তোপ দেগে আজও পুজো শুরু হয় মল্লভূম আর সামন্তভূমে, যে ইতিহাস জড়িয়ে এই দুই পড়শি-পুজোয়

Durga Puja 2024: বাঁকুড়ার ছাতনা রাজবাড়ির দুর্গা কিন্তু অন্যান্য বাড়ির পুজোর মতো দশমীর দিন বিদায় নেন না। এই বাড়ির পুজোয় বিসর্জন হয় কোজাগরী পূর্ণিমা তথা লক্ষ্মী পুজোর দিন।

সেই রাজাও নেই, নেই সেই রাজত্বও। তবে রাজত্ব না থাকলেও ঐতিহ্যে পড়েনি ছেদ। আজও সমস্ত প্রাচীন রীতি ও ইতিহাস মেনেই পুজো আসে মল্লভূমে। মল্লভূম বললে অবশ্য এখনও অনেকেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করবেন। মূলত মল্লগড় বা মল্লভূম বলতে বোঝানো হয় বিষ্ণুপুরকেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির দুর্গাপুজো এবং বাঁকুড়ার ছাতনা রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর নিয়ম নাকি হুবহু এক। হবে না-ই বা কেন? এই দুই পুজোর মধ্যে রয়েছে এক গভীর যোগাযোগ।

জানা গিয়েছে, সামন্তভূম ছাতনা এবং মল্লভূম বিষ্ণুপুরের মধ্যে ঘোর বিবাদ বেঁধেছিল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অন্যতম রত্ন ছাতনার ভূমিপুত্র চারণকবি বড়ু চণ্ডীদাসকে কেন্দ্র করে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের পরেই বড়ু চণ্ডীদাস রচিত 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে'র স্থান। রচনাকাল সঠিকভাবে নির্ণীত না হলেও এটিকে
প্রাকচৈতন্য যুগের (খ্রিস্টীয় ১৪০০ শতক) মনে করা হয়। কথিত আছে সেই দুই রাজপরিবারের বিবাদ মিটেছিল দৈববাণীর মধ্যে দিয়ে। বিবাদ মেটাতে সন্ধি হয়। কথিত আছে সন্ধিতে উল্লেখ করা ছিল সামন্তভূমের কুলদেবী মা বাসুলি বা দেবী মনসা পুজিত হবেন বিষ্ণুপুরে এবং মল্লভূমের মা মৃন্ময়ীর আরাধনা হবে সামন্তভূম ছাতনায়। তখন থেকেই শুরু ছাতনা রাজবাড়ীর বিষ্ণুপুরি আদলে দুর্গোৎসবের সূচনা এখানে। সামন্তভূম ছাতনার সুবিশাল রাজবাড়ি আজও রয়েছে। আছেন রাজাও। পারিবারিক রীতি মেনে তিনি নিজের হাতেই মা দুর্গার পূজা করেন। বিষ্ণুপুরের মা মৃন্ময়ীর আদলেই তৈরি হয় ছাতনা রাজবাড়ির প্রতিমা।

আরও পড়ুন: রক্তবর্ণা দেবী, বিশালাকার অসুর! কোচবিহারের বড়দেবীর পুজোর ইতিহাস চমকে দেবে

প্রায় একই রকম ভাবে কামান দেগে শুরু হয় দুই রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। কথিত আছে, কোনও এক সময় বিষ্ণুপুরের রাজার কাছে ছাতনার রাজা দৈব সন্ধির শর্ত অনুযায়ী শুরু হয়েছিল দুই রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। ছাতনার এই পুজো প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের পুরনো হলেও বর্তমানে যে দুর্গামন্দিরটি রয়েছে এখানে তা প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। বর্তমানে এই মন্দিরটিতে বেশ কিছু সংস্কার করা হয়েছে বটে তবে তাতে অটুট রয়েছে পুরনো ঐতিহ্য। জানা যায়, এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন রানি আনন্দ কুমারী। ছত্রিনানগরের এই রাজবাড়ি তথা বর্তমানের ছাতনা রাজবাড়িতেও বিষ্ণুপুরের রাজবাড়ির মতোই  হুবহু এক নিয়ম মেনে পুজো শুরু করা হয়। সংস্কার হওয়া মন্দিরেই প্রতি বছর নতুন কাঠামোয় দেবীর মূর্তি তৈরি হয়। নাট মন্দিরেই চলে মূর্তি তৈরির কাজ। এবারও একই ভাবে মূর্তি তৈরি হয়েছে। তবে মূর্তির আদল বদল হয়নি। এক চালার দেবীপ্রতিমারই চল এখানে।

দেবীর বোধন হয় জীতাষ্টমীতে। সপ্তমীর প্রায় পনেরো দিন আগে থেকেই চলে পুজো-উপাচার। জীতাষষ্ঠীর দিন রাতে ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীকে। অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়ার অধিকার রয়েছে কেবল রাজার। রাজবাড়ির অন্য কোনও সদস্য বা গ্রামের কেউ অঞ্জলি দিতে পারে না। নিয়ম অনুযায়ী, আজও তোপধ্বনির মাধ্যমে সম্পন্ন হয় সন্ধিপূজো। মল্লগড় বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির পুজোয় মাধব সায়রে মহাস্নান পর্ব সেরে বড় ঠাকুরানি প্রবেশ করেন সুপ্রাচীন মন্দিরে। রীতি মেনে মাধব সায়রের পাড় থেকে গর্জে ওঠে কামান। ঢাক-ঢোল, কাঁসর, সানাইয়ের শব্দে দেবীর আগমন হয়। আর এই রীতি মানা হচ্ছে প্রায় এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। ঠিক তেমন ভাবেই ষষ্ঠীর দিন তোপধ্বনির মাধ্যমে দেবীর বোধন সম্পন্ন করা হয়। সামন্তদের অস্ত্র দিয়ে সজ্জিতা হয়ে দেবী নবপত্রিকার বিসর্জন হয় দশমীতে। তবে থেকে যায় প্রতিমা।

তবে বাঁকুড়ার ছাতনা রাজবাড়ির দুর্গা কিন্তু অন্যান্য বাড়ির পুজোর মতো দশমীর দিন বিদায় নেন না। এই বাড়ির পুজোয় বিসর্জন হয় কোজাগরী পূর্ণিমা তথা লক্ষ্মী পুজোর দিন। লক্ষ্মীপুজোর দিন ওই প্রতিমাতেই পুজো হয় কোজাগরী লক্ষ্মীর। রাত্রি গড়ালে ছাতনা দুবরাজপুরের বাগদী পাড়ার লোকজন মাকে নিঃশব্দে ভাসানের জন্য নিয়ে যান। এ বাড়ির পুজোর বিসর্জন দেখার নিয়ম নেই রাজবাড়ির সদস্যরা। এমনকী গ্রামের মানুষদের জন্যও সেই দৃশ্য দেখা নিষিদ্ধ। কার্যত লোকচক্ষুর আড়ালেই বিসর্জিত হন দেবী। সেই প্রথা আজও মেনে চলে ছাতনা রাজবাড়ি।

ছাতনা রাজবাড়ির বর্তমান বংশধর রাজা প্রদীপ সিংহ দেও জানালেন, এখানকার পুজোয় দেখার মতো একটি কাণ্ড ঘটে। সেটি হল ডালা দৌড় এবংখাঁড়া দৌড়। একটা সময় পুজোতে প্রজারা ভেট নিয়ে রাজবাড়িতে উপস্থিত হতেন কিন্তু সে প্রথা আজ আর নেই। তবু আজও সন্ধিক্ষণের সময় ছাতনার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ডালা ভর্তি নৈবেদ্য নিয়ে ছুটে আসেন ভক্তেরা। দেবীর কাছে সবার আগে নৈবেদ্য দেওয়ার জন্য দৌড় লাগান সকলে। এটি ডালা দৌড় নামেই খ্যাত আজও।

এখানেই শেষ নয়। প্রতিমা বিসর্জনের সময়ে রাজাদের ব্যবহৃত পুরনো তরবারি বের করা হয় এবং সেইসব অস্ত্র নিয়ে ক্ষত্রিয়রা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ নেন। এটাই এই পরিবারের পুজোর রীতি। পাশাপাশি প্রতিমা বিসর্জনের সময় রাজপরিবারের কূল দেবী বাসুলীকে নিয়ে মন্দির পর্যন্ত দৌড়ানোর অনুষ্ঠান আছে। খাঁড়া দৌড় ঘিরেও মানুষের ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়।

আরও পড়ুন: ‘মা’ ডাকে বলি, ডুবন্তকে দেবীর উদ্ধার, রহস্য-কথকতায় ভরা শীতলগ্রামের চৌধুরীদের দুর্গাপুজো

এছাড়াও দেবী দুর্গার কাছে নৈবেদ্য নিয়ে ভক্তদের ডালা দৌড় হয়। প্রতিমা বিসর্জনের সময় রাজপরিবারের কূল দেবী বাসুলীকে নিয়ে মন্দির পর্যন্ত দৌড়ানোর প্রথা রয়েছে, এটি খাঁড়া দৌড় নামে পরিচিত। এই খাড়া দৌড় ঘিরেও মানুষের ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। রাজতন্ত্র না থাকলেও এই রাজপরিবারের ঐতিহ্য এবং প্রথাগুলি আজও অটুট রেখেছেন পুজোর উদ্যোক্তারা।

এই বাড়ির প্রতিমার ভাসান শেষ হওয়ার পর তুলে আনা হয় কাঠামো। সেই কাঠামোতেই তৈরি হয় পরের বছরের দেবীমূর্তি। দশমীর পূজার পর পুনরায় বাসুলি মন্দিরে গিয়ে পুজো সারেন রাজা। তবে দুর্গোৎসব শেষ হলে মন্দিরে এসে মায়ের মুখ দেখার নিয়ম নেই রাজপরিবারের সদস্যদের। আর এই সব নিয়ম মেনেই প্রতিবছর ভক্তিভরে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয় ছাতনার রাজবাড়িতে।

More Articles