শেষদিন পর্যন্ত সঙ্গে ছিল শ্রীচৈতন্যের প্রিয় সখাদল

Mahaprabhu Chaitanya: বৃন্দাবন দাসের শ্রীচৈতন্যভাগবত থেকে জানা যায়, নিতান্ত শিশুকালে বিশ্বম্ভরের বন্ধুরা ছিলেন তাঁর বিচিত্র দুরন্তপনার সঙ্গী।

শ্রীচৈতন্য যে প্রেমের ধর্ম, ভালোবাসার সংস্কৃতি প্রচার করেছেন, সেখানে ভক্তির পরিপক্ব অবস্থার একটি বিশেষ শ্রেণি হল সখ্যরসাত্মক ভক্তি... ভগবান সেখানে ভক্তের প্রভুর বদলে সখা। সেই নিকটতম বন্ধুর ঐশ্বরিক মহিমা ভুলে সুবল, উজ্জ্বল আদি গোপবালকের দল অনায়াসে তাঁর কাঁধে চড়েন; নিজের যা খেয়ে ভালো লাগল, সেই উচ্ছিষ্ট ভুক্তশেষ নিশ্চিন্তে তুলে দেন সখা কৃষ্ণের মুখে। এহেন অদ্ভুত ভালোবাসার আখ্যান যে গৌরাঙ্গের ধর্মবিহারের অঙ্গ, তাঁর সঙ্গে কেমন ছিল তাঁর বন্ধুদের সম্পর্ক? আসুন, সেই বিষয়ে দু-চার কথা বলি।

বৃন্দাবন দাসের শ্রীচৈতন্যভাগবত থেকে জানতে পারছি, নিতান্ত শিশুকালে বিশ্বম্ভরের বন্ধুরা ছিলেন তাঁর বিচিত্র দুরন্তপনার সঙ্গী। পিতা জগন্নাথ মিশ্রের কাছে নালিশ যেত, গঙ্গার ঘাটে শিশুদল জুটিয়ে স্নানার্থীদের উত্যক্ত করছে নিমাই। কারওর গায়ে কুলকুচি করে দিচ্ছে, কারওর মৃন্ময় শিবলিঙ্গ নিয়ে পালাচ্ছে, কারওর বিষ্ণুপূজার নৈবেদ্য খেয়ে ফেলছে দুরন্ত বিশ্বম্ভর। আর বালিকাদের ক্ষেত্রে দুষ্টুমির পন্থা আরও অভিনব। চুলে ওকড়ার বিচি দিয়ে জট পাকিয়ে দেওয়া, অলক্ষ্যে কাছে এসে কানের সামনে বিকট চিৎকার করে ভয় দেখানো, এমনকী বিবাহপ্রস্তাব অবধি— এরকমই নানা নালিশ শুনতেন শচীমাতা। আর এই সব দুষ্টুমির পর, ক্রুদ্ধ পিতার শাসন থেকে বাঁচতে নিমাইয়ের সহায় ছিল শিশুবন্ধুদের চাতুরী।

আরও পড়ুন: চৈতন্য মহাপ্রভুর চরণচিহ্ন রয়েছে বাংলার এই তীর্থক্ষেত্রে

শুধু স্নানের ঘাটে নয়, রাত্রিবেলা পাড়ার আনাচে-কানাচে শিশু নিমাইয়ের সবন্ধু দুষ্টাভিযানের বিবরণ দিয়েছেন চৈতন্যভাগবতকার। দুই শিশু মিলে রাতের অন্ধকারে কম্বল চাপা দিয়ে ষাঁড় সেজে প্রতিবেশীর কলাবাগান ভেঙে দেওয়া নিমাইয়ের দলের কাছে বাঁ-হাতের খেল। পড়শী গেরস্তদের ঘরে শিকল তুলে দিয়ে মজা দেখতেন সবন্ধু নিমাই। "লঘ্বী গুর্ব্বী" (ছোটো-বাইরে বড়ো-বাইরে) করার জন্য বেরোতে না পেরে ক্ষুব্ধ প্রতিবেশীদের চিৎকার শোনা তাঁর বন্ধুদলের কাছে ছিল বেজায় আমোদের বিষয়৷ আবার উপনয়নের পরে, পাঠশালার সতীর্থদের সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে গিয়ে অন্য গুরুমশায়ের শিষ্যদের সাথে প্রথমে বচসা, তারপর গালিগালাজ, তারপর মারপিট করা নিমাইয়ের নিত্য অভ্যাস হয়ে উঠেছিল। চ্যালেঞ্জ যখন আসত পড়াশোনা নিয়ে, তখন নিমাইকে হারানোর ক্ষমতা কোনও পড়ুয়ার ছিল না। প্রখর যুক্তিবোধ ও অসামান্য স্মৃতিশক্তির সাহায্যে সবার মুখে কুলুপ দিতেন বাগ্মী কিশোর, যিনি আস্তে আস্তে হয়ে উঠছিলেন নবদ্বীপের বাদীসিংহ নিমাই পণ্ডিত।

বালক নিমাইয়ের বন্ধুবৎসল স্বভাবের কথা পাচ্ছি তাঁর ছোটোবেলার বন্ধু জগদানন্দ পণ্ডিতের লেখা 'প্রেমবিবর্ত' বইতে। শৈশবে নিমাই আর জগদানন্দ একবার পাঠশালায় প্রথমে কোন্দল, পরে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লেন। রাগ করে সেদিন বাড়ি ফিরলেন না জগদানন্দ, মায়াপুরের গঙ্গাতীরে পড়ে রইলেন সজল চোখে। রাত ঘনাল, গদাধরকে সঙ্গে নিয়ে গৌরহরি নদীতীরে এসে বললেন—

"ডাকেন 'জগদানন্দ
অভিমান বড়ো মন্দ
কথা বলো বক্রতা ছাড়িয়া।' "

গৌরাঙ্গ সেদিন নিজেও তখনও খাওয়াদাওয়া করেননি, গদাধরের সঙ্গে চলে এসেছেন অভিমানী বন্ধুর খোঁজে। জগদানন্দকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে অন্নজল দিয়ে, তবে স্বস্তি পেলেন তিনি। পরদিন সকালে শচী-জগন্নাথ দুধ-ভাত খাইয়ে পড়তে পাঠালেন দু'জনকে। পরে, গৌরাঙ্গ সহাস্যে বললেন, মাঝেমধ্যে এরকম রাগারাগি ভালো, তাহলে প্রেম বেড়ে ওঠে!

গদাধর পণ্ডিতের সঙ্গেও ইচ্ছে করে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে কৌতুক করতেন নিমাই। পথের মধ্যে গদাধরকে ধরে প্রশ্ন তুলতেন... তুমি তো ন্যায়শাস্ত্রের পণ্ডিত, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও! "কহ দেখি মুক্তির লক্ষণ"! গদাধর বললেন, আত্যন্তিক দুঃখনাশকেই শাস্ত্রে মুক্তি বলা হয়েছে। ব্যাস, অমনি নিমাই পণ্ডিত প্রখর যুক্তিজালে গদাধরকে এমনভাবে কোণঠাসা করে ফেললেন যে, ভালোমানুষ গদাধর ভাবতে লাগলেন, " আজি বর্ত্তি পলাইলে"... আজ তো পালাতে পারলে বাঁচি! অবস্থা বুঝে বন্ধুকে ছাড় দিলেন গৌর, তবে বলে রাখলেন... আজ ঘরে যাও, কাল কিন্তু আবার এই নিয়ে কথা হবে!

উত্তরকালে, নীলাচলের সন্ন্যাসজীবনেও গদাধর পণ্ডিত ছিলেন মহাপ্রভুর নিত্যসঙ্গী। প্রত্যহ গদাধরের কাছে ভাগবত পাঠ শুনতে যেতেন মহাপ্রভু, সেই ছবি সেকালের চিত্রশিল্পী অমর করে রেখেছেন। বালির স্তূপের মধ্যে খুঁজে পাওয়া শ্রীরাধা ও ললিতা সহ গোপীনাথের বিগ্রহসেবার ভার মহাপ্রভু গদাধর পণ্ডিতের হাতেই দিয়েছিলেন৷ একবার হল কী, গৌড়দেশ থেকে নিত্যানন্দ গোপীনাথের জন্য আনলেন রঙিন বস্ত্র আর সুগন্ধী তণ্ডুল। আনন্দিত গদাধর বাগানের আবোনা শাকের ব্যঞ্জন, আর তেঁতুলপাতা বেটে লবণ দিয়ে অম্বল প্রস্তুত করলেন, সেই সঙ্গে ঠাকুরকে নিবেদন করলেন সেই সুগন্ধী তণ্ডুলের অন্নভোগ। সেদিন গোপীনাথের মন্দিরে মহাপ্রসাদ পেতে এলেন স্বয়ং মহাপ্রভু, গদাধরের উচ্চ প্রশংসা করে বললেন—

"গদাধর কি তোমার মনোহর পাক। আমি ত এমত কভু নাহি খাই শাক।।
গদাধর কি তোমার বিচিত্র রন্ধন। তেঁতুলপত্রের কর এমত ব্যঞ্জন।।"

এইভাবে, শ্রীচৈতন্যভাগবত গ্রন্থের অন্ত্যভাগে, নীলাচলধামে গৌরাঙ্গ, গদাধর ও নিত্যানন্দ... তিন বন্ধুর একত্র জগন্নাথদর্শন, প্রসাদগ্রহণ ও কীর্তনানন্দের কথা বর্ণনা করেছেন বৃন্দাবন দাস।

আরও পড়ুন:‘রসে’বশে মহাপ্রভু: শ্রীচৈতন্যের ভোজনবিলাসের কাহিনি আজও কিংবদন্তি

আবার, সন্ন্যাসজীবনেও কিন্তু জগদানন্দ পণ্ডিতের সঙ্গে গৌরাঙ্গের খটাখটি-কোন্দল লেগেই থাকত। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থে বর্ণনা করছেন... একবার মহাপ্রভুর শিরঃপীড়ার চিকিৎসার জন্য সুদূর গৌড়দেশ থেকে সুগন্ধী চন্দন-তৈল নিয়ে এলেন জগদানন্দ। কিন্তু সন্ন্যাসজীবনে কোনওরকম বিলাসব্যসনকে প্রশ্রয় দিতে নারাজ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য... তিনি বললেন ওই সুগন্ধী তেল জগন্নাথ মন্দিরে দান করা হোক। বারবার অনুরোধের পরেও মহাপ্রভু অটল। শেষ অবধি ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, অভিমানী জগদানন্দ বন্ধুর সামনে আছাড় দিয়ে ভাঙলেন সেই চন্দন-তৈলের কলস, তারপর নিজের ঘরে দোর দিয়ে পড়ে রইলেন উপবাসী হয়ে। মহাপ্রভু চললেন বন্ধুর মান ভাঙাতে... চাতুরী করে বললেন, আমি জগন্নাথ দর্শনে চললাম, ফিরে এসে তোমার কাছে অন্নভিক্ষা নেব। অগত্যা জগদানন্দ উঠলেন, রন্ধন করলেন, এবং মহাপ্রভুকে সেদিন অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেকগুণ বেশি অন্নগ্রহণ করতে হলো। তিনি নিরুপায়, "আর খাব না" বললে জগদানন্দের অভিমান বেড়ে যাবে, আর তাঁকে আগে উত্তমরূপে ভোজন না করিয়ে জগদানন্দ নিজেও অন্ন মুখে তুলবেন না! অবশেষে, গোবিন্দের মুখে জগদানন্দের অন্নগ্রহণের খবর নিয়ে, মহাপ্রভু নিশ্চিন্ত হলেন। সেদিনও ভোজনে বসে তিনি কৌতুক করতে ছাড়েননি অবশ্য, বলেছিলেন—

"ক্রোধাবেশের পাকে হয় এত ঐছে স্বাদ।
এই তো জানিয়ে তোমায় কৃষ্ণের প্রসাদ।"

—রাগ করে রান্নাতেও এমন স্বাদ হয়েছে, একে কৃষ্ণের প্রসন্নতা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়!

মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার একেবারে শেষপর্বে, যখন তিনি দিব্যোন্মাদ, যখন রাধাভাবে ভাবিত হয়ে তিনি বিনিদ্র রজনী কাটান বিরহ-বিলাপে, তখনও তাঁকে ঘিরে ছিলেন বন্ধুদল। স্বরূপ দামোদর আর রামানন্দ রায়— এই দুই গোঁসাই ক্রমাগত গীতগোবিন্দ, বিদ্যাপতি আর চণ্ডীদাসের পদাবলী, কৃষ্ণকর্ণামৃত প্রভৃতি মহাপ্রভুকে গেয়ে শোনাতেন, তাতে তাঁর বিরহব্যথার উপশম হতো। রাত্রে প্রেমোন্মাদ মহাপ্রভু বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে শ্রীমন্দির কিংবা সমুদ্রের দিকে চলে গেলে, তাঁরাই দলবল নিয়ে মশাল হাতে বেরিয়ে পড়তেন গৌরাঙ্গের সন্ধানে, তাঁকে ফিরিয়ে আনতেন গম্ভীরায়।

আর শেষাবধি আরও একবার উল্লেখ করতেই হবে গদাধর পণ্ডিতের কথা। মহাপ্রভুর সঙ্গে যাঁর সম্পর্কের মাধুর্য বন্ধুত্বকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছিল আরও বিস্তৃত, আরও গভীর। তাঁকে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন "লক্ষ্মীরূপা'', কবি কর্ণপূর বলেছেন "গৌরপ্রেমলক্ষ্মী", আর বাল্যসখা জগদানন্দ পণ্ডিত সুদৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছেন "গদাই গৌরাঙ্গে মুঞি রাধাশ্যাম জানি।" এই প্রেম-মাধুর্য-সিঞ্চিত সখ্যের গৌরবেই শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে গৌরাঙ্গের নামান্তর "গদাধরপ্রাণনাথ"।

তথ্যসূত্র:
বৃন্দাবন দাস - 'শ্রীচৈতন্যভাগবত'
কৃষ্ণদাস কবিরাজ - 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত'
জগদানন্দ পণ্ডিত - 'প্রেমবিবর্ত'
কবি কর্ণপূর - 'গৌরগণোদ্দেশদীপিকা'

More Articles