পুরুষ প্রবেশ নিষেধ, দশকের পর দশক ধরে এ গ্রামে জয়জয়কার নারীদেরই
Umoja, Women ruled village: পুরুষবর্জিত বটে, তবে পুরুষসঙ্গ বর্জিত নয় এই গ্রাম। বরং নিজেদের চাহিদা, পছন্দ অনুযায়ী পুরুষ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে এ গ্রামের মেয়েদের।
বিশ্বের সমস্ত চিরকল্যাণকর মহান সৃষ্টি যত- 'অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর'। এ ধ্রব সত্য। কিন্তু বাস্তবের মাটিটা কি সত্যিই এত সহজ? সেই অর্ধেক আকাশের অধিকার কি সবসময় মেয়েরা পান? নাকি পুরুষশাসিত সমাজের দাপটের তলায় চাপা পড়ে যায় সে সবটুকু। পুরুষশাসিত সমাজও কি লাগে সবসময়! লাগে না। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বোধহয় মণিপুর। মাতৃতান্ত্রিক মণিপুরে মেয়ের উপর প্রতিনিয়ত যে নিপীড়ন চলছে, তা অভাবনীয়। আসলে কি যৌনচিহ্নই ক্ষমতার পরিচয়মাত্র। প্রশ্ন জাগে বৈকি। চারদিক থেকে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের ছবি দেখতে দেখতে এ কথা মনে না হওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু এই অত্যাচার, দুর্বল ভেবে পদদলিত করে রাখার প্রচেষ্টা কোনও দিন বুমেরাং হয়ে যায়। কেমন দেখতে হবে সেই দেশ? কেমন হবে সমাজ।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতা অলীক স্বপ্ন, তালিবানের অধীনে যেভাবে দিন কাটে আফগানিস্তানের মেয়েদের
২০০৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল 'মাত্রুভূমি' নামে একটি ছবি। 'আ নেশন উইদাউট উওমেন'। আর সেই দেশ যে কতটা ভয়াবহ, কতটা বিভীষিকাময় হতে পারে, তা সবটাই বলা হয়েছে ছবিটিতে। তবু হুঁশ ফেরে না। আজও নির্বিবাদে কন্যাভ্রুণ হত্যা চলে। এমনকী জন্মের পর কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলাও কোনও বড় বিষয় নয়। আইন কানুন প্রশাসন রাশ টানতে পারেনি তাতে। কিন্তু এর ঠিক বিপরীত অবস্থানটা কেমন?
এ গ্রামে পুরুষদের প্রবেশাধিকার নেই একেবারেই। না, তাই বলে সে রাজ্য়ে প্রেম-প্রণয় নেই, সন্তানাদির জন্ম হয় না, এমন ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। তবে এ গ্রামে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের কোনও জায়গা নেই। ফলে আঠারো পেরোলেই ছেলেদের কান ধরে বের করে দেওয়া হয় এই গ্রাম থেকে। ফলে এ গ্রামের সংস্কৃতি, জীবনযাপন সমস্তটাই নারীকেন্দ্রীক। আজ থেকে নয়। সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই এ গ্রাম পুরুষবর্জিত। তবে পুরুষসঙ্গ বর্জিত নয় বটেই।
কাঁটাতারে বেড়া ছোট্ট গ্রাম উমোজা। কেনিয়ার সামবুরো অঞ্চলের ভিতরেই কাঁটাতারে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম। কম করে হলেও আড়াইশো জন মহিলার বাস উমোজায়। হ্যাঁ, শুধু মহিলাই। পুরুষদের প্রবেশ সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ এই গ্রামে। আজ থেকে নয়, গত তিরিশ বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে আফ্রিকার এই প্রত্যন্ত গ্রামে।
কিন্তু কেন? কীভাবে গড়ে উঠল মেয়েদের গ্রাম উমোজা। তার ইতিহাস লম্বা। বিংশ শতাব্দীতে মণিপুরে অসম রাইফেলসের সেনা জওয়ানদের হাতে মনোরমার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল দুনিয়াকে। আর এই ইতিহাস নতুন নয়। নব্বইয়ের দশকে ব্রিটিশ সেনার হাতে ১৫জন ধর্ষিতা একসঙ্গে বসবাস শুরু করে। নিজেদের বঞ্চনা, যন্ত্রণার গাথা ভাগ করে নিয়েছিল একে অপরের সঙ্গে। সেই শুরু। এর পর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হাতে কোণঠাসা মেয়েরা আশ্রয় পেতে থাকে উমোজায়। ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, নিগ্রহ, বঞ্চনা থেকে বাঁচতে মাথা গুজতেন তাঁরা এই উমোজায়। যেখানে পুরুষের চোখরাঙানি নেই, খবরদারি নেই। উঁচিয়ে থাকা পুরুষত্বের খোঁচা নেই। বরং এ সবের বাইরে গিয়ে এক স্বাধীন জীবনের খোঁজ রয়েছে। সেই থেকেই পুরুষবর্জিত উমোজা।
পুরুষবর্জিত বটে, তবে পুরুষসঙ্গ বর্জিত নয় এই গ্রাম। বরং নিজেদের চাহিদা, পছন্দ অনুযায়ী পুরুষ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে এ গ্রামের মেয়েদের। আর সেটাই তাঁদের করে তুলেছে বাকি সকলের থেকে আলাদা। 'মাই বডি, মাই চয়েজ' মন্ত্রের কথা আজকাল প্রায়শই শোনা যায়। গত তিরিশ বছর ধরেই সেই গ্রাম সেই মন্ত্রকেই জীবনধর্ম মেনেছে উমোজা।
শরীর থাকলে তাঁর চাহিদা তো থাকবেই। আর সেই চাহিদাকে কোনও দিন অস্বীকার করেননি এ গ্রামের মেয়েরা। বরং যৌনমিলনের জন্য নিজেদের মতামতকেই প্রাধান্য় দিয়ে থাকেন এ গ্রামের মেয়েরা। প্রয়োজনে পছন্দসই সঙ্গী নির্বাচন করে গ্রামের বাইরে গিয়ে মিলিত হন। জন্ম দেন সন্তানেরও। আর সেই সন্তানকে বড়ও করেন একার হাতে। সে সন্তান যদি মেয়ে হয় তো ভালো। কিন্তু ছেলে হলে ১৮ বছর বয়স হলে তাঁকে ছাড়তে হবে গ্রাম। এটাই ভবিতব্য উমোজায় জন্মগ্রহণ করা ছেলেদের। একে ঢাল বলুন বা বর্ম, এ ভাবেই একেবারে নিজস্ব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে আফ্রিকার এই গ্রাম।
আরও পড়ুন: একদিকে রাস্তায় হাঁটছেন নগ্ন মেয়ে, অন্যপ্রান্তে ২ আদিবাসী তরুণীর গণধর্ষণ, চলছেটা কী মণিপুরে?
অর্থনৈতিক ভাবেও যথেষ্ট সাবালক এই গ্রামের মেয়েরা। জীবনধারনের জন্য কেউ বানান গয়না, কেউ করেন অন্যান্য কাজ। পর্যটকদের কাছে নিজেদের হাতে বানানো সেসব জিনিস বিক্রি করে চলে যায় সংসার। কেউ বা চাষ করেন, কেউ পালন করেন গবাদি পশু। যাই করুন না কেন, নিজেদের কাঁধের জোরেই দিব্যি বেঁচেবর্তে রয়েছেন এ গ্রামের লোকজন, নিজের শর্তে।
উমোজার মতোই সত্যি যদি কোনওদিন এমন উলটপূরাণ হত আমাদের সমাজেও। অত্যাচারিত, কোণঠাসা হতে হতে যদি একদিন নিজেই নিজের পথ খুঁজে নেন মেয়েরা। নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেন পুরুষকে! ঠিক কেমন হবে সেই দিনটা। ভেবে শিহরণ লাগে। দেশ উমোজা হয়ে ওঠার আগে সতর্ক হবে নাকি সমাজ! নিজের সীমানা বেঁধে নেবে নাকি তথাকথিক পুরুষতন্ত্র! নাহলে একদিন না একদিন প্রলয় আসবেই।