চার দশকের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা! খামেনির পতন কি আসন্ন?
Ali Khamenei: ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি রোববার বলেছেন, তেহরান “সাহসী সামরিক পদক্ষেপের ফলাফলকে কূটনৈতিক মঞ্চে শান্তিতে রূপান্তর করতে চায়”।
সময়টা ১৯৮০ সাল। ইরাকের প্রবল পরাক্রমী স্বৈরতন্ত্রী শাসক সাদ্দাম হুসেন ইরানের নতুন ইসলামি নেতৃত্বকে যুদ্ধে নামতে বাধ্য করেছিলেন। ইরানের একজন শীর্ষ সেনা কমান্ডার বলেছিলেন, তারা লড়েছিল “খালি হাতে”। সে সময় ইরানের তরুণ, আদর্শবাদী নেতারা ইসলামি বিপ্লবের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সেনাবাহিনী তখনও জমাট বাঁধেনি। আর শত্রুপক্ষ পেয়েছিল পশ্চিমা ও আঞ্চলিক শক্তির সমর্থন। বহু পরে নেতারা স্বীকার করেন, বিচ্ছিন্ন ইরানকে তখন কাঁটাতারের মতো সাধারণ জিনিসের জন্যও অন্য দেশের কাছে হাত পাততে হয়েছিল। তবু,ইরান আট বছর ধরে লড়াই চালায়। বিপুল ক্ষতির পর ইরানের বিপ্লবী নেতা আয়াতুল্লাহ রুহোল্লাহ খোমেনি যুদ্ধবিরতি মেনে নেন। তিনি এই সিদ্ধান্তকে বলেছিলেন “পেয়ালা থেকে বিষপান করা”।
এখন, ৪০ বছর পর, ইরান আবারও তেমনই ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রে সজ্জিত ইজরায়েল বাহিনী ইরানের ওপর নিরবচ্ছিন্ন হামলা চালাচ্ছে। ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা ইরানের অভ্যন্তরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। রুহোল্লাহ খোমেনির উত্তরসূরী, ৮৬ বছর বয়সি আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি, তাঁর চার দশকের শাসনকালের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। কী হতে চলেছে তাঁর পরিণতি?
চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, “এটি খামেনির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ১৯৮৯ সালে সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার পর তিনি অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন। কিন্তু এবারের ঘটনা সব ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর প্রধান লক্ষ্য এখন শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা। ইরান নিজেদের ডেভিডের মতো দেখে, যে গোলিয়াথের বিরুদ্ধে লড়ছে। তাই, বেঁচে থাকাই তাদের জন্য জয়।”
ইতোমধ্যেই ইজরায়েল ইরানের সামরিক নেতৃত্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। তারা ইরানের প্রধান পারমাণবিক কেন্দ্র, জ্বালানি পরিকাঠামো এবং রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস ফোর্সের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই হামলায় ২০০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ইজরায়েলের ড্রোন ও যুদ্ধবিমান ইরানের আকাশে অবাধে বিচরণ করছে। সোমবার ইজরায়েল দাবি করে, তারা তেহরানের আকাশে “পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ” প্রতিষ্ঠা করেছে। ইজরায়েলের দাবি, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় নিঃশেষ। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখনও থই পাচ্ছে না যেন।
ইজরায়েল জানিয়েছে, তারা ইরানের মিসাইল উৎক্ষেপণের লঞ্চার ধ্বংস করেছে। শুক্রবার ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে ইরান দুর্বল অবস্থাতেই রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইজরায়েলের মতো শক্তিশালী শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য ইরানের হাতে বিকল্প খুবই কম।
১৯৮০ সালে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইরানের জনগণ বিপ্লবী উদ্দীপনায় মিলিত হয়েছিল। কিন্তু আজকের ইরান তেমন নয়। নেতৃত্বের প্রতি জনগণের অসন্তোষ এখন তুঙ্গে। যুব সমাজ দশকের পর দশক ধরে চলা দমনমূলক শাসন, যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় বিধ্বস্ত। সবচেয়ে বড় কথা অর্থনৈতিক ভাবেই তারা বিষাদগ্রস্ত। তবু,ইজরায়েলের বোমা হামলা শুরু হওয়ার পর অনেক ইরানিয়ই, এমনকি শাসনের সমালোচকরাও, জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
কিছু পাশাপাশি প্রশ্ন তুলছেন, কেন সরকার পারমাণবিক কর্মসূচিতে এত সম্পদ বিনিয়োগ করল, অথচ অস্ত্র তৈরি করতে পারল না। তেমন কোনো অস্ত্র থাকলে তা বাইরের হামলা প্রতিরোধে ব্যবহৃত হতে পারত। কাজের কাজ হলো না, অথচ নেতানিয়াহু এই পারমাণবিক কর্মসূচিকে হামলার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন।
পশ্চিমা কূটনীতিকরা অবশ্য মনে করেন, ইরানের শাসনব্যবস্থার টিকে থাকা ইজরায়েলের বোমার ওপর নির্ভর করে না। এটি নির্ভর করে অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়ের ওপর। খোমেনির পতন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা এখনো তাড়াতাড়ি। ইরানের পুরনো রাজনৈতিক বন্দি ও সংস্কারপন্থী রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ আত্রিয়ানফার বলেন, “ইরানের ভেতরে বা বাইরে—কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প নেই। তাই অভ্যন্তরীণ সংস্কারই একমাত্র বাস্তব পথ।”
ইরানে কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক বিরোধী দল নেই। বিদেশে থাকা বিরোধী দলগুলোও ইরানের জনগণের কাছে ধর্মীয় নেতৃত্বের মতোই অপ্রাসঙ্গিক। ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান বিশেষজ্ঞ আলি ভায়েজ নিউইয়র্ক টাইমস-কে বলেন, “শাসক এবং বিরোধী উভয়েই সম্ভবত একত্রিত হয়ে টিকে থাকার সুবিধা দেখছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে যাওয়ার চেয়ে সেটাই ভালো হবে বলে ভাবছেন ওরা।” তিনি আরও বলেন, “সময়টা ১৯৯১ সালের ইরাকের মতো। শাসনব্যবস্থা দুর্বল হবে, কিন্তু পতন হবে না।”
ইজরায়েলের হামলার তীব্রতা ইরানকে প্রথমে হতবাক করলেও, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রেভল্যুশনারি গার্ডের অভিজ্ঞ যোদ্ধারা প্রত্য়াঘাত শুরু করে। তারা ইজরায়েলের দিকে ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা চালায়। তারা চেয়েছেলি, ইরানের সেনাবাহিনী ভেঙে পড়েনি, এই বার্তাটা জনগণ পাক। এরপর ইরান আরও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তেল আভিভের প্রতিরক্ষা সদর দপ্তরের কাছে এবং হাইফার তেল শোধনাগারে আঘাত হেনেছে। ইজরায়েলের তথ্য অনুযায়ী, এই হামলায় ২৩ জন বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের একাংশ, ইরানের চিন্তাধারা বোঝা জরুরি। তিনটি ক্ষেপনাস্ত্র লক্ষ্যে পৌঁছলেও, তাদের কাছে তা জয়। তাদের মতে, ইরান এখনও সংযম দেখাচ্ছে। তারা হরমুজ প্রণালীতে জাহাজের ওপর হামলা করেনি। এই প্রণালী দিয়ে বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্রপথে তেল পরিবহন হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান কোনো তৃতীয় পক্ষকে যুদ্ধে টেনে আনতে চায় না। আবার তারা সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে চায়।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি রোববার বলেছেন, তেহরান “সাহসী সামরিক পদক্ষেপের ফলাফলকে কূটনৈতিক মঞ্চে শান্তিতে রূপান্তর করতে চায়”। তেহরানের বিশ্লেষক সাইদ লায়লাজ বলেন, খামেনি “দুটি কঠিন পছন্দের মধ্যে ঘোরাফেরা করছেন”। তারা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ,সঙ্গে চুক্তি করে পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগ করতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক ভাবে তা হবে “আত্মসমর্পণের” সমান। আর অন্য দিকে তারা লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। সেটাও কার্যত অবাস্তব পরিকল্পনারই নামান্তর।
ইরানের সন্দেহ, ইজরায়েলের হামলার পেছনে মার্কিন ও ইউরোপীয় শক্তির সমর্থন রয়েছে। এক ইরানিয় শীর্ষ কূটনীতিকের মতে, “ইরান এই সংঘাতকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে চায়। তারা যতদিন সম্ভব প্রতিরোধ করতে চায়। সুযোগ পেলে কূটনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতেও রাজি।” কিন্তু এখন পরিস্থিতিতে ইরানের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কি? ওই কূটনীতিক বলছেন, “নেতানিয়াহুর আরও বড় লক্ষ্য রয়েছে।”