রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওই বৈঠকে ঠিক কী হলো, তা-ও তখন জানার বাইরে। এদিকে দেশের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। জানানো হলো, দেশের জনতার  উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। এই দিন রাতেই সরাসরি সম্প্রচারিত হবে ওই ভাষণ। শোরগোল ফেলে দিল এই খবর। কী হয়েছে এবার! আবার কী সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন মোদি!

রাত ৮টা। টেলিভিশনের পর্দায় তখন নরেন্দ্র মোদি। দেশের শুধু নয়, বিশ্বের বহু দেশের চোখ তখন তাঁর দিকেই। জল্পনা জিইয়ে রেখে বলতে শুরু করলেন তিনি।

রাত ৮টা ১৫। হঠাৎ বিস্ফোরক ঘোষণা করলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদি জানালেন, ''দেশের বাইরে গচ্ছিত কোটি কোটি কালো টাকা এবং আর্থিক দুর্নীতি নিকেষ করতে (ওই দিন) মকধ্যা অর্থাৎ রাত ১২টা থেকে (৯ নভেম্বর) দেশে বাতিল করা হলো ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট।'' এর সঙ্গেই নরেন্দ্র মোদি জানান, "এই টাকা আগামী ১০ নভেম্বর ২০১৬ থেকে আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত যেকোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের যে-কোনও শাখা এবং ভারতীয় পোস্ট অফিসে জমা করা যাবে। ব্যবহারের জন্য নূন্যতম টাকাও নেওয়া যাবে।''

রাত ৮টা ৫০। আকাশ ভাঙল দেশজুড়ে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তাল হলো বিশ্ব। দেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যমে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে উঠে এল নোট বাতিলের খবর। ক্রমশ চওড়া হলো এই সিদ্ধান্তের রচনা। প্রশ্ন উঠতে শুরু করল, তাহলে কি এই সিদ্ধান্তের সলতে পাকতে শুরু হয়েছিল ২০১৬-র অক্টোবর থেকেই! যখন দেশে ২ হাজার টাকার নোট আনার কথা চর্চায় আসে।

৯ নভেম্বর, ২০১৬। সকাল ৮টা। তখনও ঠিকমতো ভিড় বাড়েনি রাস্তায়। গ্রামে গ্রামে পৌঁছয়নি এ-খবর। সবেমাত্র শহুরে এলাকার চায়ের দোকানে খবরের কাগজের প্রথম পাতা দেখার হুড়োহুড়ি শুরু হয়েছে। আদতে কী ঘটছে বুঝতে পারছেন অনেকেই! কী হলো, কেন হলো, কী হবে, এই নিয়েই দ্বিধায় পড়লেন বহু।

দুপুর ১২টা। কাশ্মীর থেকে বর্ধমান। রাজস্থান থেকে জলপাইগুড়ি। এবার ছড়াল খবর। দিকে দিকে অনুরণিত হলো নোটবন্দির শব্দ! যার সঙ্গে পরিচিত হলেন সাধারণ জনতা। কেউ কেউ খুশি আবার কেউ কেউ কী করবেন, সেই চিন্তায় মশগুল হলেন ফের।

বিকেল ৪টে। বারাসত থেকে শুরু করে রায়গঞ্জ। আচমকা এটিএমের বুথের সামনে বাড়ল ভিড়!

সন্ধ্যা ৭টা। এটিএম বুথের সেই ভিড় বাড়ল আরও। হঠাৎ জনবিস্ফোরণে থমকে গেলেন ব্যাঙ্কের কর্তারা। টাকা ফুরোতে শুরু করল এটিএমে। বন্ধ হলো একের পর এক কাউন্টার।

১০ নভেম্বর, ২০১৬। ভোর ৫টা। নোট বাতিলের ভালো-মন্দর উপাখ্যান দেখতে শুরু করল দেশ। ছেঁড়া ব্যাগ, নোংরা শাড়ির ভিড় জমল ব্যাঙ্কের শাখায়। কাজ শুরুর আগেই লাইনে লাইনে ছয়লাপ হলো সবটা। টাকা বদলে, টাকা রাখতে হাজির হলেন দেশের তথাকথিত সিনিয়র সিটিজেনরা!

সকাল ১১টা। একের পর এক জায়গা থেকে খবর আসতে শুরু করল অশান্তির। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের শাখায় অতিরিক্ত ভিড়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা তখন। ভিড় সামলাতে নামতে হলো পুলিশকে।

দুপুর ২টো। অন্যান্য একাধিক রাজ্যের মতোই এটিএমের লাইন, ব্যাংকের শাখায় অসুস্থ হতে শুরু করলেন বহু।

সন্ধ্যা ৬টা। একদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মোদি-বিরোধীদের নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র বিরোধিতা, উত্তাল দিল্লির অলিন্দ, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে নাস্তানাবুদ কেন্দ্র।

১১ নভেম্বর, ২০১৬। প্রবল চাপে পড়ল কেন্দ্র। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠল প্রশ্ন। রাজ্যে রাজ্যে সাধারণ জনতার হয়রানির ছবি তখন দেখছে দেশ। ভালো কাজের জন্য একটু সহ্য করে নেওয়ার নিদান দিলেন বিজেপি নেতারা।

১২ নভেম্বর, ২০১৬। দেশজুড়ে শুধু অসুস্থতা নয়, এবার একে একে সামনে এল মৃত্যুর ঘটনার কথা। আত্মহত্যা করেও মৃত্যুর জন্য দায়ী এই নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত, দাবি করা হলো এমনও। যদিও এর প্রভাব পড়ল একেবারে সাধারণের ওপরে। একে একে সমস্যায় পড়লেন বহু মানুষ। মৃত্যুও ঘটল প্রায় ৩৩ জনের! যদিও এই ঘটনার ২ বছর পর কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়, এই ঘটনার প্রভাবে দেশজুড়ে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ৪ জনের। যার মধ্যে রয়েছেন ব্যাঙ্কের কর্মীরাও।

১৩ নভেম্বর, ২০১৬। এবার ভয়াবহ হলো পরিস্থিতি। একাধিক ব্যাঙ্কের শাখায় অসুস্থ হলেন কর্মীরা। প্রবল ভিড়ের চাপে দেশ থেকে যেন উধাও শীতের আমেজ। ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করলেন সাধারণ জনতা।

১৪ নভেম্বর, ২০১৬। শিশু দিবসেই শিশুদের কোলে নিয়ে ব্যাঙ্কে টাকা তোলার লাইনে তখন মায়েরা! রাতদিন এক করে চলল গচ্ছিত টাকা সুরক্ষার কাজ। মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ভিড়ে তখন গমগম করছে ব্যাঙ্কগুলো।

একে একে কালোবাজারি শুরু হলো এখানেও। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, এমন মানুষের সামান্য টাকার বদলে চলল কমিশন নেওয়ার কাজ। ব্যাঙ্কের শাখার বাইরে ওঁত পাতল দুর্নীতিবাজরা। যা রোধ করতেই নাকি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্র।

বিরোধীদের বিক্ষোভ
কংগ্রেস থেকে তৃণমূল। মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। দিল্লির সংসদ ভবন, গান্ধী মূর্তি, উত্তাল হলো সব জায়গা। কলকাতায় মিছিল করলেন মমতা। সরব হলো বামেরাও। সীতারাম ইয়েচুরি থেকে সুজন চক্রবর্তী, নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরোধিতায় উত্তাল হল এ-রাজ্যও। যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কালো টাকা উদ্ধারের প্রধান লক্ষ্য নিয়ে, তাই-ই হয়ে দাঁড়াল মর্মান্তিক! আর এই ইস্যুকে হাতিয়ার করেই সরব হলেন মমতারা।

'জনবিরোধী সিদ্ধান্ত'
মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের এই সিদ্ধান্তে যে প্রশংসার ঢেউ উঠেছিল সেদিন, সেই সিদ্ধান্তের মাত্র একদিন পরেই ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করলেন সাধারণ মানুষ। বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের টাকার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের বিরাগভাজন হলেন নরেন্দ্র মোদিও!

অর্থনীতি-বিড়ম্বনা
নরেন্দ্র মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর পরই দুই অংশে ভাগ হয় অর্থনীতি-মহলের কারবারিরা। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন থেকে শুরু আমলা জহর সরকার। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত এবং এর ভুল নিয়ে, খারাপ প্রভাব নিয়ে মুখ খোলেন প্রত্যেকেই। এদিকে মোদির সিদ্ধান্তের পক্ষে সরব হয় একাংশ। কিন্তু কয়েকদিন গড়াতেই জনতার অসন্তোষে বদল ঘটে পরিস্থিতির।

রাত পোহালেই নোট বাতিলের জন্মদিন! ৬ পূর্ণ করে ৭-এ পা দেবে সে! কিন্তু উচ্ছ্বাস? নরেন্দ্র মোদি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের মন্ত্রী, আমলা এবং দেশের বা এই রাজ্যের বিজেপি নেতারা বাদে এই উৎসবের পালনে না, নিন্দায় সরব অনেকেই। শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, নরেন্দ্র মোদির সে-দিনের নোট বাতিলের ঘোষণা এবং কালো টাকা উদ্ধারের দাবির ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে জনতাও। কেউ কেউ বলছেন, ''সেদিনের সেই দুর্ভোগই বুঝিয়ে দিয়েছিল আসলে কী পাব! তাই আজ অশ্বডিম্বর স্বপ্ন দেখাই ভালো!''

More Articles