গোরখনাথের অভিশাপ না ষড়যন্ত্র? নিজের বাবাকে সত্যিই খুন করেন নেপালের যুবরাজ?
Nepal King Birendra Murder Mystery: যদি সত্যিই দীপেন্দ্র হত্যাকারী হন, তাহলে সেই অভিশপ্ত রাত্রে কেনই বা প্রত্যক্ষদর্শীরা একাধিক দীপেন্দ্র সদৃশ ব্যক্তিকে নারায়ণহিতি প্যালেসে দেখতে পেলেন?
অন্ধকার রাত্রি পেরিয়ে সকাল তো রোজই হয়।তবে সবসময়ই কি সেই সকাল আমাদের মনমতো হয়? হয় না। কখনও কখনও জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মতো বলতে ইচ্ছে করে, "এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার"।এমনই একদিন ছিল ২০০১ সালের ২ জুন। ওইদিন ৫৬,৯৫৬ বর্গমিটারের ছোট্ট দেশ, হিমালয়কন্যা নেপালের হতবিহ্বল জনতা বিশ্বাসই করে উঠতে পারছিল না যে, ঠিক আগের অর্থাৎ ১ জুন রাতে সপরিবারে নিহত হয়েছেন শাহ বংশের দশম রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব! তাও আবার তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খোদ যুবরাজ দীপেন্দ্রর হাতে!
স্থানীয় সময় তখন আনুমানিক রাত ন'টা। নেপালের রাজার বাসস্থান নারায়ণহিতি দরবারে নৈশভোজের জন্য মিলিত হয়েছেন রাজপরিবারের অধিকাংশ সদস্য। ভোজসভায় আরও বাকি সদস্যের মতো উপস্থিত ছিলেন ২৯ বছরের যুবরাজ দীপেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব নিজেও। নৈশভোজ চলাকালীন হঠাৎই তাঁর নিয়ে আসা সাবমেশিনগানের গুলিতে একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাজা বীরেন্দ্র, রানি ঐশ্বর্য, রাজা বীরেন্দ্রর কনিষ্ঠ পুত্র যুবরাজ নির্জন, কন্যা শ্রুতি, রাজার ছোটভাই যুবরাজ ধীরেন্দ্র সহ রাজপরিবারের একাধিক সদস্য। হত্যালীলা শেষ করে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন যুবরাজ দীপেন্দ্র। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।সম্পূর্ণ কোমায় চলে গেলেও তাঁকেই নেপালের রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অবশেষে ৪ জুন তিনি মারা যান। তখন রাজা বীরেন্দ্রর অপর এক ভাই জ্ঞানেন্দ্র রাজা হন।
আরও পড়ুন- নেপালে পূজিত সতীর ‘যোনি’ নিঃসৃত তরল! বৌদ্ধদের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ গুহ্যেশ্বরী শক্তিপীঠ
ওইদিন প্রাসাদের বাইরে পোখরায় থাকার জন্য নেপালের শেষ রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব প্রাণে বেঁচে যান। এর আগেও একবার পাঁচের দশকে রাজা নির্বাচিত হয়েছিলেন নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। তাঁর স্ত্রী, নেপালের সর্বশেষ মহারানি কোমল গুলিতে আহত হলেও রাজপরিবারের গুটিকয়েক সদস্যের সঙ্গে প্রাণে বেঁচে যান। নেপালের রাজা মহেন্দ্রর পর উত্তরাধিকার সূত্রে যখন তাঁর বড় ছেলে বীরেন্দ্র নেপালের রাজা রূপে অধিষ্ঠিত হন তখন থেকেই নিজের কাজের মাধ্যমে তিনি নেপালের জনগণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আশি শতাংশের উপর হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যার দেশে তিনি বিষ্ণুর অবতার রূপেই পূজিত হতেন নেপালি জনমানসে। শাসনকাঠামোর ভুলত্রুটি শুধরে নেপালকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী এই রাজা বীরেন্দ্র। কর্তব্যের খাতিরে নয়, নেপালের সর্বাঙ্গীন উন্নতিসাধনের লক্ষ্যে তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই আন্তরিক। তাই তো যুবরাজ থাকাকালীন যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরার পর আমোদপ্রমোদে গা না ভাসিয়ে, নিজের বংশপরিচয়ের জন্য অহংকারী না হয়ে অত্যন্ত নম্র হয়ে পুরো নেপাল পরিদর্শন করতে বেরোতেন। পায়ে হেঁটে চষে বেড়াতেন নেপালের প্রত্যন্ত থেকে প্রত্যন্ত অংশে।
সার্ক প্রতিষ্ঠা ও সার্কের সদর দপ্তর কাঠমাণ্ডুতে স্থাপন করার আড়ালেও তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। পরাশক্তি চিন ও বন্ধুপ্রতিম ভারতের মধ্যে অবস্থিত ল্যান্ডলকড নেপালের সঙ্গে বিশ্বের বাকি দেশগুলির কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেও তিনি ছিলেন সচেষ্ট। তাঁর আমলেই নেপাল নতুন করে আরও ৪৬টি দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, এত জনপ্রিয় এক রাজার সঙ্গে এরকম মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল কেন? আসলে রাজমুকুটের তোয়াক্কা তিনি কোনওদিনই করতেন না। পিতা মহেন্দ্রর পর তিনি যখন সিংহাসনে আসীন হন নেপালে পূর্ণ রাজতন্ত্রই বহাল ছিল। রাজা মহেন্দ্রর ঘোষণা অনুযায়ী নেপালের তিন স্তম্ভ হিন্দুধর্ম, নেপালি ভাষা ও রাজা। কিন্তু রাজা বীরেন্দ্র নিজের হাতের ক্ষমতা নিজেই শিথিল করে শুনতেন নেপালি জনগণের কথা। পূর্ণ রাজতন্ত্র রদ করে নেপালে কায়েম করেন সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। শোনা যায়, এই সিদ্ধান্তে অখুশি ছিলেন যুবরাজ দীপেন্দ্র। তিনি চেয়েছিলেন পূর্ণ রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে। আর এই মতানৈক্যই তাঁকে বাধ্য করেছিল পিতাকে হত্যা করতে।
তদন্ত কমিশন বসানোর পরেও এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ আজ পর্যন্ত অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি। সেই জন্যই প্রকৃত কারণ নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। অনেকের মতে, এই হত্যাকাণ্ডের আড়ালে ছিল যুবরাজ দীপেন্দ্রর বিবাহ নিয়ে যুবরাজের সঙ্গে রাজপরিবারের মতানৈক্যও। তিনি বিবাহ করতে চেয়েছিলেন গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজপরিবারের আত্মীয় নেপালেরই রানা রাজবংশের কন্যা দিব্যানী রানাকে। তাঁদের বংশমর্যাদার সঙ্গে খাপ না খাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত তাঁর পরিবার মেনে নিতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের রাতে নৈশভোজের টেবিলে এই নিয়ে বাকবিতণ্ডা চলাকালীন এক পর্যায়ে গুলি চালানো শুরু করেন দীপেন্দ্র। অনেকে এই সম্ভাবনাকে খারিজ করে সন্দেহের চোখে দেখেন রাজা বীরেন্দ্রর ভাই জ্ঞানেন্দ্রর ভূমিকাকেও। তিনি কেন সেইদিন নৈশভোজে উপস্থিত ছিলেন না বা তাঁর পরিবারের কেউ কেন নিহত হলেন না এই প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ। সেদিনের এক প্রত্যক্ষদর্শী, দীপেন্দ্রর দেহরক্ষী লাল বাহাদুর মাগার এই পুরো হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করেছিলেন জ্ঞানেন্দ্রর পুত্র যুবরাজ পারসকে। শোনা যায়, সেদিন দীপেন্দ্রর মুখোশ পরে অন্য কেউ এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিল। পরবর্তীকালে দীপেন্দ্র হাসপাতালে কোমায় থাকাকালীন যুবরাজ পারসই তাঁকে হত্যা করে এবং এই পুরো ঘটনাটির সঙ্গে নেপালের সেনাবাহিনীর একাংশও জড়িত।
আরও পড়ুন- নেপালের তাণ্ডবলীলা থেকে সুমাত্রার বিধ্বংসী সুনামি, যে ভয়াবহ ভূমিকম্পগুলি কাঁপিয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে
বহুল আলোচিত মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে নানান লোককথাও। অনেক কুলক্ষণও নাকি এই দুর্ঘটনার আগে পরপর ঘটে যাচ্ছিল। রাজপ্রাসাদের বাগানে অস্বাভাবিকভাবে কমে এসেছিল বাদুড়ের সংখ্যা যা নেপালে অশুভ বলে মনে করা হয়। হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পরে নেপালের এক জনপ্রিয় দৈনিকে দাবি করা হয়, নেপালের ভীমেশ্বর মহাদেবের মূর্তিটি দুর্ঘটনার চারমাস আগে থেকেই অলৌকিকভাবে ঘামতে শুরু করেছিল। তবে যাই হোক না কেন, নেপালের জনগণ আজও বিশ্বাস করতে চান না যে তাদের প্রিয় রাজার হত্যাকারী স্বয়ং যুবরাজ। তারা হিসেব মেলাতে পারেন না অনেক কিছুরই। যদি সত্যিই দীপেন্দ্র হত্যাকারী হন, তাহলে সেই অভিশপ্ত রাত্রে কেনই বা প্রত্যক্ষদর্শীরা একাধিক দীপেন্দ্র সদৃশ ব্যক্তিকে নারায়ণহিতি প্যালেসে দেখতে পেলেন? আত্মহত্যার চেষ্টা করা যুবরাজ ডানহাতি দীপেন্দ্র কী করেই বা রাইফেল দিয়ে মাথার বামদিকে গুলি চালালেন? তিনি যদি সকলকে নৈশভোজের টেবিলেই হত্যা করেন তাহলে রাজপরিবারের সদস্যদের মরদেহগুলি প্রাসাদের একাধিক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কীভাবে? যখন আহত যুবরাজকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখনও প্রাসাদের ভিতর থেকে গুলি চালানোর শব্দের রহস্যই বা কী? উত্তর মেলে না অনেক কিছুরই।
মনে পড়ে যায়, বহু যুগ আগে পুরো নেপালকে একসূত্রে বাঁধা নেপালের প্রথম রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহের উপর গোরখনাথের অভিশাপের কথা। জঙ্গলে সাক্ষাৎ হওয়া এক যোগী যখন নিজের মুখনিঃসৃত দই তাঁকে খেতে বলেন তখন তিনি তা ঘৃণাভরে ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দেন। তা তাঁর নিজের পায়ের দশটি আঙুলে ছিটকে আসে। ক্রুদ্ধ যোগী রাজাকে অভিশাপ দেন, তাঁর পায়ের যতগুলি আঙুলে সেই দই লেগে রয়েছে সেই দশ প্রজন্মের পরেই তাঁদের রাজত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। কাকতলীয়ভাবে রাজা বীরেন্দ্রই ছিলেন শাহ বংশের দশম রাজা। দীপেন্দ্রর পরে জ্ঞানেন্দ্র পাঁচের দশকের পর পুনরায় রাজা হলেও রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটল।প্রাচীন অভিশাপ বা ষড়যন্ত্রকারীর বুলেট, সেদিনের সেই হত্যাকাণ্ডের আড়ালে কারণ যাই থাকুক না কেন, ঐতিহ্যবাহী শাহ রাজবংশের রাজা বীরেন্দ্রর হত্যাকাণ্ড চিরকালই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে শোকস্তব্ধ করে তুলবে।