ঘোড়ার পিছনে ফুঁ দিয়ে সাপেদের বশ! অবাক করবে যে গুরুদক্ষিণার কাহিনি
Rishi Uttanka Nagloka: গুরুপত্নী বললেন, পৌষ্যরাজার পত্নী কানে দু'টি সুন্দর কুণ্ডল বা দুল পরেন, সেই দুল দু'টি তাঁর চাই।
আমরা তো শুনেছিই যে পুরাকালে ছাত্ররা সব গুরুগৃহে পড়তে যেত, আর শিক্ষা শেষে তাঁদের গুরুদক্ষিণা দিতে হতো। এক একজন গুরুমশাই এক একরকম গুরুদক্ষিণা চাইতেন। আর শিষ্যদের যেভাবেই হোক সেই গুরুদক্ষিণা দিতে হতো। মহাভারতের পাঠকেরা তো জানেনই যে, গুরু দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে নিষাদ একলব্যের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটিই চেয়ে নিয়েছিলেন! আর একলব্য কী করেছিলেন তাও অজানা নয়। সে যাই হোক, গুরুদক্ষিণা বিষয়ে দ্রোণ আর একলব্যই অদ্বিতীয় নন। ঋষি উতঙ্ক কীভাবে গুরুদক্ষিণা দিয়েছিলেন শুনলে অবাক হতে হয়।
পুরাকালে এক ঋষি ছিলেন, তাঁর নাম ছিল বেদ। তাঁর একজন শিষ্যের নাম ছিল উতঙ্ক। বাকি দুইজন শিষ্য ছিলেন রাজা জন্মেজয় ও রাজা পৌষ্য। উতঙ্ক ছিলেন প্রধান। একবার হয়েছে কী, এক যজ্ঞের নিমন্ত্রণ পেয়ে নিজ সংসারের সব দায়িত্ব উতঙ্কের উপর ছেড়ে দিয়ে বেদ গেলেন বিদেশে। উতঙ্ক তো খুব যত্ন করেই গুরুর সংসারের দায়িত্ব পালন করলেন। এবার বাড়ি এসে উতঙ্কের দায়িত্ববোধ দেখে বেদ খুব খুশি হয়ে তাঁকে সমস্ত বিদ্যার অধিকার দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। সেকালে গুরুর কাছ থেকে সর্ববিদ্যা লাভ অত সহজ ব্যাপার মোটেই ছিল না। কিন্তু উতঙ্কের মনে হলো, তিনি তো বেদের মতো ছাত্রবৎসল গুরুর জন্য কিছুই করেননি! তিনি একটু কৃতজ্ঞতাস্বরূপই নয় তাঁকে কিছু গুরুদক্ষিণা দেবেন। কিন্তু বেদ যেহেতু নিজে গুরুগৃহে খুব কষ্ট করেছেন, তাই তিনি তো প্রথমে গুরুদক্ষিণার প্রস্তাবে রাজিই হলেন না, বললেন- পরে বলব। উতঙ্ক তো ছাড়ার পাত্রই নন, তিনি বারবার গুরুদক্ষিণা... গুরুদক্ষিণা করে বেদকে একেবারে পীড়াপীড়ি করতে আরম্ভ করলেন। বেদ কী আর করেন, শেষে বাধ্য হয়েই তিনি বললেন, "এই ব্যাপারে তোমার গুরুপত্নীকে জিজ্ঞেস করো, তিনি যা বলবেন, সেটিই গুরুদক্ষিণা।" এখানে ঋষি বেদের বিচক্ষণতা লক্ষ্যণীয়, এইভাবে তিনি শিষ্যের ইচ্ছাও পূর্ণ করেছেন আর স্বীয় পত্নীর কোনও ইচ্ছা থাকলে সেটিও পূর্ণ করার ব্যবস্থা করেছেন।
আরও পড়ুন- শকুন্তলা মানেই, নরম, স্নিগ্ধ, কোমলমতি? অবাক করবে ‘আসল’ শকুন্তলার কাহিনি
যাই হোক, গুরুপত্নী বললেন, পৌষ্যরাজার পত্নী কানে দু'টি সুন্দর কুণ্ডল বা দুল পরেন, সেই দুল দু'টি তাঁর চাই। এই পৌষ্যরাজা, আগেই বলেছি, উতঙ্কের গুরুভ্রাতা। কিন্তু পৌষ্যরাজার বাড়িতে যাত্রার সময়েও এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছিলেন উতঙ্ক। যাত্রাকালে তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলেন এক ষাঁড়ের উপর বসা এক প্রকাণ্ড পুরুষ যিনি কিনা আবার তাঁকে সেই ষাঁড়ের গোময়টি ভক্ষণ করতে বলেছিলেন। প্রথমে উতঙ্ক একটু আমতা আমতা করছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই পুরুষের থেকে যখন শুনলেন যে তাঁর গুরুও পূর্বে এই কাজ করেছিলেন, তখন আর দ্বিরুক্তি না করে চটপট কাজটি সেরে নিলেন। যাই হোক, এবার পৌষ্যরাজার গৃহে গিয়ে কুণ্ডলের কথাটি রাজাকে বলতেই তিনি বললেন, "আপনি নিজেই আমার পত্নীর কাছ থেকে চেয়ে নিন না!" আসলে সেকালে মেয়েদের গয়নাগাঁটির উপর মেয়েদের নিজেদের আইনসঙ্গত অধিকার ছিল। সেটিকে বলা হতো স্ত্রীধন। পুরুষেরা কখনই স্ত্রীধন কোনওভাবে ব্যবহার করার অধিকার পাননি। তাই পৌষ্যরাজাও স্ত্রীর জিনিস কাউকে দান করা বা স্ত্রীকে দানের কথা বলা, কোনওটাই করতে পারবেন না। তাই উতঙ্ককে নিজেকেই রানির কাছে সেই কথা বলতে হবে।
বলা বাহুল্য, রানির সঙ্গে সাক্ষাৎও কিন্তু খুব সহজ হয়নি উতঙ্কের পক্ষে। তিনি যেই রানির কক্ষে গেলেন, দেখলেন সেখানে রানি নেই! উতঙ্ক ভাবলেন, রাজা কি তাঁর মতো ব্রাহ্মণের সঙ্গে মজা করছেন? তিনি আবার গেলেন পৌষ্য রাজার কাছে। সমস্যাটি বলতেই রাজা বললেন, "আসলে আমার রানি এত পবিত্র যে, অশুচি মানুষ তাঁকে দেখতে পায় না। আপনি মনে হয় কোনও কারণে অশুচি হয়েছেন।" হঠাৎ উতঙ্কের মনে পড়ল, পথে ওই অদ্ভুত জলযোগের পর আচমনটা ভালোমতো করা হয়নি। তাই তাড়াতাড়ি আচমন সেরে রানির ঘরে যেতেই তিনি রানির দেখা পেয়ে গেলেন। রানি তো জানতেনই যে উতঙ্ক যোগ্য ব্যক্তি, তাই উতঙ্ক বলতেই তিনি কুণ্ডল তো দিলেনই, সঙ্গে বললেন একটা ছোট্ট সাবধানবাণী, "তক্ষক নাগ কিন্তু এই কুণ্ডল নেওয়ার ইচ্ছায় আছে।" তক্ষক নাগের প্রসঙ্গে পরে আসছি, তার আগে পৌষ্যরাজা ও উতঙ্কের মধ্যে একটি যে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেল, সেই প্রসঙ্গে আসা যাক।
উতঙ্ক তো কুণ্ডল পেয়েই গেছেন, এবার পৌষ্যরাজা তাঁকে অনুরোধ করলেন কিছু খেয়ে যেতে। উতঙ্ক বললেন, তাঁর খুব তাড়া, রাজা যেন খাদ্য যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় আনার আদেশ দেন। রাজা আদেশ তো দিলেন, খাদ্যও এল, কিন্তু ভাত ছিল ঠান্ডা আর ভাতে পড়েছিল একটি চুল! স্বাভাবিকভাবেই উতঙ্ক তো খুব রেগে গেলেন, রাজাকে শাপ দিয়ে বসলেন যে, তিনি যেমন অন্ধের মতো অশুচি অন্ন দেখেও খাবার দিয়েছেন, তেমনই তিনি অন্ধই হবেন। আসলে তিনি ভেবেছিলেন ভাতে চুল থাকার বিষয়টি পৌষ্য জানেন, অথচ পৌষ্যরাজা এসবের খবরই রাখেন না। রাজাও তাঁর গুরুভ্রাতা, তিনি ভাবলেন, এসব আবার কী, যেমনটি চাইলেন তেমনই তো এনে দিলাম, তাহলে শাপ কেন! তিনিও উতঙ্কের ব্যবহারে রেগে গিয়ে পাল্টা শাপ দিলেন যে "তুমি নির্বংশ হবে"। পরে অবশ্য তাঁরা ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিয়ে শাপের ব্যাপার মিটমাট করে নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- বাল্মীকির দায়সারা চরিত্র! যেভাবে রামের হাতে মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিল অনার্য মারীচ
সে যাই হোক, এবার উতঙ্কের সঙ্গে তক্ষকের সাক্ষাতের পালা। রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে একটি সরোবর দেখে উতঙ্ক ভাবলেন, স্নান আহ্নিকটা সেরে ফেলা যাক। স্নান সারতে না সারতেই উতঙ্ক দেখলেন, এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তাঁর ওই কুণ্ডল নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, এখানে বৌদ্ধ বনাম ব্রাহ্মণ্যবাদের এক সংঘাতের সূক্ষ্ম রেশও দেখা যাচ্ছে। যাইহোক, উতঙ্ক তখন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর পিছনে ছুটলেন তাঁকে ধরার জন্য। সন্ন্যাসী যেই দেখলেন যে উতঙ্ক তাঁকে ধরে ফেলবেন, তিনি তখনই একটি সাপে পরিণত হলেন এবং একটি গর্তে ঢুকে গেলেন। পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে, ওই সাপই হল তক্ষক। এবার উতঙ্ক তো গর্ত দিয়ে সাপটিকে যেতে দেখেছেন, তিনি তাঁর লাঠিটি দিয়েই গর্তটিকে খুঁড়ে বড় করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। আরও চালিয়ে যেতেন, যতক্ষণ না দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর অবস্থা দেখে বজ্রকে আদেশ দিলেন সেই লাঠিতে ঢুকে যাওয়ার। বজ্র ঢুকে যেতেই লাঠিতে যেন প্রাণ এল, এক খোঁচায় গর্তের পরিধি অনেকটা বেড়ে গেল। এরপর লাঠিটিকে সামনে রেখে গর্তের মুখ বড় করতে করতে শেষমেশ উতঙ্ক এসে উপস্থিত হলেন তক্ষকের নিজ রাজ্যে অর্থাৎ পাতালে।
পাতালের অনুপম সৌন্দর্যে উতঙ্কের মোহিত হয়ে যাবার অনেক অবকাশই ছিল, কিন্তু সেই সবকে আমল না দিয়ে উতঙ্ক ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তক্ষককে খুঁজে কুণ্ডল উদ্ধারে। তিনি সর্পদের অনেক স্তব করলেও যখন তাঁরা তাঁর কথায় কর্ণপাত করল না, তখন তিনি দেখলেন একজন উজ্জ্বল পুরুষ ঘোড়ার উপর বসে আছেন। তিনি এবার এঁর স্তব করতে শুরু করলে তিনি বলেন, তিনি উতঙ্কের স্তবে অত্যন্ত খুশি হয়েছেন, উতঙ্ক যা চান তাই তিনি দেবেন। উতঙ্ক বলেন, এই সাপেরা যাতে আমার বশ হয়, তার ব্যবস্থা করে যেন দেওয়া হয়। এইবার সেই উজ্জ্বল পুরুষ এক অদ্ভুত কাজ করতে বললেন উতঙ্ককে। তিনি বললেন তাঁর ঘোড়ার পিছনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ফুঁ দিয়ে যেতে। উতঙ্ক এই কাজ করতেই দেখা গেল, সেই ঘোড়ার শরীর থেকে ধোঁয়া আর নাকমুখ থেকে আগুন বেরোতে আরম্ভ হলো। সেই আগুনে তক্ষক সহ সাপের দল জেরবার হয়ে শেষপর্যন্ত তাঁকে সেই কুণ্ডল ফেরত দিয়ে দিল। এর পর তো পাতাল থেকে উতঙ্ক ভালোয় ভালোয় গুরু বেদের বাড়িতে চলে এসেছেন আর উপাধ্যায়ানী অর্থাৎ গুরুপত্নীকে কুণ্ডল দিয়ে তাঁর আশীর্বাদও পেয়ে গেছেন। কিন্তু মনে মনে তিনি তক্ষকের উপর খুবই চটেছিলেন। তাই তক্ষক তাঁকে যে হেনস্থা করেছে, তার প্রতিশোধ নিতে তিনি সটান চলে গেলেন হস্তিনাপুরে, রাজা জন্মেজয়ের কাছে। রাজা জন্মেজয় শুধু তাঁর গুরুভাইই নন, তিনি তক্ষকেরও শত্রু, কারণ তক্ষক তাঁর পিতা পরীক্ষিতকে মেরেছেন। আর জন্মেজয়ের কাছে যাওয়ার পর যে কী হয়েছিল, সে কথা তো আমরা সবাই জানিই।
তথ্যঋণ-
কথা অমৃতসমান নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রচনাসমগ্র