স্বামী 'পুরুষবেশে মেয়েমানুষ'! কীভাবে ঝগড়া করতেন রাম সীতার মতো পৌরাণিক দম্পতিরা?
Mythological Marital strife: সীতা চটে গিয়ে সবচেয়ে বেঁফাস মন্তব্যটি করে বসেন যে, তাঁর পিতা জনক যদি জানতেন যে তার জামাইটি পুরুষবেশে একটি মেয়েমানুষ তাহলে বিয়েই দিতেন না!
এই বিশ্বসংসারে, কিছু কিছু জিনিস একেবারে চিরন্তন। তার কোনও লয়-ক্ষয় নেই। যতদিন এই বিশ্ব সংসার আছে, ততদিন সেগুলিও আছে। সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ এসবই নিরন্তর ঘটে চলেছে। কিন্তু আরও একটি জিনিস আছে, যার সত্যিই কোনও লয়-ক্ষয় নেই। সেটি দাম্পত্য-কলহ বা দম্পতিদের ঝগড়া। মানুষ তো ছাড়, পৌরাণিক চরিত্র বা দেবদেবীরাও এই চিরন্তন দাম্পত্যকলহের বন্ধনে আবদ্ধ। তাই খোদ দেবদেবীরাও যখন এই দাম্পত্যকলহ নামক অম্লমধুর বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারেননি, মানুষ যে পারবেই না সে কথা বলাই বাহুল্য। মানুষদের দাম্পত্যকলহ তো অহরহ দেখাই যায় কিন্তু পৌরাণিক চরিত্র আর দেবদেবীদের দাম্পত্য কলহ ঠিক কেমন?
আমাদের মহাকাব্যগুলিতে এমন চরিত্র আছেন, যাদের কেবলমাত্র একবার ঝগড়ার জন্যই মনুষ্যকুল যুগ যুগ ধরে মনে রেখে দিয়েছে। এই যেমন কৈকেয়ী আর দশরথ। কৈকেয়ী অমন দু'টি বর চেয়ে ঝগড়ার সৃষ্টি না করলে বোধহয় রামায়ণ তৈরিই হতো না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দশরথই কিন্তু যা ইচ্ছা তাই বর নিতে বলেছিলেন কৈকেয়ীকে। আর সেটিও আবার কৈকেয়ী তাঁর অসুস্থতায় প্রাণপাত করে সেবা করেছিলেন বলেই। পুরাণের অগাধ সাগরে কত কিছুই না অজানা থাকে। পণ্ডিতেরা নাকি বলেন, কৈকেয়ীর ছেলেই রাজা হবেন, এমনটাই নাকি দশরথ কথা দিয়েছিলেন কৈকেয়ীর বাবার বাড়িতে, মানে কেকয় রাজ্যে। কিন্তু তাঁরা পরস্পরকে ঝগড়ার সময় কীই না বলেছেন। হে পাঠক! অযোধ্যাকাণ্ডের দ্বাদশ অধ্যায়ে মন দিলেই আপনি তা দেখতে পাবেন।
আরও পড়ুন- দেবতাদের প্রিয় মদ! জানেন, উত্তরভারতের কোথায় লুকিয়ে আছে সোমরস তৈরির উপকরণ?
দশরথ কৈকেয়ীকে বলেছেন তীক্ষ্ণবিষ সাপ, কৈকেয়ী দশরথকে বলেছেন দুর্মতি। এমনকী ঝগড়ার মুহূর্তে মানুষ যেমন সব থেকে বেফাঁস কথাটাই বলে ফেলে, ঠিক তেমনই দশরথ এমনও বলে ফেলেছেন, আমি মরে যাই তারপর মা-ছেলে মিলে রাজ্য শাসন করো! “ সেদানীং বিধবা রাজ্যং সপুত্রা কারয়িষ্যসি।” কৈকেয়ীও ছাড়ার পাত্রী নন, তিনিও বলে দিলেন যে দশরথ কথা দিয়ে কথা রাখেন না। দশরথ এমন কথাও বলেছেন যে, তাঁকে এত কথার প্যাঁচে ফেলার জন্য কৈকেয়ীর দাঁতগুলি কেন খসে পড়ছেনা! “ বিশীর্য্যামান্য দশনাঃ সহস্রাধার্য…” ভাবা যায়! এই নাকি ছিল আমাদের অতি পরিচিত দু'টি পৌরাণিক রাজা-রানি চরিত্রের কলহকালীন কথাবার্তা! সমগ্র ঝগড়ায় আরও অনেক যুক্তি-তর্ক, অনুরোধ-উপরোধ রয়েছে। তবে, এটা তো জানা কথাই যে ঝগড়ার সময় যা বলা হয় সেটাই মনের কথা নয়, এমন অনেক কথাও দশরথ-কৈকেয়ীর ঝগড়ায় এসেছে। তবে, এই ঝগড়ায় কাকে যে জয়ী বলা হবে তা ঠিক বোঝা যায় না কারণ বোঝাই যাচ্ছে দশরথ বা কৈকেয়ী কেউই ঝগড়ায় কম যান না। কিন্তু কৈকেয়ীকেই জয়ী বলতে হয় শেষ পর্যন্ত, কারণ এই ঝগড়ার ফলাফল কী হয়েছিল, তা সবারই জানা।
এর পর এমন এক চরিত্রের কথায় আসব, তিনি যে আদৌ ঝগড়া করতে পারেন, সেকথা ভাবতেই আমাদের যেন কষ্ট হয়! তাঁর ব্যক্তিত্ব এতটাই সুস্নিগ্ধ যে, তিনি ঝগড়া করতে পারেন একথা বিশ্বাসই হয় না। তিনি আমাদের অতিপরিচিত সর্বজনবিদিতা রঘুকুলবধূ জনকনন্দিনী সীতা। আজ্ঞে হ্যাঁ, সীতা। ত্রিভুবনে তিনি পাতিব্রত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সীতা মানেই আমাদের চোখের সামনে ভাসে শান্তশিষ্ট, স্নিগ্ধ এক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তিনিও যে ঝগড়া কম পারতেন না, সেটি তাঁর পতি শ্রীরামচন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন বনবাসে যাওয়ার আগে। তবে এখানে সীতাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই, তিনি রামকে ভালোবাসেন বলেই তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করেছিলেন। আসলে হয়েছে কী, রাম বনবাসে যাচ্ছেন দেখে সীতাও বলেন তিনি রামের সঙ্গে বনবাসে যাবেন। কিন্তু রাম তো কিছুতেই তাঁকে নিয়ে যাবেন না। বন অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল জায়গা বলে তিনি বারবার সীতাকে যাওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেই চলেছেন। এইবার সীতা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বলে উঠলেন, রাম যেন তাঁকে বাচ্চা মেয়ে না ভাবেন আর সীতা না ক্ষত্রবধূ? ক্ষত্রিয় হয়ে রাম নিজ পত্নীকে বনের মতো তুচ্ছ জায়গার ভয় দেখান কী করে? সঙ্গে আরও বললেন, আমি ভালোভাবেই জানি যে স্বামীর সঙ্গে কীভাবে চলতে হয়, তোমাকে আর উপদেশ না দিলেও চলবে! “মাস্মি সম্প্রতিবক্তব্যা বর্ত্তিতব্যং যথা ময়া”!
ভাবা যায়, আমাদের চিরকালীন শান্তশিষ্ট সীতাদেবী রেগে গিয়ে এতগুলো কথা বলেছিলেন! কিন্তু, রাম তো তখনও পর্যন্ত দমেননি, তিনি নাকি বাঘ সিংহ থেকে শুরু করে বনের মশার ভয় পর্যন্ত দেখিয়েছিলেন সীতাকে! এইবার সীতা চটে গিয়ে সবচেয়ে বেঁফাস মন্তব্যটি করে বসলেন যে, তাঁর পিতা জনক যদি জানতেন যে তার জামাইটি পুরুষবেশে একটি মেয়েমানুষ অর্থাৎ “স্ত্রিয়ং পুরুষবিগ্রহম্” তাহলে তিনি এখানে বিয়েই দিতেন না। ভাবতে অবাক লাগে, সীতার যে মূর্তি আমাদের মানসপটে আঁকা আছে তাতে তাঁর মুখে এই কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না! শেষ পর্যন্ত রাম হার মানলেন। ভাগ্যিস সীতা রামের সঙ্গে ঝগড়া করে বনে এসেছিলেন, নইলে আমরা কি আর রামায়ণের অমর কাহিনি পেতাম?
আরও পড়ুন- বাল্মীকির দায়সারা চরিত্র! যেভাবে রামের হাতে মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিল অনার্য মারীচ
এবার যার কথা বলা হবে তিনি সত্যিই প্রচণ্ড তেজস্বিনী রাজ্ঞী। তাঁর ব্যক্তিত্ব কখনও সুশীতল হতে দেখা যায়নি, বরং তাঁর ব্যক্তিত্বময়তায় অন্যরাই আচ্ছাদিত হয়ে গেছেন। যজ্ঞাগ্নি থেকে তাঁর জন্ম আর আগুনের মতোই ব্যাপিনী তাঁর ব্যক্তিত্ব, তিনি কুরুকুলবধূ দ্রুপদনন্দিনী যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী। তিনি হচ্ছেন একেবারে তেজি মহিলা। কতটা তেজি, তার প্রমাণ তো পাওয়াই গেছিল তাঁর বিয়ের সময়, যখন তিনি বধূসাজে শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে সবার সামনে সূতপূত্র কর্ণকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন। মহাভারতে এটা স্পষ্ট যে, দ্রৌপদী তৎকালীন স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণকারী অন্যান্য স্ত্রীদের মতো ছিলেন না। পঞ্চস্বামীর হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে জীবনে কম দগ্ধ তো হননি, তাই নিজের কথা ভালোই বলতে জানতেন তিনি। আমরা সকলেই দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীত্বের কারণ খুঁজি বটে কিন্তু মনে মনে জানি যে, দ্রৌপদীর মতো 'ভার্সেটাইল' ব্যক্তিত্বকে একা একজন স্বামীর পক্ষে সামলানো হয়তো সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের পক্ষে তো না-ই। পঞ্চস্বামীর মধ্যে এই মানুষটিই মনে হয় সবচেয়ে বেশি মুখঝামটা খেয়েছেন দ্রৌপদীর কাছে। সবচেয়ে বেশি দাম্পত্যকলহ তাঁদের মধ্যেই হয়েছে। অবশ্য কলহ দ্রৌপদীই বেশি করেছেন, যুধিষ্ঠির ক্রোধাগ্নিতে প্রায় ভস্ম হতে হতে বেঁচেছেন। মহাকবি ভারবি তাঁর কাব্যের প্রথম সর্গটি যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদীর কলহের প্রতিই উৎসর্গ করেছেন। সেখানে বনবাসপর্বে দ্রৌপদী ক্রোধে জর্জরিত বাক্যবাণে অহরহ বিদ্ধ করেছেন যুধিষ্ঠিরকে।
শিবঠাকুর ও দুর্গার মধ্যে কলহ হয় আমরা জানি। শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামা একবার পারিজাতপুষ্প নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ভীষণ কলহ করেছিলেন, তাও মহাভারতের পাঠকেরা জানেন। কিন্তু এমন একজন ঋষি ও ঋষিপত্নীর কথা বলবে, যে ঋষির মতো রাগী আর ত্রিভুবনে নেই। ঠিকই ধরেছেন, বলা হচ্ছে দুর্বাসা ঋষি ও তাঁর স্ত্রী কন্দলীর কথা। একবার দুর্বাসা মুনির বিয়ে করার ইচ্ছা হল। পাত্রীও জুটে গেল। ঔর্বমুনির কন্যা কন্দলী। পাত্রীর সব ভালো কিন্তু সে অত্যন্ত কলহপ্রিয়া। কন্দলীরও মুনিকে বেশ পছন্দই। দুর্বাসা ঔর্বকে বললেন, আমি আপনার কন্যার একশোটি অপরাধ ক্ষমা করব এর বেশি না। তাই সই। এরপর তো নানা কারণে ঝগড়া হতেই থাকল, আর দুর্বাসামুনি ঝগড়ার সংখ্যা গুনতে থাকলেন। যেই একশো পেরিয়ে গেল, দুর্বাসাও আর খুব বেশি সুযোগ না দিয়ে ধৈর্যহারা হয়ে কন্দলীকে সটান ভস্ম করে ফেললেন। এইবার কন্দলীর সূক্ষ্মদেহ দুর্বাসাকে বলল, সে দুর্বাসা ছাড়া কখনও কারও স্ত্রী হবে না। রগচটা হলে কী হবে, মুনি কন্দলীকেও ভালোবাসতেন খুব। এই কথা শুনে তো তিনি অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লেন। অবস্থা দেখে স্বয়ং ঈশ্বর আবির্ভূত হয়ে আশীর্বাদ করলেন যে, কন্দলী আবার অন্য কল্পে দুর্বাসার পত্নী হবেন। শুধু তাই নয়, বিধাতার আশীর্বাদে এই কলহপ্রিয়া কন্দলী নাকি কন্দলী জাতির মধ্যে বিরাজ করছেন, যার মধ্যে আছে ভুঁইচাঁপা ফুল, কলার মোচা, ব্যাঙের ছাতা ইত্যাদি। আর এগুলো বেশিরভাগ যেহেতু মানুষ খায়, তাই হয়তো বোঝাই যাচ্ছে মানুষের মধ্যে চিরপুরাতন এই ঝগড়ার বীজ ঠিক কোথা থেকে এল! তবে দাম্পত্যে কলহ না থাকলে নাকি দাম্পত্যজীবন পানসে হয়ে যায়, তাই অল্পস্বল্প দাম্পত্যকলহ মন্দ কী?
তথ্যসূত্র - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর পুরাণী ও কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয়