এই শীতে গা ছমছমে ঘন জঙ্গলের হাতছানি, ঘুরে আসুন অচেনা ডুয়ার্স

ডুর্য়াস মানে কেবল লাটাগুড়ির জঙ্গল নয়, এর বাইরেও রয়েছে অনেক অফবিট জায়গা, যেখানে আজও সেভাবে মানুষ পৌঁছতে পারেননি।

শীত এল বলে। যাঁরা শহর কিংবা পাহাড়ের প্রচলিত পর্যটন কেন্দ্রের বাইরে গিয়ে একটু নিরিবিলিতে পুজোর ছুটি কাটাতে চান, তাঁদের জন্য জঙ্গলও হতে পারে অবসর যাপনের ঠিকানা। ঘুরে আসতেই পারেন ডুয়ার্স থেকে। ডুয়ার্স নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবুজ প্রকৃতির হাতছানি। নদী, জঙ্গল, বন্যপ্রাণী আর পাহাড়ি গ্রাম নিয়ে এক জম্পেশ আয়োজন সাজিয়ে বসে রয়েছে প্রকৃতি। তবে বাংলায় ডুর্য়াসের দুটো ভাগ, পূর্ব এবং পশ্চিম । সেই পূর্ব ডুর্য়াসেই রয়েছে চিলাপাতা, জলদাপাড়া, খয়েরবাড়ি, বক্সা, জয়ন্তী, রাজভাতখাওয়া, কুমারগ্রাম, এছাড়াও ডুয়ার্সের ট‍্যুরিস্ট সার্কিট ঘেঁষে রয়েছে কোচবিহারের মধুপুরধাম, রসমতী ফরেস্ট, বাণেশ্বর মন্দির ও টোটোপাড়া-সহ নানা জায়গা। রয়েছে ৫৪টির ওপর জনজাতির বাস- রাভা, ওরাওঁ, সাঁওতাল থেকে আরও নানা জনজাতির সংস্কৃতি।

ডুর্য়াস মানে কেবল লাটাগুড়ির জঙ্গল নয়, এর বাইরেও রয়েছে অনেক অফবিট জায়গা, যেখানে আজও সেভাবে মানুষ পৌঁছতে পারেননি। তবুও চিলাপাতা ইক্যোটুরিজম সোসাইটির আহ্বায়ক এবং পর্যটনকর্মী সদ‍্যপ্রয়াত অভীক গুপ্ত চেষ্টা চালাচ্ছিলেন পূর্ব ডুর্য়াসের সৌন্দর্যের দুয়ার ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য খুলে দিতে। যদিও সরকারের তরফ থেকে এখনও সেই অর্থে চিলাপাতা-সহ বাকি পূর্ব ডুর্য়াসের জায়গাগুলো যে যথাযোগ্য সাহায্য পাচ্ছে না, তা উঠে এসেছে তাঁর কথায়।

চিলাপাতা
ডুয়ার্সের অন্যতম বড় বনাঞ্চল এই চিলাপাতা ফরেস্ট। দীর্ঘ তার পরিসর। তোর্সা নদীর পারে রয়েছে এই চিলাপাতা ফরেস্ট। এছাড়াও অনেক ছোট-বড় নদী রয়েছে এই চিলাপাতা জঙ্গলে। কালাচিনি, বুড়িবসরা ও বেনিয়া নদী চিলাপাতার বুক চিরে বয়ে গিয়েছে। মাটির বন্য গন্ধ গায়ে মেখে চিলাপাতার গহিন জঙ্গলের সবটা একদিনে দেখে শেষ করা যায় না। এতটাই বড় এই জঙ্গল যে, বন্যপ্রাণীদের দেখা পেতে সাধনা করতে হয় না। গণ্ডার, হাতি, গাউরের মতো একাধিক জন্তুর দেখা মিলবেই। হরিণ, বাইসন তো রয়েইছে। আবার চিতাবাঘেরও দেখা মিলতে পারে ভাগ্য সদয় থাকলে।

Chilapata

চিলাপাতার জঙ্গলে

চিলাপাতার জঙ্গলের গভীরতা শুধু নয়, পাশাপাশি রয়েছে এই জঙ্গলকে কেন্দ্র করে এক ব‍্যাপক ইতিহাস। এই জঙ্গলকে বলা হয়ে থাকে কোচ রাজাদের মৃগয়াক্ষেত্র। এখানে তাঁরা শিকার করতে আসতেন। কোচরাজার সেনাপতি ছিলেন চিল্লা। তিনি চিলের মতো ছোঁ মেরে শত্রু নিধন করতে পারতেন। তাঁর নামেই এই অরণ্যের নাম রাখা হয়েছিল চিলাপাতা। এখনও এই জঙ্গলে দেখতে পাওয়া যায় কোচ রাজাদের গড়ের ভগ্নাবশেষও। রেঞ্জ অফিস থেকে পারমিট করিয়ে তবে এই জঙ্গলে প্রবেশ করা যায়। সকাল ৫টা থেকে চলে জঙ্গল সাফারি। বিকেল ৫টায় শেষ সাফারি।

অভীকবাবুর কথার প্রসঙ্গ ধরেই জানতে পারা যায় যে, এই অঞ্চলের মধ্যমণি হয়ে রয়েছে চিলাপাতা। এখান থেকেই যাওয়া যেতে পারে কোচবিহার রাজবাড়ি, কোচবিহারের মদনমোহন মন্দির। এছাড়াও রয়েছে আরও অফবিট জায়গা। সেগুলি হলো,

জলদাপাড়া-খয়েরবাড়ি
জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার মাদারিহাট। ২১৬ বর্গকিমিব্যাপী জলদাপাড়া অরণ্যের সেরা আকর্ষণ একশৃঙ্গ গন্ডার। এছাড়াও রয়েছে বাইসন, হগ ডিয়ার, ময়ূর, বুনো শুয়োর প্রভৃতি নানা জীবজন্তু এবং নানা প্রজাতির পাখি ও সরীসৃপ। শাল, খয়ের, শিশু, শিমূল, শিরীষ গাছের ঘন জঙ্গল চিরে বয়ে চলেছে তোর্সা, মালপি, হলং, কালিঝোরা, বুড়ি তোর্সা প্রভৃতি নদী। নদীর জলে রয়েছে নানা প্রজাতির কচ্ছপ আর মাছ। অরণ্যের বড় অংশজুড়ে রয়েছে বিরাট বিরাট ঘাসের বন। মাদারিহাট থেকে গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসা যায় ১০ কিমি দূরের সাউথ খয়েরবাড়ি নেচার পার্ক অ্যান্ড লেপার্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থেকে। খয়েরবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ লেপার্ড সাফারি পার্ক ও টাইগার রেসকিউ সেন্টার। এছাড়াও রয়েছে শালকুমারহাট, ব‍্যাঙডাকি।

টোটো পাড়া
জলদাপাড়া থেকে ২৪ কিমি দূরে আদিবাসী গ্রাম, টোটো পাড়া। অভয়ারণ্য সংলগ্ন টোটো পাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক পর্যটনস্থল। টোটো পাড়া বিশ্বে টোটো উপজাতির একমাত্র আবাসস্থল। বর্তমানে টোটোদের জনসংখ্যা ১০০০ জনের কাছাকাছি।

Totopara

জয়ন্তী নদী

রাজাভাতখাওয়া
নদী, অরণ্যে এবং সবুজ চা বাগানের গালিচার মাঝে মেচ, রাভা, টোটোদের বাস। সবুজ প্রকৃতির মাঝে শান্ত পরিবেশে সময় কাটাতে হলে আসতে হবে এখানে। বক্সা-জয়ন্তী নিয়ে কম-বেশি সকলেই জানি। সেই জয়ন্তীর পাশেই রয়েছে রাজাভাতখাওয়া, মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে। বক্সা টাইগার রিজার্ভের প্রবেশপথও বলা যায়। প্রতি বছর ভ্রমণপ্রেমিকদের ভিড় জমে এখানে। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন, অর্কিড, বন্যপ্রাণী, পাখিভরা এই রাজভাতখাওয়ার ঐতিহাসিক গুরুত্বও কিছু কম নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক যুদ্ধজয়ের কাহিনিও। আর সেই কাহিনি ঘিরেই নামকরণ হয়েছে এই অঞ্চলের। প্রথমে রাজাভাতখাওয়া ছিল কোচবিহার রাজ্যপাটের অংশ। ১৭৬৫ সালে কোচবিহারের সিংহাসনে বসেন ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ। তিনি ছিলেন ১৩তম রাজা। ভুটানের রাজা দেবরাজ ছিলেন তাঁর প্রতিপক্ষ। তিনি ঘোষণা করেন, বক্সার অঞ্চল ভুটানের অন্তর্গত। অঞ্চলের অধিকারের জন্য ভুটানের রাজা দেবরাজ তাঁর সেনাপতি পানসু তমা-কে পাঠান।

কথিত আছে, কোচবিহারের রাজা প্রতিরোধ করেন আর তারপরেই সেনাপতি তাঁকে বন্দি করে প্রথমে বক্সা, তারপর ভুটানের রাজধানী পুনাখা-তে নিয়ে যান। এমতাবস্থায় কোচবিহারের রাজপরিবার রাজাকে উদ্ধার ও রাজ্য রক্ষার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারস্থ হয়। ১৭৭৪ সালে ব্রিটিশ সেনা-কর্তৃক কোচবিহারের রাজাকে উদ্ধার করা হয়। রাজাকে স্বাগত জানাতে রাজপরিবারের তরফ থেকে এই অঞ্চলে এক মহাভোজসমারোহের আয়োজন করা হয়। দীর্ঘ বন্দিদশার পর ফিরছেন রাজা। তাই এই ভোজসমারোহে আয়োজন করা হয় বাঙালি ট্র‍্যাডিশনাল খাবার ভাতের সঙ্গে নানা উপকরণ। আর সেখান থেকেই এই অঞ্চলের নামকরণ হয় রাজাভাতখাওয়া। এই কথাকে স্মরণীয় করার জন্য বন দফতরের তৈরি করা মিউজিয়ামটির গায়ে রাজামশাইয়ের সপার্ষদ সেই ফিরে আসার দৃশ্য আঁকা রয়েছে বড় বড় করে।

নৈসর্গিক দৃশ্য ছাড়া এখানে দেখার মতো হল বন দফতরের তৈরি মিউজিয়াম ও অর্কিড হাউস। এখানে বন থেকে সংগৃহীত নানা ধরনের প্রাণীর ফসিল রাখা রয়েছে। বন্যপ্রাণীর প্রতিকৃতিও রাখা আছে। অর্কিড হাউসে দেখা মেলে নাম না-জানা বহু মূল্যবান অর্কিডের। কিন্তু এই সবকিছুই ছবি তোলা বা স্পর্শ করা নিষিদ্ধ।

এই সুন্দর জায়গাগুলো ঘুরতে চাইলে থাকতে পারেন চিলাপাতায়। থাকা-খাওয়ার খরচা সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যেই। সাধ্যের মধ্যে পূরণ হতে পারে সাধ। খাওয়ার খরচ মাথাপিছু ৫৫০ টাকা এবং থাকার খরচ ১৫০০ টাকা। জঙ্গল ঘেঁষে থাকা চিলাপাতা জঙ্গল ক্যাম্প, চিলাপাতা অঙ্কিত হোমস্টে, নলগড় রিট্রিট, মোহনচূড়া, জলদাপাড়ার অফবিট ডেস্টিনেশন ব্যাঙডাকি-র তোর্সা রাইনো ক্যাম্প, জলদাপাড়া রাইনো কটেজে থাকতে পারেন। হোম স্টে-তে ১২০০-১৬০০ রেঞ্জের মধ্যে ঘর এবং রিসর্টে ১৮০০-২৫০০ রেঞ্জে মধ্যে ঘর পাওয়া যায়।তবে লোকসংখ্যার ওপরেই এই খরচ সাধারণভাবে নির্ভর করে। অফ সিজনে এই খরচ আরও কিছুটা কম হয়। এই সুযোগেই বাড়তি পাওনা হবে কুমারগ্রাম, মধুপুর গ্রাম, রসমতী ফরেস্ট। তবে আর দেরি কেন, এবার পুজো কাটুক প্রকৃতির কোলে।

More Articles