বছরে একদিন খুলে যায় ‘মহাকাব্যের’ মন্দির! কেন এত জাগ্রত এই দেবী কান্নাগির থান?

Mangala Devi Kannagi Temple: প্রায় ২ হাজার বছরের পুরনো এই মঙ্গলা দেবী কান্নাগীর মন্দিরটির অবস্থান সমুদ্র থেকে প্রায় ১,৩৩৭ মিটার উঁচুতে। দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মন্দির এটি।

গোটা বছরে মাত্র একটি বার খুলে যায় মন্দিরের দরজা। ওই একটি দিনই ভক্তদের হাতে পুজো পান মহাকাব্য থেকে উঠে আসা দেবী কান্নাগী। প্রায় ২ হাজার বছরের পুরনো এই মঙ্গলা দেবী কান্নাগীর মন্দিরটির অবস্থান সমুদ্র থেকে প্রায় ১,৩৩৭ মিটার উঁচুতে। দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মন্দির এটি। কেরলের ইদুক্কি জেলা ও তামিলনাড়ুর থেনি জেলার সীমান্তে অবস্থিত এটি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই মন্দিরের মালিকানা নিয়ে ঝগড়া লেগেই ছিল তামিলনাড়ু ও কেরলের দুই সরকারের বিরুদ্ধে।

পেরিয়ার ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভিতরে থেক্কাডি থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এই মন্দির। খালি পায়ে হেঁটে মন্দির পৌঁছনোর উপায় নেই। ভরসা জিপ। কুমিলি থেকে জিপ ধরে পৌঁছতে হয় মন্দির চত্বরে। অবশ্য সারা বছর এই মন্দিরের দ্বার ভক্তদের জন্য খোলা থাকে না মোটেই। প্রতি বছর চিত্র পূর্ণমী উৎসব উপলক্ষে একটি দিনই দ্বার খুলে যায় মন্দিরের। সেগিন কেরলের ইদুক্কির এই মন্দির চত্বরে ভিড় করেন হাজার হাজার ভক্ত। ২৩ এপ্রিল, মঙ্গলবার ছিল সেই দিন। যেদিন খুলে গিয়েছিল মন্দিরের দ্বার।

আরও পড়ুন: খিচুড়ি-লাড্ডু নয়, দেশের এই মন্দিরে দেবতার প্রসাদ নাকি বই!

পান্ডিয়ান স্থাপত্য দিয়ে সাজানো এই মন্দিরের সীমানাপ্রাচীর ও মন্দিরে দিকে যাওয়ার ধাপগুলো বিরাট বিরাট সব পাথর দিয়ে তৈরি। জঙ্গলের মধ্যে দুর্দান্ত নৈসর্গে মোড়া এই মন্দিরটি কেরলের এক প্রাচীন ঐতিহ্য, যাকে একঝলক দেখতে ছুটে আসেন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ। এ মন্দির আসলে বছরের পর বছর ধরে নারীশক্তির প্রমাণ। তামিল মহাকাব্য সিলাপাখিকারমের একটি নারী চরিত্র দেবী কান্নাগি, যাঁকে দেবী হিসেবে পুজো করে আসছেন দক্ষিণের মানুষ।

স্থানীয় ইতিহাস অনুযায়ী, প্রায় দু হাজার বছর আগে ভান্নাথিপারাইতে প্রাচীন তামিলনাড়ুর চেরা রাজবংশের শাসক চেরান চেঙ্গুত্তভান তৈরি করেছিলেন মন্দিরটি। প্রতিবছরই এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে একটি দিন মন্দিরের দরজা খুলে যায় ভক্তদের জন্য। সে দিনটা চিত্রপূর্ণামী উৎসব। স্থানীয় বিশ্বাস, তামিল মহাকাব্য 'সিলাপাথিকারম' অনুসারে, দেবী কান্নাগি মাদুরাই থেকে শুরু করে ভেঙ্গাইকানাল নেদুকুন্ড্রম পৌঁছন। প্রায় চোদ্দ দিনের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল যেখান থেকে, সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আজ এই মন্দির। এখানকার মানুষজন বিশ্বাস করেন, স্বামী কোভালানকে স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই মনুষ্যরূপ ধরে পৃথিবীতে আসেন কান্নাগি, এবং তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে ফিরে যান।

তবে কোভালান আর কান্নাগির এই প্রেমের পথ কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। কোভালান স্ত্রী কান্নাগিকে ভুলে লিপ্ত হয়েছিলেন নর্তকী মাধবীর মোহে। বণিক কোভালান ভাগ্যের ফেরে সর্বশান্ত হন, এবং চলে যান সোজা মাদুরাইয়ে। সেখানে গিয়ে রানির নূপুর বলে স্ত্রীর নূপুর বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। রাজার দরবারে পেশ করা হয় কোভালানকে, তাঁকে রাজা মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এ সময় কোভালামকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পৌঁছন কান্নাগি। নিজের অন্য পায়ের পান্না খচিত নূপুরটি নিয়ে হাজির হন সেখানে। তিনি জানানা, রানির পায়ের নূপুরটি মুক্তখচিত ছিল। রাজা ভুল বুঝতে পারেন এবং নিরপরাধতে দণ্ডিত করার অপরাধবোধে সিংহাসনেই মারা যান রাজা। সেই সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন তাঁর স্ত্রীও।

কান্নাগি কোনও মহাকাব্যের প্রথম কোনও সাধারণ মহিলার চরিত্র, যে ওই তামিল মহাকাব্যের নায়িকা হয়ে উঠেছিলেন। স্বামীবিচ্ছেদ সহ্য করতে না পেরে তিনি হাঁটতে শুরু করেন। চোদ্দো দিনের এই যাত্রায় চেরা হয়ে কেরালার কুমুলিতে পৌঁছন তিনি। স্থানীয় উপজাতিদের থেকে কান্নাগির গল্প জানতে পারেন রাজা চেঙ্গুতুভান। আর তারপরেই রাজা স্বয়ং হিমালয় থেকে নিয়ে এসেছিলেন মন্দির তৈরির জন্য় পাথর। তাঁর এই উদ্যোগে যোগ দেন সিলনের রাজা কায়ভাগুও।

প্রাথমিক ভাবে মন্দিরটি তামিলনাড়ুর অন্তর্গত ছিল। ১৮১৭ সালে করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমীক্ষাও ১৮৮৩ সালের সেন্ট জর্জ গেজেট অনুযায়ী, মন্দিরটি পড়ে কেরল অঞ্চলে। দীর্ঘদিন এই মন্দিরের মালিকানা নিয়ে বিবাদ চলেছে দু'রাজ্যের মধ্যে। ইতিমধ্যে জারি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনও। তবে তার ফয়সালা হয়নি এখনও।

আরও পড়ুন: নাগ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব মেলে এখানে, আজও নিয়মিত পুজো হয় বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো এই হিন্দু মন্দিরে

কান্নাগি মন্দির ট্রাস্ট সূত্রের খবর, এই মন্দিকে ১১ শতকের রাজারাজা চোল ও ১৩ শতকের কুলাশেকার পান্ডিয়ানের দু'টি শিলালিপি রয়েছে। মহাকাব্যের এই মন্দির ঘিরে রয়েছে পাইন গাছের সারি। মহাকাব্যের উপজাতিরা এখনও এই মন্দিরের পাদদেশে বসবাস করেন। এমনকী মহাকাব্যে উল্লিখিত জলাশয়টাও রয়েছে মন্দিরের কাছেই। তবে সুপ্রাচীন এই মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণে তেমন কোনও উদ্যোগ নেয়নি সরকার। যার ফলে মন্দিরের আশ্চর্য কাজ এবং কাঠামো ক্ষয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এমনকী মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনও তহবিলের ব্যবস্থাও নেই। মন্দিরে মঙ্গলা দেবী ছাড়াও রয়েছে কারুপুস্বামী, শিব ও একটি গণেশের মূর্তি। তবে সংরক্ষণের অভাবে কতদিন টিকে থাকবে প্রাচীন এই মন্দির, তা নিয়ে সন্দেহ আছে বৈকি।

More Articles