আউলচাঁদ, ভগবানিয়া ও বাংলার অন্তর্লীন প্রেম-সংস্কৃতি

Kartabhaja Sect: আউলচাঁদ কিন্তু তাঁর প্রবর্তিত ধর্মটির নাম দিয়েছিলেন—‘সত্যধর্ম’। হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের থেকে শতহস্ত দূরে সত্যই এক ও একমাত্র— এই ভাবনা আজকের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভাবতে পারবেন কি?

ভোর পেরিয়ে, সকাল হয়েছে খানিকক্ষণ হল। কুয়াশা অবশ্য কাটেনি পুরোপুরি। শীতের আলতো হাজিরা— গা শিরশির করে ওঠে থেকে-থেকেই। দোলের সেই তরুণ সকালে, ঘুরে-ঘুরে শ্মশানের সবাইকে আবির মাখাচ্ছেন বালকনাথ। পরিচয়— তিনি অঘোরী সন্ন্যাসী। বয়স খুব বেশি না, তিরিশের আশেপাশেই। কালো কাপড় জড়ানো শরীরে, মাথায় জটা। সারারাত এর-ওঁর-তাঁর থেকে চেয়ে-চেয়ে গঞ্জিকাসেবন করেছেন। কখনও-সখনও মদও। কেউ মুখঝামটা দিলেও, হাসিটি অমলিন। ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে কথার ফুলকি, মাঝেমধ্যে গালাগালিও। একসময় এসে দাঁড়ালেন আমার সামনেও। শ্মশানে, শশীতরুর নিচেই বসে ছিলাম। আমার কপালে আবিরের ফোঁটা এঁকে, এগিয়ে গেলেন খানিক দূরে আরেক সন্ন্যাসীর দিকে, গত রাতে ছিলিমের ভাগ পাওয়া নিয়ে যাঁর সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল তাঁর।

আজ, প্রায় ছ-বছর পেরিয়েও মনে পড়ে সেই সকালের কথা। সারারাত শ্মশানে কাটানো— আমি একা নই, অজস্র অচেনা মানুষের ভিড়। পিছনে মঞ্চ বেঁধে, বাউল গান। খানিক দূরেই কর্তাভজাদের তীর্থ— সতীমার বাড়ি। দোলের আগের দিন যেখানে জনজোয়ার আছড়ে পড়ে। সেই ঢেউ খানিক তরঙ্গ তোলে শ্মশানেও। সর্বত্রই এক নিবিড় বন্ধন—যেখানে জাতিভেদ নেই, নেই হিন্দু-মুসলমান বিভেদও। থাকবেই-বা কেন! কর্তাভজাদের মূল গ্রন্থ ‘ভাবের গীত’-এ লালশশী ওরফে দুলালচাঁদ তো লিখেই গিয়েছেন—

ভাইরে মগ ফিরিঙ্গি ওলন্দাজ
হিন্দু মুসলমান
এক বিধাতায় গড়েছে বস্তুতায় আছে
সব দেহে সমান

এই সমন্বয়ের কথা বলে যে বাংলার যে-ধর্মমত, তার প্রতি কৌতূহল জাগে বইকি! আজ অবধি কর্তাভজা সম্প্রদায় ও তাদের ধর্ম নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, প্রবন্ধ-বই লেখা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে যথেষ্টই। এসব পেরিয়ে, আমি ছুঁয়ে দেখতে চাই ভালোবাসার অনাবিল ধারাকে, যা নিজেও প্রত্যক্ষ করেছি একাধিকবার।

আরও পড়ুন: ধর্ম যেন রাষ্ট্রের বেঁধে দেওয়া সেই ছুরিটি

কল্যাণীর ঘোষপাড়া কর্তাভজাদের মহাতীর্থ। সেই কবে অষ্টাদশ শতকে আউলচাঁদ রামশরণ পাল-সহ ২২ জনকে দীক্ষা দিয়েছিলেন—সেসব আজ কিংবদন্তি। আউলচাঁদের পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়েও একাধিক কল্পকাহিনি। কর্তাভজাদের বিশ্বাস, তিনিই স্বয়ং চৈতন্য। পুরীতে টোটা গোপীনাথের মন্দিরে অন্তর্হিত হয়ে, বাংলায় ফিরে আসেন ‘আউলচাঁদ’ হিসেবে। যুক্তিবাদী মন এ-তত্ত্বে বিশ্বাস রাখতে চায় না, কেন-না চৈতন্যের কথিত তিরোধান (১৫৩৩ খ্রি.) ও আউলচাঁদের জন্মের (আ. ১৬৯৪) মধ্যে প্রায় দেড়শো বছরের ফারাক। এই যে আউলচাঁদ, তিনি হিন্দু না মুসলিম— তা নিয়েও তর্ক রয়েছে। তবে কর্তাভজাদের এসবে কিছু যায়-আসে না। প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, মহাদেব দাস নামক জনৈক বারুই পানের বরজে বালক আউলচাঁদকে খুঁজে পান, নাম রাখেন পূর্ণচন্দ্র। এরপর কবে যে তাঁর নাম আউলচাঁদ হল— সে এক রহস্য বটে। ‘আউল’ শব্দটি ফারসি; আউলচাঁদও নিজেকে ‘ফকির’ হিসেবেই পরিচয় দিতেন। তারপরেও, তাঁর হাত ধরেই জন্ম নিল ধর্মমত, যা কালক্রমে হয়ে উঠবে বাংলার অন্যতম বৃহৎ গৌণধর্ম।

ইতিহাসের কাহিনি যে কোথা থেকে কোন স্রোতে নিয়ে ফেলে, বলা দুষ্কর। ঘোষপাড়ার রামশরণ পাল ও তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী দীক্ষা নেন আউলচাঁদের। কালক্রমে ‘সরস্বতী’ নামটি পরিণত হল ‘সতী’-তে; সরস্বতী দেবী পরিচিত হন সতীমা হিসেবে। কর্তাভজা ধর্মের মূল তরঙ্গ তাঁকে ঘিরেই। ‘কর্তা’, অর্থাৎ গুরু। ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে এক নারীর নেতৃত্বে বাংলার কোণায়-কোণায় ছড়িয়ে পড়েছিল একটি ধর্ম। পুরুষশাসিত সমাজে দাঁড়িয়ে, এই উদাহরণ কেন যে তাত্ত্বিক স্তরেও উদ্‌যাপিত হয় না, কে জানে! আউলচাঁদ কিন্তু তাঁর প্রবর্তিত ধর্মটির নাম দিয়েছিলেন—‘সত্যধর্ম’। হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের থেকে শতহস্ত দূরে সত্যই এক ও একমাত্র— এই ভাবনা আজকের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভাবতে পারবেন কি?

Aulchand, the Kartabhaja sect and the concept of love in religious culture of Bengal by Tanmay Bhattacharya Robibarer Royak

সে-কারণেই কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বর্তমান মোহান্ত রঞ্জিত কুমার পাল যখন লেখেন— ‘মুচি, মেথর, ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, মুসলমান সব জাতি, সব বর্ণ, সব ধর্মের লোকেরা একত্রে একাসনে বসে এই ধর্ম উপাসনা করতে পারেন। দেখতে পাওয়া যায় এই ধর্মে হিন্দু গুরু, মুসলমান শিষ্য অথবা মুসলমান গুরু, হিন্দু শিষ্য আছে। গুরু করণে ব্রাহ্মণ চণ্ডালে কোনো ভেদাভেদ নেই’, আশ্চর্য হই না। স্বচক্ষে তো দেখেছি, ঘোষপাড়ার মেলায় বৈষ্ণব-শাক্তে ভেদাভেদ নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দৃশ্যত ভেদ করা যায় না, কাজেই সে-তর্ক থাক। দেখেছি, শ্মশানভূমিতেই মাটি কেটে তৈরি করা হয়েছে বিশাল উনুন, তাতে রান্না হচ্ছে খিচুড়ি। দল বেঁধে পঙক্তিভোজনে আমরা সবাই। পাশের লোকের জাতি-ধর্ম কী, এ-প্রশ্ন মাথাতেও আসেনি কারওর। যৌথতাই মূল শক্তি।

বলা বাহুল্য, এই সহনশীলতাকে ভালো চোখে দেখতে পারেননি অনেকেই। উনিশ শতক থেকেই কর্তাভজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গুঞ্জন ওঠে— মূলত শহুরে শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে। অশালীন, ফূর্তির স্থান, দেহব্যবসার আখড়া— ইত্যাদি বলে একঘরে করে দিতে চান তাঁদের। এ যেন নিম্নবর্ণীয়দের প্রতি উচ্চবর্ণীয়দের আজন্মলালিত অসূয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও, কর্তাভজাদের সম্পর্কে নবীনচন্দ্র সেনকে বলেছিলেন—‘কর্তাভজাদের মেলা! শুনিয়াছি বড় জঘন্য ব্যাপার।’ নবীনচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের ভুল ভাঙাতে, কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন তিনিও। তবে সার্বিকভাবে, বাংলার শিক্ষিতমহলে কৌতূহলের পাশাপাশি চাপা ঘৃণাও কাজ করেছে সমান্তরাল ভাবে। যে-সমস্ত অভিযোগ উঠেছিল কর্তাভজাদের বিরুদ্ধে, তা সর্বৈব ভুল— এ-দাবি করতে পারি না আমরা। ধর্মস্থান ও তাকে ঘিরে আয়োজিত মেলায় বহু ঘটনাই ঘটে থাকে। তবে তা দিয়ে মূল স্পন্দনটিকে বিচার করা অনুচিত। আসলে, ষোড়শ শতক থেকেই সহজিয়া বিভিন্ন ধর্মমতের প্রতি যে-অবহেলার ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল উচ্চবর্ণীয়দের মধ্যে, কর্তাভজাদের প্রতি ক্রোধও তারই উত্তরাধিকার। তবে প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসের মতো, কর্তাভজাদেরও বেশ-কিছু কুসংস্কার আছে বইকি! দূষিত হিমসাগর পুকুরে স্নান করা, দণ্ডী কেটে ডালিমতলা পর্যন্ত আসা, মানত করা—ইত্যাদি দেখে যুক্তিবাদী মন খানিক সংকুচিত হলেও, অনুসারীদের অকৃত্রিম বিশ্বাসকে উপেক্ষা করার সাধ্য কই!

Aulchand, the Kartabhaja sect and the concept of love in religious culture of Bengal by Tanmay Bhattacharya Robibarer Royak

এইসব বিচ্যুতি আরও ম্লান হয়ে আসে, যখন দেখি বিভেদহীন এক ধর্মব্যবস্থাকে। বাংলাদেশের যশোর-খুলনা অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরেই এক সম্প্রদায় বসবাস করে, নাম ‘ভগবানিয়া’। নামের মধ্যেই ‘ভগবান’ শব্দটি লুকিয়ে। অথচ এই সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সদস্যই মুসলমান। ইতিহাসের কোনো-এক পর্যায়ে এঁরা কর্তাভজাদের ধর্ম গ্রহণ করেন। এঁদের বীজমন্ত্র ‘গুরু সত্য’, আর-কিছু নয়। মুসলমানদের মতোই মৃতকে কবর দেন তাঁরা। অন্যদিকে, কর্তাভজা সম্প্রদায় ঐতিহাসিকভাবে হিন্দুভাবাপন্ন। এই ক্ষেত্র এমনই উদার, যে, ভগবানিয়াদের কর্তাভজা সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্তিতে কোনো বাধাই আসেনি।

আসবেই-বা কেন! একই মেলায় বাউল-ফকির-দরবেশ-তান্ত্রিক-অঘোরী-বৈষ্ণবের সহাবস্থান। নিজ-নিজ আখড়ায় যে যার মতো। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তেরা এসে রাত কাটান সেসব আখড়ায়। সেখানে জায়গা না-হলে, আনাচে-কানাচে ঠাঁই খুঁজে নিলেই হল! বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও মানুষজন আসেন দোলের আগে। সবাই যে সতীমায়ের থানে মাথা ঠেকাচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। কর্তাভজাদের ধর্মে দীক্ষিতও নন অনেকে। আসার জন্যেই আসা। স্থানমাহাত্ম্যে বা বা নিছক আনন্দে, অভ্যাসে। ভালোবাসা পাওয়া ও দেওয়ার অভ্যাস একবার জন্মে গেলে, তা থেকে মন উঠতে চায় না। বছরের পর বছর, একই সময়ে। তেরাত্তির থাকা ও রং-উদযাপন। তারপর আবার সংসারে ফিরে যাওয়া। সন্ন্যাসী হলে, ভিন্ন কোনও তীর্থে।

আরও পড়ুন:‘আমরা শুধু সব ধর্মকে সহ্যই করি না…’ ১৩০ বছর আগে শিকাগোয় ঠিক কী বলেছিলেন স্বামীজি?

ফলে, শুধুমাত্র ধর্ম দিয়ে কর্তাভজাদের বিচার করা অনুচিত। আড়ালে লুকিয়ে থাকে আরও না-বলা কাহিনি। বাঙালির চিরন্তন মিলন-ঐতিহ্য। ধর্মের থেকেও যেখানে বড়ো হয়ে ওঠে মানুষে-মানুষে মিলমিশ, প্রেম। আজকের সাম্প্রদায়িক ভেদনীতিতে আচ্ছন্ন দেশে এসব দেখলে ধাঁধাঁ লাগে। কোনটা সত্য তাহলে?

‘আছে কর্তাভজা এক মজা সত্য উপাসনা
বেদ বিধিতে নেইকো তার ঠিকানা
এসব চতুরের কারখানা।’

More Articles