রাজাদের সবাইকে জয় করার পর রাবণ প্রবৃত্ত হলেন সব দেবতাদের জয় করার কাজে।
রাবণকে তুলে পালকের মতো লোফালুফি খেলেছিল মেয়েরা! অবাক করবে এই অজানা কাহিনি
Myths of Ravana: রাবণ সেই গর্ত দিয়ে পাতালে গিয়ে দেখলেন, সেই পুরুষ একটি খাটে শুয়ে আছেন। এই দেখে রাবণ যেই নতুন কিছু করার বুদ্ধি আঁটছেন, ওমনি সেই পুরুষ অট্টহাস্য করে উঠলেন।
রামায়ণে খলনায়ক হিসেবে আঁকা হয়েছে রাবণের চরিত্রটি। রাবণের বিষয়ে কথা এটুকু সবাই জানে যে, লঙ্কাধিপতি রাবণ সীতাহরণ করেছিলেন এবং সেই সূত্র ধরেই অবতারপুরুষ রামচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ঘোরতর যুদ্ধ হয়। রাবণ এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং পৃথিবী ভারমুক্ত হয়। কিন্তু রাবণের নাম রাবণ কী করে হলো, বা রাবণের আরও কী কী কীর্তি আছে, তা অনেকেরই অজানা। রাবণ তো ছিলেন মুনিপুত্র। তিনি যখন জন্মেছিলেন তখন তাঁর নাম রাবণ ছিল না, ছিল দশগ্রীব। তাঁর দশটি মাথা দেখেই পিতা এই নামটি রেখেছিলেন। এই রাবণ বা দশগ্রীবের তিন ভাই, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ আর কুবের। যাই হোক, ছোটবেলায় একবার দশগ্রীব ভাইদের নিয়ে ব্রহ্মার ঘোরতর তপস্যা করেছিলেন। তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা যখন তাঁকে বর দিতে এলেন, দশগ্রীব একেবারে অমর হওয়ার বরটিই চেয়ে বসলেন। কিন্তু অমর হওয়ার বর তো তাঁকে ব্রহ্মা দিতে রাজি নন। তাই দশগ্রীব বললেন, দানব দৈত্য, যক্ষ, নাগ, পক্ষী কেউই যেন তাঁকে হারাতে না পারে। নর আর বানরের কথাটি মনে হয় তিনি ইচ্ছে করেই বলেননি। শেষ পর্যন্ত নর ও বানরের হাতেই দশগ্রীবের পরাজয় ঘটেছিল।
যাই হোক, ব্রহ্মা তো তাঁকে অজেয় করে দিলেন। এবার শুরু হলো দশগ্রীবের নানা কর্মকাণ্ড। প্রথমেই তিনি তাঁর দাদা কুবেরের থেকে লঙ্কাপুরী নামের পুরীটি নিয়ে নিলেন। তারপরেই নিলেন তাঁর বিখ্যাত পুষ্পক নামের রথ। এরপরেই দশগ্রীব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ত্রিভুবন বিজয়ে। ব্রহ্মার বরে তিনি অপরাজেয়, তাই ত্রিভুবনের কেউই তাঁর সঙ্গে বিশেষ এঁটে উঠতে পারছিলেন না। ফলে যা হয়, দশগ্রীবের অত্যাচারে ত্রিভুবন একেবারে বিপর্যস্ত! একবার দশগ্রীবকে নিয়ে পুষ্পক রথ এসে উপস্থিত হলো পর্বতের উপর অবস্থিত স্বর্গের পবিত্র শরবনে। সেই সময়, সেখানে যেহেতু শিব-পার্বতী ছিলেন, পুষ্পক রথ সেখানে প্রবেশ করতেই পারল না। এবার দশগ্রীব যখন এই সমগ্র ব্যাপারটিতে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেছেন , ঠিক তখনই তাঁর সামনে এল শিবের অনুচর নন্দী। এবার শুরু হলো এক অদ্ভুত টানাপড়েন! নন্দীও দশগ্রীবকে শরবনের ভিতরে যেতে দেবে না, আর দশগ্রীবও না গিয়ে ছাড়বেন না। দশগ্রীব তো ত্রিভুবনে কারও কাছে হারবেন না, তিনি নন্দীর সঙ্গে যাচ্ছেতাই রকমের ঝগড়া করে শরবনের পুরো পর্বতই হাত দিয়ে উপড়ে ফেলার উপক্রম করলেন। তাঁর টানের চোটে পুরো পর্বত টলমল করতে লাগল কিন্তু পর্বতের উপর মহাদেব একটুও বিচলিত হলেন না। তিনি পা দিয়ে পর্বতটিকে সামান্য চেপে দিলেন মাত্র। ব্যাস! আর যায় কোথায়, পর্বতের তলায় দশগ্রীবের হাত গেল চাপা পড়ে। দশগ্রীব তো চিৎকার করে অস্থির, তিনি নাকি হাজার বছর ওই রকম চিৎকার করেছিলেন আর মহাদেবের কাছে মিনতি করেছিলেন। শেষ অবধি মহাদেবের দয়া হলো। তিনি দশগ্রীবকে তো ছেড়ে দিলেনই, উপরন্তু, তাঁকে দিলেন চন্দ্রহাস নামের তলোয়ার আর একটি নতুন নাম- 'রাবণ', যে নাম তাঁর ত্রিভুবন বিখ্যাত।
আরও পড়ুন- বাল্মীকির দায়সারা চরিত্র! যেভাবে রামের হাতে মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিল অনার্য মারীচ
এবার তো শিবের বর পেয়ে রাবণকে পায় কে! তিনি পৃথিবীর সব রাজাকে জয় করার কার্যে নেমে পড়লেন। প্রথমেই তিনি জয় করলেন উষীরবীজের রাজা মরুত্তকে। সেখানে অবশ্য জয় করার মতো কিছু ছিল না। রাজা মরুত্ত যজ্ঞ করছিলেন আর যুদ্ধ করলে পাছে যজ্ঞ নষ্ট হয়ে যায়, সেই কারণে গুরুর আদেশে তিনি যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু রাবণ তো মনে করলেন তিনি জিতেই গেছেন। এবার প্রায় সব বড় বড় রাজারাই হেরে যাচ্ছিলেন রাবণের কাছে। কিন্তু একজন রাজার নাম করতেই হয় যিনি রাবণের কাছে পিছু হটে যাননি। তিনি অযোধ্যার রাজা অনরণ্য। তিনি হেরে যেতে যেতেও বলেছিলেন, তাঁদের বংশে দশরথের পুত্র রাম জন্মাবেন, সেই রামের হাতেই রাবণের মৃত্যু হবে।
যাই হোক, রাজাদের সবাইকে জয় করার পর রাবণ প্রবৃত্ত হলেন সব দেবতাদের জয় করার কাজে। যম, বরুণ, সূর্য সবাইকেই তিনি হারিয়ে দিলেন। কিন্তু আদতে কি তিনি সবাইকে হারিয়ে দিয়ে ত্রিভুবন বিজেতা হতে পেরেছিলেন? একেবারেই না। কিছু কিছু জায়গায় তিনি একেবারে দারুণ জব্দ হয়ে গিয়েছিলেন। একবার হয়েছে কী, রাবণ পশ্চিম সমুদ্রের একটি দ্বীপে গিয়ে এক আগুনের মতো তেজস্বী পুরুষকে দেখতে পেলেন। রাবণের তো সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করাই স্বভাব, তাই তিনি সেই পুরুষের কাছেও যুদ্ধ আহ্বান করে বসলেন। সেই পুরুষ তেমন উচ্চবাচ্য করছেন না দেখে রাবণ তো চটে গিয়ে তাঁর উপর ভারী ভারী অস্ত্র নিক্ষেপ করতে লাগলেন। তাতে সেই অগ্নিময় পুরুষের তো কিছু হলোই না, উলটে তিনি রাবণকে দু'হাতে ধরে এমন চাপ দিলেন যে, তাতেই রাবণের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এতেই শেষ নয়, এরপর তাঁকে মাটিতে ফেলে দিয়ে সেই পুরুষ পাতালে চলে গেলেন। এদিকে রাবণ কিছুক্ষণ মাটিতে পড়ে থেকে তারপর উঠে সেই পুরুষটির খোঁজ করায় তাঁর রাক্ষসসেনা তাঁকে একটি গর্ত দেখিয়ে দিয়ে বলল, এই গর্ত দিয়েই সেই পুরুষ পাতালে চলে গেছেন। রাবণ সেই গর্ত দিয়ে পাতালে গিয়ে দেখলেন, সেই পুরুষ একটি খাটে শুয়ে আছেন। এই দেখে রাবণ যেই নতুন কিছু করার বুদ্ধি আঁটছেন, ওমনি সেই পুরুষ অট্টহাস্য করে উঠলেন। সেই হাসিতেই রাবণের মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম। যাই হোক, সেই উজ্জ্বল পুরুষ ছিলেন কপিল, তিনি রাবণকে ছেড়ে দিলেন একটি কথা বলেই, ব্রহ্মা তো রাবণকে অমর হওয়ার বর দিয়েছেন, তাই আর তাঁকে বধ করা হলো না। সেবার রাবণ খুব জব্দ হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- শকুন্তলা মানেই, নরম, স্নিগ্ধ, কোমলমতি? অবাক করবে ‘আসল’ শকুন্তলার কাহিনি
রামায়ণ পড়ার সুবাদে কিষ্কিন্ধ্যার বানর রাজা সুগ্রীবকে তো আমরা সবাই চিনি। সুগ্রীবের দাদা যে বালী, তাও অনেকেই জানেন। এই বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েই রাবণ একবার খুব জব্দ হয়েছিলেন। রাবণের তো তখন খুবই অহঙ্কার, তিনি বীরের সন্ধান পেলেই তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ আহ্বান করছেন। এবার বীর বালীর সন্ধানে কিষ্কিন্ধ্যায় গিয়ে রাবণ তো যুদ্ধ করার জন্য একেবারে অধীর হয়ে উঠলেন। কিন্তু কিষ্কিন্ধ্যার লোকেরা তাঁকে জানায় যে, বালী গেছেন দক্ষিণ সাগরের সন্ধ্যাবন্দনায়। রাবণ সেখানে উপস্থিত হয়ে ভাবলেন, এই সন্ধ্যাবন্দনারত নিরস্ত্র অবস্থাতেই বালীকে ধরে ফেলা যাক, তাহলেই তিনি জিতে যাবেন। এই ভেবে যেই না তিনি বালীকে জাপটে ধরতে গেছেন, ওমনি বালীই তাঁকে ধরে ফেলে চেপে ধরলেন হাতের নীচে। রাবণের তো চাপের চোটে ছটফট করতে করতে প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। বালীর তাতে কোনও হেলদোল নেই, তিনি রাবণকে ওভাবে নিয়েই বাকি সন্ধ্যাবন্দনাটুকু ধীরে সুস্থে সেরে ফেলে তারপর তাঁকে মুক্তি দিলেন। বালীর বীরত্ব মুগ্ধ হয়ে আর বলাবাহুল্য, বালীর কাছে জব্দ হয়ে রাবণ বালীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেললেন ঠিকই কিন্তু তাঁর বীরদের যুদ্ধে আহ্বান করার অভ্যাস গেল না।
একদিন দেবর্ষি নারদের সঙ্গে রাবণের দেখা হওয়াতে, রাবণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, যুদ্ধ করা যাবে এমন বীর কোথায়? দেবর্ষি তাঁকে বললেন, ক্ষীরোদ সমুদ্রে শ্বেতদ্বীপ নামে এক আশ্চর্য দ্বীপ আছে, সেখানকার লোকেরা নাকি যেমন ধার্মিক তেমনি বলবান। রাবণ তো শুনে মহাখুশি। কিন্তু হয়েছে কী, সেই দ্বীপে পৌঁছতেই তো দ্বীপের তেজে রাক্ষসসেনারা মুহ্যমান হয়ে গেল! পুষ্পকরথ তো সেখানে ঢুকতেই পারল না, শেষে রাবণ নিজেই ওই দ্বীপে একা প্রবেশ করলেন। এখন হয়েছে কী, সেই দ্বীপে কয়েকটি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রাবণের দশটি মাথা, কুড়িটি হাত সম্বলিত চেহারা দেখে তাঁদের খুব কৌতূহল হওয়াতে তাঁরা গিয়ে রাবণের পরিচয় জিজ্ঞাসা করল। রাবণ শুনে রেগে গিয়ে যেই নিজের পরিচয় বললেন, মেয়েরা হঠাৎ দারুণ মজা পেয়ে গিয়ে রাবণকে পালকের মতো মাথার উপর তুলে লোফালুফি খেলতে শুরু করে দিল। যুদ্ধ করতে এসে রাবণের তো প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। এই লোফালুফি খেলতে খেলতে শেষ পর্যন্ত রাবণের ঠাঁই হলো সমুদ্রের জলে। এর পরে মনে হয় রাবণের যুদ্ধের সাধ একটু হলেও মিটেছিল।
তথ্যসূত্র-
১) উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র
২) রামায়ণ- কৃত্তিবাস ওঝা