কোথাও সাজানো বাগান, কোথাও চোখ ধাঁধায় স্থাপত্য! এক নজরে পৃথিবীর সেরা রেল স্টেশনগুলি
Rail Stations of World: বিশ্বে এমন অনেক বিলাসবহুল বা আশ্চর্যজনক ট্রেন স্টেশন আছে, যা আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, আর যা দেখার জন্য পর্যটকরা রীতিমতো ভিড় জমায়।
মানুষের ভ্রমণের সঙ্গে বিপ্লব ঘটিয়েছে রেলপথ। ট্রেন আবিষ্কার হওয়ার আগে অবধি মানুষকে হাতি, ঘোড়া বা গাড়ি খুঁজে খুঁজে ক্লান্তিকর ভ্রমণ করতে হতো। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যাওয়ার জন্য গাড়িও পাল্টাতে হতো। কত হয়রানি! কিন্তু মানুষের ভ্রমণের ক্লান্তি আর একঘেয়েমি দূর করেছে ট্রেন। চলার পথ সহজ করে দিয়েছে।
ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে ওই
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?
কু... ঝিক্... ঝিক্... এই শব্দটা যেন ট্রেনের চিরপরিচিত শব্দ। ট্রেনের জানলার ধারে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ থেকে শুরু করে বই পড়া, লেখালেখি, চায়ের কাপে চুমুক কিংবা খুনের রহস্যের সমাধানও হয়ে যায় অনায়াসে। মানুষ ট্রেনে বসে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বা দিনে দিনেই পৌঁছে যেতে পারেন নিজের গন্তব্যে। ভ্রমণকারীরা যানবাহন হিসেবে পছন্দের তালিকায় প্রথমে রেলওয়ের নামই রাখেন। আর ট্রেনের পথ চলা শুরু তো স্টেশন থেকেই। সেখান থেকেই তার পথ চলা শুরু এবং দিনের শেষে সেই স্টেশনে ফিরে যাওয়া। আর আমাদের বাড়ির মতোই ট্রেনের বাড়িও হয় খুব সুন্দর দেখতে, যাকে দেখে আমরা অনেকেই মুগ্ধ হয়ে যাই। বর্তমানে বিশ্বে এমন অনেক বিলাসবহুল বা আশ্চর্যজনক ট্রেন স্টেশন আছে, যা আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, আর যা দেখার জন্য পর্যটকরা রীতিমতো ভিড় জমায়।
আরও পড়ুন: স্টিম ইঞ্জিন নয়, বরং বলদ দিয়েই শুরু হয়েছিল বাংলায় ট্রেন চলাচল
গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনাল, নিউ ইয়র্ক
নিউ ইয়র্কের গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের মতো রেলভ্রমণের অভিজ্ঞতা অন্য কোনও স্টেশনে হবে বলে মনে হয় না। প্রতিদিন এই স্টেশনের ৪৪টি প্ল্যাটফর্মে অগুনতি লোক এদিক-ওদিক ব্যস্তভাবে ছুটছে, কেউ বা আবার নিজের পরিচিত কাউকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে বা চোখের জলে বিদায় জানাচ্ছে। সবকিছুর সাক্ষী এই স্টেশন। সম্ভবত এই কারণেই গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন বিশ্বের সর্বাধিক দর্শনীয় পর্যটন-আকর্ষণ।
এই গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনালটি নির্মিত হয়েছিল ১৯১৩ সালে। রেড ও স্টিম এবং ওয়ারেন ও ওয়েটমারের স্থাপত্য সংস্থা-কর্তৃক এই স্টেশনটি ডিজাইন করা হয়। বিওয়াক্স শিল্পশৈলী এই টার্মিনাল ভবনকে আরও আইকনিক করে তুলেছে। এই স্টেশনের সবথেকে প্রধান আকর্ষণ হেনরি এডওয়ার্ড বেডফোর্ডের তৈরি সেই বিখ্যাত ঘড়ি। স্টেশনটি বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে অন্যতম।
লেইজে গুইলিয়ামস, বেলজিয়াম
লেইজে গুইলিয়ামস কিন্তু ভিক্টোরিয়ান যুগের স্টেশন নয়। ২০০৯ সালে তৈরি এই রেলওয়ে স্টেশনের স্থাপত্য অনেকটা বিমানবন্দরের ধাঁচে তৈরি হয়েছিল। এই স্টেশনের ডিজাইন করেছিলেন সান্তিয়াগো ক্যাতরাভাভা। স্টেশনটি ইস্পাত, কাচ এবং কংক্রিট দিয়ে তৈরি। এর খিলানের উচ্চতা প্রায় ১০৫ ফুট। এই স্টেশনে মোট ৫টি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে এবং প্রত্যেকটি প্ল্যাটফর্মের ট্র্যাক হাই স্পিড ট্রেনের কথা মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছিল।
ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস, মুম্বই
ভারতের মহারাষ্ট্রের মুম্বইতে অবস্থিত অন্যতম ব্যস্ত রেলওয়ে স্টেশন এটি। স্টেশনটি যেমন ঐতিহাসিক, তেমনই জনপ্রিয়। রেলওয়ে স্টেশন হলে কী হবে, দেখলে মনে হবে যেন এক রাজকীয় প্রাসাদ, আর সেই প্রাসাদে মিশে আছে ব্রিটিশ এবং ভারতীয় স্থাপত্য এবং আভিজাত্যের ছোঁয়া। ১৮৭৮ সালে এই স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ কারিগর ফ্রেডরিক উইলিয়াম স্টিভেনসের নকশার আদলে। এই নির্মাণ কাজ শেষ হতে সময় লেগেছিল প্রায় ১০ বছর। ভারতে সেই সময়ের শাসক রানি ভিক্টোরিয়ার শাসনের স্বর্ণযুগে এটি নির্মাণ হয়েছিল বলে তখন নাম ছিল ‘ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস’। পরে ১৯৯৬ সালে মুম্বই সরকার মারাঠা সম্রাট ছত্রপতি শিবাজির নামে এই স্টেশনের নাম পরিবর্তন করেন। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং স্থাপত্যের জন্য ২০০৪ সালে এই স্টেশন ইউনেসকো-র ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি পায়।
ক্যামিনহো ডি ফেররো ডি মোজাম্বিক, মোজাম্বিক
মোজাম্বিকের রাজধানী মাপটো-তে এই রেল স্টেশনটি অবস্থিত। স্টেশনটি ভিক্টোরিয়ান শৈলীতে নির্মিত। বিশ্বের অসাধারণ রেলওয়ে স্টেশনগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। প্যারিসের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারের ডিজাইনার গুস্তাভে আইফেল এই স্টেশনটির ডিজাইন নিজে করেছিলেন। উজ্জ্বল সাদা ও সবুজ ভবনগুলি অসংখ্য গম্বুজ এবং পিলারের সমন্বয়ে গঠিত। শুধু রেলওয়ে স্টেশন নয়, মাঝে মাঝে এই স্টেশনটি পাবলিক আর্ট স্পেস হিসেবেও কাজ করে। স্থানীয় শিল্পীদের বিভিন্ন কাজ এবং নানা কনসার্টও হোস্ট করা হয়।
সেন্ট প্যানক্রাস ইন্টারন্যাশনাল, লন্ডন
ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের যে অল্প কয়েকটি রেল স্টেশন তৈরি হয়েছে লন্ডনের সেন্ট প্যানক্রাস তার মধ্যে একটি। এই স্টেশনটির ডাকনাম রেলওয়ে ক্যাথিড্রাল। পূর্ব মিডল্যান্ড এবং ইয়র্কশায়ারের মধ্যে রেল সংযোগের উদ্দেশ্যে ১৮৬৮ সালে উইলিয়াম হেনরির নকশায় এই স্টেশন তৈরি হয়। দু'টি বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী এই স্টেশন একাধিকবার সংস্কারের পরেও এখনও টিকে আছে। বর্তমানে এর ১৫টি প্ল্যাটফর্ম আছে। স্টেশনের ভেতর বিনোদনের জন্য শপিং মলও আছে।
ডুনেডিন স্টেশন, নিউজিল্যান্ড
ছবি তুলতে কে না ভালবাসে! সে বন্ধুর সঙ্গে রেল স্টেশনে ছবি তোলা হোক, বা একান্ত সেলফি। নিউজিল্যান্ডের এই স্টেশন সবচেয়ে বেশি ছবি তোলার জন্য বিখ্যাত। ১৯০০ সালের প্রথম দিকে নিউজিল্যান্ডের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল ডুনেডিন। ১৯০৬ সালে তৈরি এই স্টেশনটি ফ্লেমিশ রেনেসাঁ শৈলীতে তৈরি এক অনবদ্য স্থাপনা। সকলের কাছে এই স্টেশন জিঞ্জারবার্ড জর্জ নামে পরিচিত। রেল স্টেশনের পাশাপাশি এই স্টেশনের অপরের অংশে নিউজিল্যান্ডের স্পোর্টস হল অফ ফেম এবং ওটাগো আর্ট সোসাইটি রয়েছে।
অ্যান্টওয়ার্প সেন্ট্রাল, বেলজিয়াম
অ্যান্টওয়ার্প সেন্ট্রাল যেন বেলজিয়ামের দ্বিতীয় শহর। ১৯০৫ সালে যখন এটি খোলা হয়, তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, একদিন এই স্টেশন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর রেলওয়ে স্টেশন হিসেবে নিজেকে মেলে ধরবে। পাথরের তৈরি ভবন এবং ওয়েটিং রুমের ওপর বিশাল গম্বুজের সমন্বয়ে গঠিত এই স্টেশনটির ডিজাইন করেন লুইস ডেলাকেনসেরি। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ২০১১ সালে এই স্টেশনটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুরষ্কার লাভ করে।
অ্যাটোচা স্টেশন, মাদ্রিদ
অ্যাটোচা স্টেশন মাদ্রিদের বৃহত্তম ট্রেন স্টেশন। আর্কিটেক্ট অ্যালবের্তো দ্য প্যালাসিও গুস্তাভ আইফেলের সঙ্গে মিলে অ্যাটোচা স্টেশনের নকশা প্রস্তুত করেন। ইস্পাত ও কাচের নির্মাণশৈলী একে অন্য স্থাপত্য থেকে ব্যতিক্রম করে তুলেছে। অ্যাটোচা স্টেশনের নামকরণ করা হয় কাছের একটি চার্চে নিবেদিত নারী অ্যাটোচার নামানুসারে। ১৮৯২ সালে এই স্টেশনটি নির্মিত হয়। স্টেশনে বিরক্ত মুখ নিয়ে বসে থাকতে হবে না, যাত্রীরা স্টেশনের মধ্যে বসে থেকে এই ভাস্কর্য উপভোগ করতে পারবেন। তাই বলে শুধু যে ভাস্কর্য দেখতে পাবেন, তা কিন্তু নয়, এই স্টেশনকে একটা ছোটখাটো জঙ্গল বললেও ভুল হয় না। স্টেশনের মাঝে আছে একটি সুন্দর বাগান, সেখানে শত শত প্রজাতির গাছ এবং নানান রকম প্রাণী বাস করে। এককথায়, মাদ্রিদের এই স্টেশন দুর্দান্ত।