৪৬ বছর পর রহস্যফাঁস! পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভাণ্ডার খুলতেই যা সামনে এল
Ratna Bhandar of Jagannath Temple: ১৯৭৮ সালে শেষবার খোলা হয়েছিল রত্নভাণ্ডারের দরজা। তার পর থেকে নানা বিঘ্ন এসেছে বারংবার। কখনও হারিয়ে গিয়েছে চাবি, কখনও অন্য কিছু। প্রায় পাঁচ দশক ধরে সেই রত্নভাণ্ডার রহস্যই থেকে গিয়েছে।
৪৬ বছর পর খোলা হল পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভাণ্ডার। দ্বাদশ শতাব্দীর মন্দির, কার্যত সেই মন্দিরের রত্নভাণ্ডার এক রহস্যে পরিণত হয়েছে এতগুলো বছরে। শোনা যেত, রত্নভাণ্ডারের ভিতরের প্রকোষ্ঠে হীরে, সোনা-সহ বহুমূল্য ও দুর্লভ সব গহনা ও রত্নরাজি সুরক্ষিত রয়েছে। ওড়িশা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রাজা অনঙ্গভীমা দেব নাকি এককালে দেড় হাজার কেজি সোনা দান করেছিলেন মন্দির কর্তৃপক্ষকে। সেই সোনা দিয়ে যাতে গড়ে দেওয়া হয় জগন্নাথদেবের অলঙ্কার। জগন্নাথ দেবের রত্নভাণ্ডার ঠাসা এমনই সব হাজারো বহুমূল্য সম্পদে।
১৯৭৮ সালে শেষবার খোলা হয়েছিল রত্নভাণ্ডারের দরজা। সেই শেষ। তার পর থেকে নানা বিঘ্ন এসেছে বারংবার। কখনও হারিয়ে গিয়েছে চাবি, কখনও অন্য কিছু। প্রায় পাঁচ দশকের মতো সময় ধরে সেই রত্নভাণ্ডার রহস্যই থেকে গিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই রহস্য যত বেড়েছে, তত বেড়েছে মানুষের আগ্রহও। শোনা যেত, ওই রত্নভাণ্ডার নাকি পাহারা দিচ্ছে বিষধর সব সাপ। এমনকী অনেকেই মনে করতেন, এই রত্নভাণ্ডারের দরজা না খোলাই স্রেয়। যে বা যাঁরা এই রত্নভান্ডার খোলার চেষ্টা করবে, শারীরিক ভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হবে তাঁরা।
আরও পড়ুন: দুর্বিপাকের রথযাত্রা! পুরীর রথ থেকে পড়েই গেলেন বলভদ্র, মূর্তি চাপা পড়ে জখম সেবায়তেরা
শেষ ভোটের আগে রত্নভাণ্ডার রহস্যকেই ইস্যু করে তুলেছিল বিজেপি। রত্নভাণ্ডারের চাবি হারানোর দায় নবীন পট্টনায়েক সরকারের উপরে ঠেলে ওড়িশায় যথেষ্ট ফায়দাও পেয়েছে বিজেপি। নবীনের দল বিজেডি রত্নভাণ্ডারের সম্পত্তির তালিকা তৈরি করতে এবং তা জনগণের সামনে পরিষ্কার করতে ব্য়ার্থ বলেও দোষারোপ করেছিল গেরুয়া শিবির। এখানেই শেষ নয়, পুরীকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে প্রচার করে জগন্নাথ ধামের ঐতিহ্যকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ ছিল বিজেপির। বিজেডির আমলে শ্রীক্ষেত্র একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বলেও তোপ দেগেছিল তারা। করোনাকালীন সময় থেকেই বন্ধ ছিল জগন্নাথ মন্দিরের চারটি প্রবেশ দ্বার। সেই বিষয়টিকে ইস্যু করে ভোটমুখী ওড়িশার একাধিক জনসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেন, রথযাত্রা বন্ধ করার পর্যন্ত ষড়যন্ত্র করে বিজেডি সরকার। এবার লোকসভা ভোটের সঙ্গেই একসঙ্গে বিধানসভা ভোট হয়েছিল ওড়িশায়। যে ভোটে বিজেপির কাছে ব্যাপক ভাবে পরাজিত হয়েছে নবীনের দল। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভাণ্ডারের রহস্য উন্মোচনের যে দাবি বিজেপি করে এসেছিল এতদিন, এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখেও শোনা গিয়েছিল যে প্রতিশ্রুতি, তাকেই সাকার করেছে ওড়িশা প্রশাসন রবিবার।
এক সপ্তাহ আগেই ছিল জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা। যেদিন পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে গুন্ডিচায় নিজের মাসির বাড়ি যান জগন্নাথ, বলরাম ও শুভদ্রা। এবারের রথযাত্রা ছিল দুর্ঘটনাময়। দুই দর্শনার্থীর ভিড়ের চাপে মৃত্যু, শতাধিক মানুষের পদপিষ্ট হওয়ার মতো পরিস্থিতি এবং সবশেষে গুন্ডিচায় মাসির বাড়িতে রথ থেকে নামার সময় বলভদ্রের মূর্তির পিছলে পড়া, এবং তাতে বেশ কয়েক জন সেবায়ত ও ভক্তদের জখম হওয়া। সেই রথযাত্রার এক সপ্তাহের মধ্যেই খোলা হল পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভাণ্ডার।
রাজ্য সরকারের তরফে রবিবার সকালে মন্দিরে প্রবেশ করে ১১ জন কর্মকর্তার একটি দল। তাছাড়া ছিলেন মন্দিরের ম্য়ানেজিং কমিটি, যার নেতৃত্বে রয়েছেন পুরীর রাজা দিব্যসিংব দেব। রয়েছে একটি আইএএস স্তরের অফিসার ও ওড়িশা সরকার কর্তৃক নির্বাচিত রত্নভাণ্ডারের নিরাপত্তায় থাকা অন্যান্য সদস্যরা। রত্নভাণ্ডার উন্মোচনের সময় ছিলেন ওড়িশা ওড়িশা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বিশ্বনাথ রথ, জগন্নাথ মন্দিরের চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার অরবিন্দ পাধি, এএসআই সুপার ডি বি গদনায়ক ও গজপতি মহারাজ। এছাড়াও রত্নমভাণ্ডারে প্রবেশ করেন মন্দিরের সেবায়েত পতযোশী মহাপাত্র, ভাণ্ডার মেকআপ, ছাদুকরণ ও দেউলিকরণ। এই মন্দিরের রত্নভাণ্ডার খোলার বিষয়ে আগেই কমিটি গড়েছিল রাজ্য সরকার। সেই নবগঠিত কমিটির প্রথম বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রত্নভাণ্ডার খোলার।
কমিটির চেয়ারম্যান বিশ্বনাথ রথ জানান, ওই রত্নভাণ্ডার খোলার আগে দেবী বিমলা ও দেবী লক্ষ্মীর অনুমতি নেওয়া হয়। তাঁরাই এই কোষাগারের মালিক। সবশেষে অনুমতি চাওয়া হয় ভগবান লোকনাথের কাছে, যাকে রত্নভাণ্ডারের তত্বাবধায়ক বলে মনে করা হয়। ১৯৮০-র দশক থেকে মন্দির প্রশাসন দু'বার এই রত্নভাণ্ডারের ভিতরের কক্ষ খোলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ চেষ্টাটি হয় ২০১৮ সালে। সে সময় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (ASI)-র তিন সদস্য-সহ একটি ১৬ সদস্যের দল গড়া হয়। কিন্তু চাবি পাওয়া না যাওয়ায় কোষাগারের ভিতরে ঢোকা সম্ভব হয়নি তাঁদের পক্ষে। ১৯৭৮ সালে শেষ যখন রত্নভান্ডারের দরজা খুলেছিল, তার অডিট করতে সময় লেগেছিল প্রায় ৭০ দিন। সে সময়ের হিসেব অনুযায়ী, জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভান্ডারে মোট ১২,৮৩৩ ভরি ওজনের ৪৫৪ ধরনের সোনার অলঙ্কার ও ২২,১৫৩ ভরি ওজনের ২৯৩ রকমের রৌপ্য অলঙ্কার ছিল।
২০১১ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ওড়িশা রিভিউ নামে একটি গেজেট পত্রিকা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু বাইরের প্রকোষ্ঠেই রয়েছে জগন্নাথের একটি সোনার মুকুট এবং তিনটি সোনার হরিদকণ্ঠী মালা। প্রত্যেকটি তৈরি হয়েছে ১২০ তোলা, অর্থাৎ ১৪০০ গ্রাম (প্রায় দেড় কেজি) সোনা দিয়ে। এ ছাড়া রত্নভান্ডারে রয়েছে জগন্নাথ এবং বলভদ্রের সোনার তৈরি শ্রীভুজ বা সোনার হাত। রয়েছ জগন্নাথ এবং বলভদ্রের সোনার পা-ও। ভিতরের রত্নকক্ষে আছে ৭৪টি সোনার গহনা। প্রত্যেকটির ওজন কমপক্ষে ১ কেজি করে। এ ছাড়া রয়েছে সোনা, হিরে, প্রবাল, মুক্তো দিয়ে তৈরি ‘প্লেট’। ১৪০টি ভারী রূপার গহনাও রয়েছে মন্দিরের ভিতরের রত্নকক্ষে। এ ছাড়া জগন্নাথের অলঙ্কারসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে সোনার তৈরি ময়ূরের পালক। কপালে পরার সোনার পট্টি। যার নাম চালুপাটি। রয়েছে জগন্নাথের সোনার কানের দুল শ্রীকুণ্ডল। সোনার কদম্ব মালা, সোনার চক্র, সোনার গদা, সোনার পদ্ম এবং সোনার শঙ্খ। এর পাশাপাশি রত্নখচিত সোনার তৃতীয় নয়নও রয়েছে ওই তালিকায়। সোনার পাতের তৈরি একটি চোখের মাঝে রয়েছে হিরে। অন্যটির মাঝে রয়েছে পান্না। ১৮০৫ সালে,পুরীর কালেক্টর চার্লস গ্রোম অভ্যন্তরীণ চেম্বারে সংরক্ষিত অলঙ্কারের একটি তালিকা তৈরি করিয়েছিলেন, যাতে ১,৩৩৩টি জিনিসের উল্লেখ ছিল। জগন্নাথধামের অন্দর-ভাণ্ডারে বৈদুর্যমণি, নীলকণ্ঠমণি-সহ একাধিক মূল্যবান রত্ন রয়েছে বলে দাবি পাণ্ডাদের। পুরী জগন্নাথ মন্দির সেবায়েত বিজয় সিংহারি বলেন, আমার বাবা বহু বছর আগে দেখেছিলেন জগন্নাথের রঘুনাথ বেশের প্রচুর মনিমানিক্য় এখানে আছে। শোনা যায়, যে কক্ষগুলিতে ১২৮টি স্বর্ণমুদ্রা, ১২৯৭টি রৌপ্য মুদ্রা, ১০৬টি তামার মুদ্রা এবং ২৪টি প্রাচীন সোনার মুদ্রা রয়েছে।
রবিবার দুপুর ১.২৮ নাগাদ খুলে যায় ওই রত্নভাণ্ডারের দরজা। রীতিমতো 'পুরোহিত' ও 'মুক্তি মণ্ডপ'-এর পরামর্শ অনুযায়ী ওই সময়টিকেই শুভ বলে নির্বাচন করা হয়েছিল। যাকে তাঁদের ভাষায় বলা হয়েছে 'সুবা বেলা'। শোনা যেত, জগন্নাথের রত্নভান্ডারের পাহারায় রয়েছে বিষধর সব সাপ। সে জন্য সাপ ধরায় অভিজ্ঞদেরও নিয়ে আসা হয়েছিল রত্নভাণ্ডার উন্মোচনের সময়। রাখা হয় মেডিক্যাল টিমও। গোটা প্রক্রিয়াটারই ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়েছে, যাতে পরে কোনও প্রশ্ন উঠতে না পারে। ঠিক করা হয়েছে, রত্নভান্ডারের অডিট ও গণনার সময় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে করা হবে। এবং সেই কাজ শেষ হলে তৈরি করা হবে একটি ডিজিটাল ক্যাটালগও। ওই রত্নভাণ্ডারটির মেরামতির কাজও করবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে।
আরও পড়ুন:কী এমন রয়েছে জগন্নাথের রত্নভাণ্ডারে? রহস্য সমাধান করতে পারবে বিজেপি?
কমিটির বৈঠকেই ঠিক হয়েছিল, মন্দির কর্তৃপক্ষের থেকে ডুপ্লিকেট চাবি আনিয়েই খোলা হবে রত্নভান্ডারের দরজা। তা যদি না পাওয়া যায়, তাহলে ভাঙা হবে তালা। যদিও খোলার পর ওই রত্নভাণ্ডার আগলে রাখা কোনও সাপ বা অন্য সরিসৃপের দেখা পাওয়া যায়নি। রবিবার সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয় রত্নভাণ্ডার উন্মোচনের কাজ। জানা যায়, রত্নভান্ডারের ভিতরে দু’টি প্রকোষ্ঠ বা রত্নকক্ষ রয়েছে। একটি বাইরের কক্ষ। অন্যটি ভিতরের। দু’টি কক্ষের ভিতরেই রয়েছে জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার অলঙ্কারসামগ্রী। এর মধ্যে বাইরের কক্ষটি থেকে যাবতীয় অলঙ্কার সিন্দুকে ভরে অস্থায়ী ‘ভল্টে’ রাখা হলেও ভিতরের কক্ষ থেকে প্রায় কিছুই বের করে আনা যায়নি। মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন , সময় পেরিয়ে যাওয়ার কারণেই মাঝপথে কাজ বন্ধ করতে হয়। তবে তালা ভেঙে ভিতরের কক্ষটিতে প্রবেশ করা গিয়েছে। সেখানে কবে কাজ হবে, তার দিন পরে ঠিক করে জানিয়ে দেওয়া হবে।
গত মাসেই জগন্নাথ মন্দিরের বাইরের দেওয়ালের চারটি ফটক ভক্তদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। যা বন্ধ ছিল কোভিড-অতিমারির সময় থেকে। এই চারটি ফটক ভিন্ন চারটি দিকে খোলে। চারটি প্রাণী দ্বারা চিহ্নিত এই চার ফটক। পূর্বদিকে রয়েছে সিংহদ্বার, পশ্চিমে রয়ে ব্যাঘ্রদ্বার, উত্তরে হস্তিদ্বার এবং দক্ষিণে অশ্বদ্বার। সেই চারটি ফটক খুলে যাওয়ার পর এবার খুলে গেল দ্বাদশ শতকের এই প্রাচীন মন্দিরের রত্নভাণ্ডারের দরজাও। তা-ও আবার এই রথের মরসুমেই। তবে এবার রথের সময় পুরীতে যে পরিমাণ বিপত্তি ঘটেছে, তাতে রত্নভান্ডার খুলে ফেলা নিয়েও আতঙ্কে রয়েছে অনেকের মনেই। এবার কি সামনে আসবে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের বিপুল রত্নরাজির হিসেব? আপাতত সেটাই জিজ্ঞাসা দেশবাসীর।