বিশ্বের ক্রূরতম মানুষ! প্রকাশ্যে এল সেই ‘ইভান দ্য টেরিবল’-এর ভয়ঙ্কর মুখ
Ivan The Terrible: ইভ্যান দ্য টেরিবল ছিলেন রাশিয়ার প্রথম জার। পাশাপাশি মস্কোর গ্র্য়ান্ড প্রিন্স ছিলেন তিনি। পুরো নাম ইভ্য়ান চতুর্থ ভ্যাসিলিভিচ।
ক্রূর বা নিষ্ঠুরতম মানুষ বললে প্রথমেই কার কথা মনে পড়ে। কেউ বলবেন হিটলার, কেউ বা হাল আমলের পরিস্থিতি দেখে বলতে পারেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু কিংবা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো শাসকের কথা। স্বৈরাচারী, অত্যাচারী শাসক এ বিশ্বে ভুরি ভুরি রয়েছে। তবে তারা কেউই টেক্কা দিতে পারবেন না 'ইভান দ্য টেরিবল'-কে। এমনটাই মনে করে ইতিহাস। যিনি হাসতে হাসতে নিরপরাধ ছেলের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিতে পারেন। তবে তাঁর চেহারা নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কেউ মনে করতেন, তিনি খুব লম্বা, মোটা শক্তিশালী চেহারাযুক্ত। কেউ বলতেন, তাঁর দাড়ি লাল। কেউ কেউ মনে করেন ইভানের নাকটি ছিল খুব লম্বা এবং আঁকাবাঁকা। সব মিলিয়ে তাঁর চেহারাটা তেমন মনে ধরার মতো ছিল না মোটেই। যেমন চেহারা, তেমনই খিটখিটে স্বভাব। প্রায়শই রাগে উন্মাদ হয়ে যাওয়া এই ইভ্যান দ্যা টেরিবলকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই।
ইভ্যান দ্য টেরিবল ছিলেন রাশিয়ার প্রথম জার। পাশাপাশি মস্কোর গ্র্য়ান্ড প্রিন্স ছিলেন তিনি। পুরো নাম ইভ্য়ান চতুর্থ ভ্যাসিলিভিচ। ১৫৩০ সাল নাগ মস্কোর গ্র্যান্ড ডাটিক কোলোমেন্সকোয়ে জন্ম হয় তাঁর। বাবা ভ্যাসিলি তৃতীয় ছিলেন মস্কোর গ্র্যান্ড প্রিন্স। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারান ইভান। অন্য কোনও উত্তরাধিকারী না থাকায় মাত্র তিন বছর বয়সে সিংহাসনে বসতে হয়েছিল তাঁকে। ইভানের মা এলেনা গ্লিনস্কায়া ছিলেন লিথুনিয়ার গ্র্যান্ড ডাচির এক সম্ভ্রান্ত মহিলা। বাবা মারা যাওয়ার পর এলেনাই সাম্রাজ্যের দায়িত্ব সামলান। ইভানকে সময় দিতে পারতেন না মা। তার উপর গতে বাঁধা রাজকীয় জীবন। তা-ই যেন ছোট থেকেই খিটখিটে করে তুলেছিল ইভানকে। তাঁর যখন আট বছর বয়স রাজষড়যন্ত্রের শিকার হলেন এলেনা। এবার মাকেও হারালেন ইভান। ১৫৪৭ সালে সতেরো বছর বয়সে রাশিয়ার গ্র্যান্ড প্রিন্সের মুকুট উঠল ইভানের মাথায়। জার উপাধিও পেলেন তিনি। রাজা হিসেবে রাজকর্তব্যই করেছিলেন ইভ্যান। তবু কীভাবে যেন তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেল ক্রূরতার লেবেল।
আরও পড়ুন: বাংলা জুড়ে পাঁচিল তুলেছিলেন, কৈবর্ত রাজা ভীমের যে ইতিহাস আজও অজানা
যতদূর জানা যায় নয় নয় করে অন্তত আটটি বিয়ে করেছিলেন ইভান। যদিও তার মধ্যে চার্চ দ্বারা স্বীকৃত ছিল মাত্র চারটি। তাদের মধ্যে তিন জনকে বিষ দিয়ে খুনের ষড়যন্ত্র করা হয়। রাজপরিবারে এই সব ষড়যন্ত্র লেগেই থাকে। শৈশব থেকে এইসব দেখে দেখে বড় হওয়ার দরুণই সম্ভবত ইভ্যান সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারতেন না আর। আর তার অবিশ্বাসের দাম চোকাতে হত সেই ব্যক্তিকে জীবন দিয়ে। এমনকী নিজের পুত্র যিনি কিনা রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী, তাঁকেও অন্ধরাগে হত্যা করেন ইভ্যান। সন্ত্রাসপ্রেমী রাজা হিসেবেও দেশে বদনাম হয়ে গিয়েছিল তাঁর।
তিরিশে পৌঁছতে পৌঁছতেই বিকার এসে চেপে ধরে ইভানকে। ছোট থেকে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন মেধাবী এই শাসক। গানবাজনা জানতেন। রাজ্য শাসন করতে জানতেন ভালোই। নিজের রাজত্ববৃদ্ধির চেষ্টাও অনবরত করে গিয়েছেন। একাধিক নীতি পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে তাঁর সময়ে। অথচ ওই উগ্র, চণ্ড রাগই বোধহয় তাঁকে চিহ্নিত করে রাখল পৃ্থিবীর নিষ্ঠুতম অত্যাচারী মানুষ হিসেবে। নৃশংস, অমানবিক পদ্ধতিতে মৃত্যদণ্ড দেওয়ার জন্য যার এত বদনাম।
তা এই রুশ জার মারা যান ১৮৫৪ সালে। ইভান দ্যা টেরিবলের তেমন কোনও ছবি বা প্রতিকৃতি এতদিন পাওয়া যেত না। সম্প্রতি ইভান দ্য টেরিবল মুখের বৈজ্ঞানিক পুনর্গঠন করেছেন ব্রাজিলিয়ান এক গ্রাফিক শিল্পী। আর তার জন্য তিনি নৃশংস এই স্বৈরাচারীর সমাধিক্ষেত্র থেকে তুলে আনেন বিভিন্ন নমুনা। সোভিয়েত গবেষক মিখাইল গেরাসিমভ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন সেই কাজে। মিখাইলের গবেষণা অনুযায়ী, ইভান দ্য টেরিবেল নাকি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ডুবে যান খাওয়াদাওয়া ও মদ্যপানে। জীবনযাপন হয়ে পড়ে আরও উশৃঙ্খল। জীবনের শেষ দিনগুলোয় তাঁর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে।
তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেও বিষপ্রয়োগের যোগাযোগ রয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। কারণ তাঁর শরীরে প্রচুর পরিমাণে পারদ পাওয়া যায়। সেই পারদই কি দায়ী তাঁর মৃত্যুর জন্য, তা অবশ্য জানা যায়নি। সেই ইভানের মাথার খুলি জুড়ে জুড়ে তার উপর ত্বকের স্তর তৈরি করে করে ইভ্যান দ্যা টেরিবলের এক ডিজিটাল চেহারা তৈরি করেছেন গ্রাফিক শিল্পী সিসরো মোরেস। এর সঙ্গে তাঁকে সাহায্য করেছে ইভানের সম্পর্কে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য। প্রযুক্তির দৌলতে আজকাল কী-ই না সম্ভব। ৪৪০ বছর আগে মৃত রুশ শাসককে বিমূর্ত করে তোলাও সম্ভব আজকের দিনে। আর সে কথাই ফের প্রমাণ করেছেন ওই গ্রাফিক শিল্পী।
আরও পড়ুন: রানিকে আস্ত মেলা উপহার! কেন দোল শেষে শুরু হয় প্রাচীন বারোদোল মেলা?
তবে ইভান দ্য টেরিবলের রক্তমাংসের ছবি তৈরি করার পর ইতিহাসের নানাবিধ জল্পনার উপরেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন মোরেস। যে জঘন্য রূপ ইতিহাস প্রথম থেকে বর্ণনা করে এসেছে ইভানের, তিনি ততটাও ভয়ঙ্কর নন বলেই মনে করছেন শিল্পী। তার উপর ইভানের বাঁকাট্যারা নাক নিয়ে যে সব কথাবার্তা চলত, সেগুলোও তেমন জোরালো নয় বলে মনে করেছেন মোরেস। তা কোন শিল্পীরই বা নিজের সৃষ্টিকে খারাপ লাগে বলুন তো। প্রযুক্তি এবং ঐতিহাসিক প্রমাণ জোগার করে যতই তিনি রুশ জারের প্রতিকৃতি তৈরি করুন না কেন, তা তো স্রষ্টার কাছে সুন্দর হবেই।