প্রবল প্রেমে মাতোয়ারা হয়েই একে অন্যকে অভিশাপ! কচ ও দেবযানীর যে আখ্যান শিহরণ জাগায়

Mahabharat Kach Devayani: দেবযানী কচকে এ পর্যায়ে প্রেম নিবেদন করলেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু কচ প্রবল অসম্মতি জানালেন।

দেবতাদের গুরুর নাম বৃহস্পতি। আর অসুরদের গুরুর নাম শুক্রাচার্য। দুইজনেই খুব তেজস্বী। তবে বৃহস্পতির তুলনায় দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের একটা গুণ বেশি ছিল। তিনি মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র জানতেন! অর্থাৎ মৃতদের মন্ত্র পড়ে বাঁচিয়ে তুলতে পারতেন। তখন দেবতারা এক বুদ্ধি বের করলেন। আর ঠিক তখনই এক নাটকের আখ্যান আরম্ভ। মহাভারতের পাতায় পাতায় জীবনের বহু চরিত্র এবং অনুভূতি এসে ভিড় করেছে। সেই কতকাল আগে সংস্কৃত ভাষায় লেখা বিশালাকায় একটি কবিতা, আজও তাই কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক! স্বল্পশিক্ষিত গ্রাম্য গৃহবধূ কিংবা বাঘা পণ্ডিত, কেউই মহাভারত থেকে খালি হাতে ফেরেন না। অনাদিকাল ধরে মহাভারতের এই সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অবাক করবার মতোই।

মহাভারতের মূল আখ্যান কুরু-পাণ্ডবের গৃহবিবাদ ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হলেও এর মাঝে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে অসংখ্য উপাখ্যান। প্রেম, বিচ্ছেদ, যুদ্ধ, নিষ্ঠুরতা, চক্রান্ত, কূটনীতি আর প্রগাঢ় ভালোবাসায় আর্বতিত হয়েছে মানব-মানবীর জীবন। সেসব প্রেমের মধ্য থেকে একটি বিশেষ গাথা মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত কচ আর দেবযানীর ঐশি প্রেমের আখ্যান। রবীন্দ্রনাথের কলমের খোঁচায় যা হয়ে উঠেছে লৌকিক এবং মানবিক।

গুরু বৃহস্পতির একটি ছেলে আছে। যেমন সে চেহারায় রূপবান, তেমনই তাঁর ব্যবহার। এই ছেলেটির নাম কচ। কয়েকজন দেবতা বৃহস্পতিকে অনুরোধ করলেন, “আপনার ছেলেকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিন। শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে তাঁর শিষ্য হতে চাইবে। সেখানে শাস্ত্রপাঠ করতে করতে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র শিখে এখানে ফিরে আসবে। তারপর যত যুদ্ধ হবে আমরা মৃতদের বাঁচিয়ে দিতে পারব।” প্রথমে বৃহস্পতি এই প্রস্তাব মানতে চাননি। পরে আর এক দেবতা তাঁকে বোঝান, শুক্রাচার্যের এক মেয়ে আছে, তাঁর সঙ্গে কচ আলাপ করে নিলে, তিনি তাঁকে সাহায্য করতে পারেন। তারপর গল্প মোড় নিল অন্য বাঁকে।

দেবতাদের পরামর্শ মতো হাজার বছরের জন্য কচ পাড়ি জমালেন শুক্রাচার্যের কাছে বিদ্যালাভের আশায়। শুক্রাচার্য কচকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করলেন। গুরু ও গুরুকন্যার সেবা করে কচের ব্রহ্মচর্য জীবন শুরু হলো। কিন্তু এদিকে দেবযানী এবং কচের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। নির্জন বনপ্রান্তর কচ ও দেবযানীর যৌথ সঙ্গতে প্লাবিত হতো। কচ বনের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটি দেবযানীর জন্য তুলে নিয়ে আসতেন।

“হায়,

সুন্দরী অরণ্যভূমি সহস্র বৎসর

দিয়েছে বল্লভছায়া পল্লবমর্মর,

শুনায়েছে বিহঙ্গকূজন- তারে আজি

এতই সহজে ছেড়ে যাবে? তরুরাজি

ম্লান হয়ে আছে যেন, হেরো আজিকার

বনচ্ছায়া গাঢ়তর শোকে অন্ধকার,

কেঁদে ওঠে বায়ু, শুষ্ক পত্র ঝ'রে পড়ে,

তুমি শুধু চলে যাবে সহাস্য অধরে

নিশান্তের সুখস্বপ্নসম?’’

আরও পড়ুন- ভাইদের ছেড়ে পাণ্ডবপক্ষে! ধৃতরাষ্ট্র-পুত্র হয়েও কেন এত অবহেলিত যুযুৎসু

সহস্র বৎসর কেটে গেল। কচ ক্রমশ বাকি দানবদের ক্রোষানলে পড়তে শুরু করলেন। তাঁরা হয়তো কচের এখানে আসার প্রকৃত কারণ অনুমান করতে পেরেছিলেন। কচ একবার সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে গেলে দানবদের একচেটিয়া আধিপত্য টিকবে না। সুতরাং কচকে মেরে ফেলাই ছিল তাঁদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। কচের উপর ছিল শুক্রের গাভীদের দেখাশোনা করবার ভার। একদিন বিকেলে, কচ বনে গরু চরানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগে দানবেরা কচকে মেরে ফেলে, তাঁর মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করে কুকুরকে খাইয়ে দেয়।

সূর্য অস্ত গেল। গরুর দল ঘরে ফিরে এল। কচকে না দেখে দেবযানী দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। শুক্রের কাছে গিয়ে নিজের আশঙ্কার কথা জানালেন দেবযানী। দেবযানী ধারণা করতে পারছিলেন, হয়তো কচকে কোনওভাবে হত্যা করা হয়েছে। শুক্রাচার্য সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করলেন। তিনবার “এসো, কচ” বলে আহ্বান করতেই কুকুরের শরীর ভেদ করে অক্ষত শরীরে কচ উপস্থিত হলেন। প্রাণ ফিরে পেয়ে কচ আবার গুরুসেবায় মন দিলেন।

কিন্তু দানবরা এত সহজে ক্ষান্ত হলেন না। একদিন দেবযানীর খোঁপার জন্য এক বিশেষ ধরনের ফুল প্রয়োজন। কচ ফুল সংগ্রহে ক্রমশ গভীর বনে এগিয়ে যেতে থাকলেন। সেখানে অসুররা আবার কচকে হত্যা করে এবং তাঁর হাড়-মাংস ছুঁড়ে ফেলে দেয় সমুদ্রে। এবারও কন্যার করুণ আকুতিতে শুক্রাচার্য কচকে প্রাণদান করলেন।

পরপর দু’বার এরকম নিদারুণ ব্যর্থতা দানবদের ভাবিয়ে তুলল। এবার কচকে মেরে তাঁর মৃতদেহের ছাই সোমরসের সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রাচার্যকেই খাইয়ে দিলেন দানবরা। সোমরস হলো মদ, মাংস ও ঘি দিয়ে বানানো একপ্রকার পানীয়। সমাজের উঁচুতলার মানুষদের জন্য এ পানীয় নিন্দনীয় ছিল না সেকালে। দেবযানী পিতার কাছে কচের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন আবারও। শুক্রাচার্য কন্যাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, মৃত ব্যক্তির জন্য বারবার বিলাপ অনর্থক। তবু দেবযানীকে কোনওক্রমেই থামানো যাচ্ছিল না। দেবযানী জানালেন, কচকে ফিরে না পেলে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন।

শুক্র ধ্যানে বসে দেখলেন, কচ তাঁরই উদরে। কচের কাছে থেকে সব ঘটনা শুনলেন। কচের উপর এবার সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করলে কচ তাঁর উদর ভেদ করে বেরিয়ে আসবেন। তাতে শুক্রাচার্য নিজেই মারা যাবেন। আবার কচকে না বাঁচালে তাঁর দ্বারা ব্রাহ্মণহত্যা হবে। এদিকে তাঁর আদরের কন্যাটিও কচের শোকে মুহ্যমান। দেবযানীর সামনে প্রবল ধর্মসংকট। পিতার জীবনের বিনিময়ে তিনি প্রেমিকের জীবন চাইতে পারেন না। আবার যেকোনও একজনের মৃত্যুই তাঁর কাছে নিজের মৃত্যুতুল্য। দেবযানী শোকে স্তম্ভিত হয়ে রইলেন।

অবশেষে শুক্রাচার্য নিজের উদরে থাকা কচকে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শেখালেন, যাতে মৃত্যুর পর কচ আবার তাঁকে জীবিত করে তুলতে পারেন। গুরুর পাকস্থলী থেকে বের হয়ে কচ এই বিদ্যা প্রয়োগ করে শুক্রাচার্যকে নবজীবন দিলেন। এরপর আরও বহু বছর কচ গুরুগৃহে বিদ্যাচর্চায় কাটালেন।

হাজার বছর কেটে গেল। কচের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এল। দেবযানী কচকে এ পর্যায়ে প্রেম নিবেদন করলেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু কচ প্রবল অসম্মতি জানালেন। তাঁর যুক্তি ছিল, যেহেতু তিনি শুক্রাচার্যের শরীর থেকে নবজীবন লাভ করেছেন, সেহেতু দেবযানী তাঁর বোনের মতো। এ বিয়ে ধর্মসঙ্গত হতে পারে না। তাছাড়া তিনি ইন্দ্রপুরী থেকে বিশেষ কাজ নিয়ে এসেছেন।

এখানে উল্লেখ্য, নারীর প্রেমপ্রস্তাব হিন্দু পুরাণের বিভিন্ন জায়গায় প্রত্যাখ্যাত হতে দেখা গেছে। শূর্পনখার প্রেম প্রত্যাখান করেছেন লক্ষণ এবং তাঁর নাক কেটে নিয়েছেন, উর্বশীর আহ্বান অবলীলায় অস্বীকার করেছেন অর্জুন, পার্বতীর আকুতিতে শুরুতে শিব খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না। এসব ঘটনা আদতে সমাজে পুরুষের ‘মহত্ব’ প্রচার করে। ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা ও প্রেমের চাইতে পুরুষ কর্তব্যকেই এগিয়ে রাখে, এ বাণীই মূলত এসব আখ্যানের মধ্যে দিয়ে প্রচার করা হয়।

আরও পড়ুন- মহাভারতে সতীত্বের কোনও চিহ্ন নেই, বলেছিলেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত

গল্পের শেষটা কাটে অভিশাপ আর বেদনায়। তবে দেবযানী এখানে আর্দশ ভারতীয় নারীর সেই তথাকথিত রূপটি পালন করেন না, যে নারী যাবতীয় অবমাননা নীরবে সহ্য করে। তিনি কচকে অভিশাপ দেন, তিনি কখনই সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারবেন না। শুধুমাত্র অপরকে শেখাতে পারবেন। হাজার বছর ধরে অর্জিত বিদ্যার ভারবাহক হয়ে থাকতে হবে তাঁকে। কচ ও দেবযানীর প্রেম মহাভারত পেরিয়ে সমকালের আলোয় আধারিত। তাই তো আজকের লেখকদের লেখাতেও আলোড়িত।

প্রমনাথ বিশী একবার বলেছিলেন, “দেবযানী প্রাচীনতম মর্ডান উইমেন।” এই অভিশাপে ক্রোধান্বিত হয়ে কচও পাল্টা অভিশাপ দেন, দেবযানীর কখনই ব্রাহ্মণ পুত্রের সঙ্গে বিয়ে হবে না। তাঁর বিয়ে হবে ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে। এ ‘অভিশাপ’ দেবযানীর পরবর্তী জীবনে সত্যি হয়েছিল।

এ কাহিনি নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩০০ বঙ্গাব্দে রচনা করেন ‘বিদায় অভিশাপ’ কাব্যনাট্য। মহাভারতের একাধিক আখ্যান ও চরিত্র রবীন্দ্রসাহিত্যে দেখতে পাওয়া যায়। এ গল্পের শেষের অংশ অবশ্য তিনি বদলে দেন। দেবযানীর অভিশাপ দেওয়া পর্যন্ত গল্প প্রায় ব্যাসদেবের মহাভারতের সঙ্গে মিলে যায়। তবে অভিশাপের বদলে কচকে দিয়ে তিনি প্রচার করেন প্রেমের চিরন্তন বাণী। কচ স্বর্গে ফিরে যাওয়ার আগে দেবযানীর নিখাদ মঙ্গলকামনা করেন। নিজে অভিশাপে জর্জরিত হয়েও কচ বলে ওঠেন,

“আমি বর দিনু, দেবী তুমি সুখী হবে-

ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে”

 

কৃতজ্ঞতা:

আমাদের মহাভারত-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

roarmedia

More Articles