নেহাত সাধনা নাকি ঈশ্বরত্বের হাতছানি, কেন সর্বঘাতী পরমাণু বোমা বানিয়েছিলেন ওপেনহাইমার?
Oppenheimer: সদ্যোজাত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কি একবারও কেঁপে ওঠেনি ওপেনহাইমারের পিতৃহৃদয়। একবারও মনে হয়নি, এ কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছেন তিনি আগামীর জন্য!
একদিন পাথরে পাথর ঠুকে আগুন জ্বালতে শিখেছিল মানুষ। তার পর তাকে পেয়ে বসেছিল আবিষ্কারের নেশা। গাছের ডাল কেটে দেখতে দেখতে একদিন তার মুখ ছুঁচোলো করে বর্শার মতো অস্ত্র গড়ে নিতে শিখে ফেলল সে। সেই অস্ত্রের শুরু। এরপর অস্ত্রের হাত ধরে ক্রমে এল দলচেতনা, শ্রেণিবোধ। এল মানচিত্র, কাঁটাতার, দেশের বিভাজিকা। বাঘ বাঘের মাংস খায় না। মানুষ খায়। কারণ সে উন্নততর প্রাণী। আর এই উন্নতির সোপান হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকে কতশত যুদ্ধ-রক্ত-মৃত্যুর গাথা। জল-সার দিয়ে উর্বর করা হয় গণকবরের মাটি। তার উপর ফোটে প্রগতির ফুল, হাত পা ছড়িয়ে শাখা বিস্তার করে সভ্যতার বৃক্ষ।
আরও পড়ুন: সত্যিই কি ওপেনহাইমার শতাব্দীর সেরা সিনেমা? নাকি…
ছুঁচলো মুখের বর্শার মতো হাতিয়ার দিয়ে যে অস্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল একদিন, তা গিয়ে থেমেছিল সর্বগ্রাসী পরমাণু বোমায়। যা নিমেষে ছাড়খাড় করে দিয়েছিল জাপানের দু-দুটি শহর। না, থেমেছিল বললে অবশ্য ভুল বলা হয়। আরও ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতম অস্ত্র, হাতিয়ার গড়ার প্রস্তুতি চলছে কোথাও হয়তো আরও। বিজ্ঞানের কাঁধে চেপে মানবকল্যাণমূলক অনেক কাজই করা যায়। আবার মুহূর্তে মুছে ফেলা যায় সভ্যতা। ১৯৪৫ সালে হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমাণু হামলা চালায় আমেরিকা। মুহূর্তে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হল শহর দুটি। ঘুমের মধ্যে নেই হয়ে গেল এক শহর মানুষ। আজও ওই দুটি শহরের মানুষের জিনে মিশে রয়েছে পারমাণবিক বোমার বিষ। আজও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দেন মা। আর এই সমস্ত ক্ষয়ক্ষতির নেপথ্যে আসলে কারা? বিজ্ঞান, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন বিজ্ঞানী না যুদ্ধবাজ দেশ! তার উত্তর দেওয়া সহজ নয়।
তবে প্রাথমিক ভাবে এই পরমাণু বোমার নেপথ্যে ছিলেন যে মানুষটি, আপাতত তিনিই সমস্ত চর্চার কেন্দ্রে। জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার। আমেরিকার কুখ্যাত ম্যানহাটন প্রজেক্টের ভার বর্তেছিল মার্কিন এই পদার্থবিদের কাঁধেই। বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীদের নিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তায় তৈরি হয়েছিল ভয়ঙ্কর এক পরমাণু বোমা। সভ্যতার ভয়ঙ্করতম মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের সাক্ষী রইল দুনিয়া। পরমাণু বিস্ফোরণের নায়ক এই ওপেনহাইমারকে নিয়েই ছবি তৈরি করলেন বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ক্রিস্টোফার নোলান। কাই বার্ড ও মার্টিন জে শেরউইনের লেখা ওপেনহাইমারের জীবনী 'আমেরিকান প্রমিথিউস' অবলম্বনে নোলান তৈরি করেছেন সিনেমাটি। পুলিৎজার পুরস্কারও পেয়েছিল তাঁদের লেখা সেই বই। নোলানের সেই 'ওপেনহাইমার' ছবিটি নিয়ে ইতিমধ্যেই হইচই পড়ে গিয়েছে গোটা দুনিয়ায়। বিশ্বের কাছে তিনি পরমাণু বোমার জনক। ঘাতক, খুনি কিংবা সুবিধাবাদী। কিন্তু মোটা চোখে যেটুকু চোখে পড়ে, সেটুকুই কী? না তারও বেশি। আসলে তার সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে আরও অনেক কিছু। রাষ্ট্র, রাজনীতি, আদর্শ ও ষড়যন্ত্রের জটিল সমীকরণ।
নোলানের সিনেমা মানেই তা যেন কোথাও একটু আলাদা। সেখানে রাষ্ট্র আসবে, রাজনীতি আসবে, আসবে ব্যক্তির সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বের কথা। নোলানের একটি ঘরানার সঙ্গে যেমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকবেই সমাজভাবনা, তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই কোথাও। তেমনভাবেই অন্য ঘরানার সঙ্গে বিজ্ঞানভাবনা ও ভবিষ্যতের ডাক। তবে এই দু'ঘরানার ছবিতেই যেটা থাকবেই, তা হল তার সমাজ সম্পৃক্ততা। 'ডার্ক নাইট' বা 'ডার্ক নাইট রাইজেজ'-এর মতো ছবি হোক বা 'ইনসেপশন', 'টেনেট'- এই দু'ধরনের ঘরানাতেই সমান দক্ষ নোলান। মজার ব্যাপার, ভবিষ্য়তের গল্প বলার সময়েও কখনও অতীত-বিস্মৃত হন না পরিচালক। ফলে ভবিষ্য়তে আলোয় ছায়া ফেলে সেই জেগে থাকা অতীত। আর ছবি তৈরির ক্ষেত্রে বোধহয় সেখানেই আলাদা নোলান। ফলে এ হেন নোলানের ওপেনহাইমারকে নিয়ে দেখার চোখ যে একই রকম হবে না, তা তো প্রত্যাশিতই। আর আপাতত তাতেই মজেছে আপামর দর্শক।
পরমাণু যুদ্ধের মুখ ওপেনহাইমারের জন্ম ১৯০৪ সালে নিউ ইয়র্কে। মাত্র দশ বছর বয়সেই দেখতে হবে তাঁকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঁচ। এমন ললাট লিখন নিয়েই যেন জন্মেছিলেন ওপেনহাইমার। বাবা জুলিয়াস এস ওপেনহাইমার ছিলেন ধনী জার্মান, তাঁর ছিল কাপড়ের ব্যবসা। মা এলা ফ্রিডম্যান ছিলেন একজন শিল্পী। ইহুদি পরিবারে জন্মালেও তেমন কোনও ভেদাভেদের মধ্যে পড়তে হয়নি তাঁকে কখনও। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে ১৯২২ সালে ঢোকেন হার্ভার্ডে। প্রাথমিক ভাবে রসায়ন নিয়েই পড়ার ইচ্ছা ছিল, তবে পরে বিষয় বদলে চলে আসেন পদার্থবিদ্যায়। হার্ভার্ডে পড়াশোনা শেষ করে কেমব্রিড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান গবেষণার জন্য। ১৯২৬ সাল নাগাদ ইউনিভার্সিটি অব গটিনজেন থেকে পিএইচডি পান ওপেনাহাইমার। কোয়ান্টাম থিয়োরির উপরে একের পর এক যুগান্তকারী গবেষণা জমা করছেন সে সময় তিনি। বর্ন ওপেনহাইমার অ্যাপ্রক্সিমেশন নামে তাঁর একটি গবেষণা আজও বিখ্যাত। এরই মধ্যে ১৯২৭ সাল নাগাদ গাণিতিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল ফেলোশিপ নিয়ে ফেরেন হার্ভার্ডে। তার ঠিক পরের বছরই চলে যান ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। এ সবই কি পরবর্তীকালের প্রস্তুতি। কিন্তু বিজ্ঞানী তো বিজ্ঞানচর্চা করেন আবিষ্কারের আনন্দে। ধ্বংসের চেতনারা কি আদৌ সচল সেখানে। নিশ্চয়ই নয়। তাহলে কি একের পর এক বিজ্ঞানের শাখার কাছে ছুটে যেতেন তিনি! অ্যাস্ট্রো ফিজিক্স, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, স্পেকট্রোস্কপি, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োররি মতো একাধিক কঠিন ক্ষেত্রে অবদান রয়েছে এই মানুষটির। ব্ল্যাকহোলসের অস্তিত্বের ব্য়াপারেও অত বছর আগে সতর্ক করেছিলেন ওপেনহাইমার।
১৯৪০ সালে ক্যাথরিন পিউনিং হ্যারিসনকে বিয়ে করেন ওপেনহাইমার। তার ঠিক পরের বছরই জন্ম হয় ওপেনহাইমারের প্রথম সন্তান পিটারের। ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। এইসময়টা হঠাৎ করেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলেন ওপেনহাইমার। দেশের জন্য বানাতে চাইলেন এমন অস্ত্র, যা মুহূর্তে শহরকে শহর নষ্ট করে দিতে পারে এক চুটকিতে। ততদিনে বার্কলের লরেন্স রেডিয়েশন ল্যাবরটরিতে হাতেকলমে কাজও শুরু করে দিয়েছেন তিনি। ১৯৪২ সালে ভয়ঙ্কর ম্যানহাটন প্রজেক্টের সায়েন্টিফিক ডিরেক্টরের পদ দেওয়া হল ওপেনহাইমারকে। এখান থেকেই শুরু হল ওপেনহাইমারের জীবনের নয়া পর্ব। বিজ্ঞানের প্যাশন, আবিষ্কারের আনন্দের থেকেও বড় হয়ে উঠল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর তদারকিতেই লস আলামসে গড়ে উঠল নতুন গবেষণাগার। যেখানে গোপনে সৃষ্টি হবে পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম সমরাস্ত্র। পৃথিবী থেকে খুঁজে পদার্থবিদ্যার সেরার সেরা মাথাগুলিকে জড়ো করে তুলেছিলেন তিনি। যা আসলে তৈরি করছিল একটি সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার মারাত্মকতম হাতিয়ার।
প্রায়শই ওপেনহাইমারকে পরমাণু বোমার জনক নামে পরিচয় দেওয়া হয়। কিন্তু এই সময়টাতেই ১৯৪৪ সাল নাগাদ ওই লস আলামসেই জন্মাল তাঁর দ্বিতীয় সন্তান টনি। তাঁর ঠিক পরের বছরই সম্পূর্ণ হল পরমাণু বোমা তৈরির কাজ। জানতে ইচ্ছা করে, ওই সদ্যোজাতের মুখের দিকে তাকিয়ে কি একবারও কেঁপে ওঠেনি ওপেনহাইমারের পিতৃহৃদয়। একবারও মনে হয়নি, এ কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছেন তিনি আগামীর জন্য। কে জানে, হয়েছিল কিনা! ১৯৪৫ সালে আলামগর্দোয় প্রথম বার পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাল ওপেনহাইমারের সমরাস্ত্র। ততদিনে তিনি অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের জেনারেল অ্যাডভাইজারি কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
এদিকে হঠাৎ করেই আমেরিকা জুড়ে শুরু হল কমিউনিস্ট বিরোধিতার জোয়ার। এদিক ওপেনহাইমারের মনে কমিউনিজমের প্রতি দুর্বলতার শেষ নেই। রাষ্ট্রের হাইড্রোজেন বোমা তৈরির প্রস্তাবের তাই বারবার বিরোধিতা করতে লাগলেন ওপেনহাইমার। যে রাষ্ট্রের হাতে তিনি তুলে দিয়েছিলেন এত বছরের সাধনার ফসল, এমন একটি মারাত্মক মারণাস্ত্র, কমিউনিজমের প্রতি আস্থার কারণে সেই রাষ্ট্রের হাতেই কোণঠাসা ততদিনে ওপেনহাইমার। কেড়ে নেওয়া হল তাঁর কাছ থেকে সমস্ত রকম সিকিওরিটি ক্লিয়ারেন্স। অন্যান্য সহযোগী বিজ্ঞানীরা যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন। চেষ্টাও করেছিলেন ওপেনহাইমারকে ফেরানোর। কিন্তু লাভ হয়নি। রাষ্ট্রের সন্দেহের চেয়ে গুরুভার আর কী-ই বা হতে পারে। তার কাছে ক্ষুদ্রের থেকেও ক্ষুদ্র ব্যক্তি, সত্তা বা তাঁর কৃতিত্ব। যদিও ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন হৃতগৌরব কিছুটা হলেও ওপেনহাইমারতে ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের এনরিকো ফারমি অ্য়াওয়ার্ডে ভূষিত করা হয় তাঁকে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত ওপেনহাইমার অতঃপর ফিরে যান তাঁর পড়াশোনার জগতেই। প্রিন্সটন ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডি সংস্থার ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। প্রায় ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সেখানেই মন দিয়েছেন তিনি। কোয়ান্টাম ও রিলেটিভিস্টিক ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করিয়ে গিয়েছেন তিনি শেষ পর্যন্ত। ১৯৬৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ওপেনহাইমার। শেষ হয়ে যায় পরমাণু বোমার জনকের পথচলা।
আরও পড়ুন: ওপেনহাইমারকে ‘গোপন চিঠি’ পাঠিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু! কী ছিল ওই চিঠিতে?
সাধনার পথ সহজ নয়। বিজ্ঞান সাধনার পথ তো নয়ই। নতুন আবিষ্কারের আনন্দে মেতে এমন এক অস্ত্র সভ্যতার হাতে তুলে দিয়েছেন ওপেনহাইমার, তার ফলাফল যে এত ভয়ঙ্কর হবে, তা বোধহয় আঁচ করতে পারেননি তিনি। কিংবা পেরেছিলেন। হয়তো বা তাঁকে চেপে ধরেছিল প্রথম পরমাণু বোমার জনক হওয়ার এক অন্যতর খ্যাতির নেশা। প্রায় তিন হাজার প্রাণ কেড়েছিল একটি হামলা। হয়তো বাকি জীবন সেই অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে থাকাই ছিল তাঁর অদৃষ্ট। রাজনীতি, রাষ্ট্র, ব্যক্তির আড়ালে বারবার ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়েছেন ওপেনহাইমার, বারবার তোলা হয়েছে কাঠগোড়াতে, কখনও বা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে নির্বাসনে। আর এ সমস্ত দাগই সম্ভবত ওপেনহাইমারকে করে তুলেছিল সেই যুগের 'মেফিস্টো'। তারই এক অন্যতর জায়গা তাঁর ছবিতে তুলে ধরেছেন নোলান। তাঁর বয়ানে, তাঁর ব্যাখ্যায়, তাঁর মেজাজে।