ভাঙা নাকের দুর্গা! বোলপুলের দেউলির পুজো যে কারণে অনন্য

Deuli Durga Puja: বলা হয়, দেউলির এই দুর্গামূর্তিও কালাপাহাড়ের তরবারির কোপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দেবীর নাকের অংশ কেটে যায়। তারপর থেকেই গ্রামবাসী দেবীকে ডাকতে থাকেন ‘খ্যাঁদা পার্বতী’।

MT

যে শক্তির আদি বা অন্ত নেই, বিশ্বে তিনি সর্বশক্তিমান রূপে প্রকাশিত। যে শক্তি অসুর নিধনে আবির্ভূতা, চন্ডীমাহাত্ম্যে দেবীরূপে তিনিই দুর্গা। শত বাধা, বিঘ্ন ও নৈরাশ্যের মধ্যে দেবীর আগমনী বার্তা উদ্ভাসিত হয়। সর্বব্যাপী তাঁর বন্দনা লক্ষিত হয়।

ভারতের প্রাচীনতম দুর্গামূর্তি বোলপুর শহরের কাছে অজয় নদের পাড়ে দেউলি গ্রামে পাওয়া যায়। যাকে ঘিরে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন বহু কাহিনী। দেউলি জনপদ ও চারপাশের এলাকা এক পুণ্যক্ষেত্র। এখানকার পাথরের দেবীমূর্তি প্রধান আকর্ষণ, যা পাল যুগের সময়কার। নীরবে নিভৃতে এখনও বয়ে চলেছে তাঁর ইতিহাস। দেবী মন্দিরের পাশে উঁচু ইঁটের এক শৈব দেউল— দেউলেশ্বর মহাদেব। সেই থেকেই এ জনপদের নামকরণ দেউলি। এখানেই মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবি লোচন দাসের সিদ্ধাসন।

আরও পড়ুন

 এসেছেন বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথও! মানকরের কবিরাজ বাড়ির দুর্গাপুজোর ৩০০ বছর

প্রাচীন দেউলি জনপদে লুকিয়ে রয়েছে নানা অজানা অধ্যায়। নীহাররঞ্জন রায় জানিয়েছেন, বোলপুরের অনতিদূরে সিয়ান গ্রামের শাহজানপুর পাড়ার এক দরগায় জীর্ণ দুটি শিলালেখ পাওয়া গেছে। এগুলি পালবংশীয় রাজা নয়পালের সময়কার। ওই শিলালেখ থেকে তাঁর ধর্মকর্ম সংক্রান্ত নানা কীর্তির তথ্য মেলে। দীনেশচন্দ্র সেন মশাই শিলালেখগুলির পাঠোদ্ধার করেন। প্রথম দিকে নয়পালকে শৈব ও বৌদ্ধ উভয়ই মনে করা হত।

দেউলি জনপদের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে অজয় নদ

জানা যায়, পালবংশীয় এই রাজা পাথরের একাধিক দুর্গামূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথমে নয়টি পাথরের দুর্গামূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীতে চৌষট্টি মাতৃকা মূর্তিরও প্রমাণ মেলে। নয়পালের উপাস্য ছিলেন শিবের পরেই দুর্গা। দেউলির মন্দির ও প্রাচীন দুর্গামূর্তিটি অজয়ের পাড় ঘেঁষে রয়েছে। স্থানীয় মানুষের কাছে যা পরিচিত ‘খ্যাঁদা পার্বতী’ মন্দির নামে।

বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের শিষ্য ছিলেন রাজা নয়পাল। সুশাসক হিসেবে তিনি খ্যাত ছিলেন। তিনি প্রথম মহিপালের পুত্র। বোলপুরের আশেপাশে শৈব ক্ষেত্র, মন্দির এবং অজয়ের নৌবন্দর বহু ঐতিহাসিক স্মৃতি ধারণ করে আছে। এককালে এই নৌবন্দর দিয়ে কার্পাস, রেশম, তসর, নীল, লাক্ষা রফতানি হত দেশ-বিদেশে, এমনকি তিব্বতেও। দেউলির স্থানীয় পুকুর খননকালে পাল ও সেন আমলের বহু মূল্যবান প্রাচীন মূর্তি উদ্ধার হয়।

আরও পড়ুন

জঙ্গলেই প্রথম পুজো করেন রাজা সুরথ! কেমন ছিল প্রথম দুর্গাপুজো?

পুরাতত্ত্ববিদদের মতে, দেউলিতে বৃহৎ দুর্গার প্রস্তরমূর্তিটি পাল যুগের। পাদপীঠের উপর দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করছেন। মূর্তির পিছনের অংশে দুইপাশে অপ্সরা, মাথায় কীর্তিমুখ। নীচে মহিষের মাথা থেকে বেরিয়ে আসছেন মহিষাসুর। বামদিকে রয়েছে শার্দুল। পাথরের এই মূর্তির শিল্পশৈলী আজও তাক লাগায়।

দেউলি গ্রাম

দেউলি জনপদে একসময় মারাঠা বর্গীদের হানা হয়েছিল। তাঁদের অভিযানে এখানকার বহু বাড়িঘর ও দেবালয় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তবে ‘খ্যাঁদা পার্বতী’ নামকরণের পিছনে রয়েছে অন্য ইতিহাস। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মুঘল-পরবর্তী সময়ে কালাপাহাড় এখানে মন্দির ধ্বংস করতে আসেন। আজও বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ভাঙা মূর্তির নিদর্শন দেখা যায়, যেগুলো তাঁর ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক। তবে সব মূর্তি তিনি ভাঙেননি— অনেকসময় অন্য কারণে তাঁর নামে দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, দেউলির এই দুর্গামূর্তিও কালাপাহাড়ের তরবারির কোপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দেবীর নাকের অংশ কেটে যায়। তারপর থেকেই গ্রামবাসী দেবীকে ডাকতে থাকেন ‘খ্যাঁদা পার্বতী’। বর্তমানে সংস্কার হওয়া এই মন্দিরেই মূর্তির পুজা হয়।

দেউলেশ্বর মহাদেব ঠাকুরের দেউল

কথিত আছে, গোটা দেউলি গ্রামে আর কোথাও দুর্গোৎসব হয় না। এ এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। প্রতি শরৎকালে শাস্ত্রমতে এই মূর্তির পূজা হয়। পূজাকে ঘিরে দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ ভিড় জমান। পুজোর দিনগুলোতে বর্ণাঢ্য পরিবেশে মুখরিত হয় দেউলি। স্থানীয় মানুষের উন্মাদনা গড়ে ওঠে একমাত্র এই পূজাকে কেন্দ্র করে।

More Articles