দেবতাদের প্রিয় মদ! জানেন, উত্তরভারতের কোথায় লুকিয়ে আছে সোমরস তৈরির উপকরণ?

Somras The Alcohol: অশ্বিনীকুমারেরা শূদ্র জাতীয় দেবতা বলে ইন্দ্রাদি উচ্চবর্ণীয় দেবতারা মোটেও চাইতেন না যে তাঁরা সেই উচ্চমানের সোমরস ভোগ করুন।

সোমরস সম্পর্কে আমি, আমার মতো আরও অনেকেই, প্রথম জানতে পারি ছোটবেলায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পৌরাণিক রচনাগুলিতে। সেখানে বলা হয়েছে, দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হতো সোমলতা গাছের এই রস, যার নাম সোমরস। দেবতাদের প্রিয় এই সোমরস আসলে এক রহস্যময় পানীয়। যার উৎস যে ঠিক কী, সে সম্পর্কে পণ্ডিতদের অনেক মতবিরোধ আছে। কেউ বলেন এটি একটি লতা, কেউ বলেন এটি ওষধি। এটি আদৌ মদ নাকি কেবল এক স্বাদু পানীয়, তা নিয়েও নানা মুনির নানা মত।

বৈদিক কাল থেকেই সোমরসকে শ্রেষ্ঠ পানীয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। পানীয় বলতেই মদের কথা মনে আসে। আসলে মদ্যপানকে এখনও বেশ 'নিন্দনীয়' ভেবে বাঁকা চোখে দেখা হলেও, বৈদিক কাল থেকেই কিন্তু এর প্রচলন ছিল। অবশ্য পণ্ডিতেরা সোমরসকে কোনওভাবেই ঠিক মদ্য বলতে চান না। মদ কিনা দেবতাদের প্রিয় পানীয়! এই 'ট্যাবু' থেকে বেরনো খানিক সংশয়ের বৈকি! পণ্ডিতদের মতে, এটি খুব উচ্চস্তরের উত্তেজক পানীয় কিন্তু মদ বলতে তাঁরা নারাজ। যতই মদ নয় বলে প্রচার করা হোক না কেন, বেদে সোমরসের যা বর্ণনা আছে (মদেষু সর্বধা অসি…) তাতে আর কিছু না হলেও সোমরসের যে মাদকতা ছিল, সেই কথা কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ঐতরেয় ব্রাহ্মণানুসারে এই নিয়ে দেবতাদের দৌড় প্রতিযোগিতাও হয়েছে। আর সোমরস যে কেবল দেবতাদের প্রিয় তাই নয়, মুনি-ঋষিদেরও অত্যন্ত প্রিয় ছিল। এই যে রহস্যময় সোমরস, যার জন্য স্বয়ং দেবতা থেকে ঋষিগণ সবাই ব্যাকুল, আসলে কী সেই রস?

আরও পড়ুন- বাল্মীকির দায়সারা চরিত্র! যেভাবে রামের হাতে মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিল অনার্য মারীচ

এটি যে খুব দুর্লভ পানীয় ছিল, তা স্পষ্ট! দেবতা বা ঋষিরা চাইলেই কিন্তু এর আস্বাদ পেতেন না। দেবভোগ্য জিনিস বলে কথা, সবাইকে কি আর যথেচ্ছভাবে বন্টন করা যায়? সোমরসের নাম যেমন অভিজাত, তেমনই তার আস্বাদনকারীকেও ঠিক সেই রকম অভিজাত হতে হবে। দেবতাদের যদি কেউ আজকালকার ভাষায় ‘ভিভিআইপি ট্রিটমেন্ট’ দিতে চাইতেন, তাহলে তিনি মজুত রাখতেন সোমরস। আর বৈদিক যুগে দেবতাদের ভিভিআইপি ট্রিটমেন্টের অর্থই ছিল, বিবিধ প্রকারের মহাযজ্ঞ করে দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য তাঁদের উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়া। সোমরস ছিল সেই আহুতির মূল উপকরণ। সোমরস আসলে এতটাই মহার্ঘ আর দুর্লভ ছিল যে, এর কণামাত্র লাভ করার জন্যও দেবতা থেকে ঋষি, সবাই উদগ্রীব হতেন। আর দেবতাদের আহুতি দেওয়ার পর, যেটুকু সোমরস হুতাশেষ হিসেবে পড়ে থাকত, সেটুকু ভোগ করতেন যজ্ঞকারী ঋষিরা। সেটাই ছিল তাঁদের তৃপ্তি।

সোমরস এত দুর্লভ হওয়ার আরেকটি কারণ ছিল বোধহয় এটি তৈরি করার পদ্ধতি। একেই তো সোমলতা নামক লতাটি পাওয়া দুষ্কর, তারপর সেই লতা থেকে রস নিষ্কাশন করাও ছিল অত্যন্ত পরিশ্রমসাপেক্ষ। অনেক দূর থেকে সোমলতা নিয়ে আসা হতো। যেহেতু সোমরস যজ্ঞের প্রধান উপকরণ তাই রীতিমতো মন্ত্রোচ্চারণ করেই এই রস নিষ্কাশন করা হতো। লতার ডগা বা অংশুগুলি ছেঁচে রস বের করে সেগুলিকে এক বিশেষ ধরনের ভেড়ার লোমযুক্ত ছাঁকনি বা ‘অব্য’-র মাধ্যমে ছেঁকে শুদ্ধ বা ফিল্টার করে নেওয়া হতো। এরপর এর সঙ্গে দুধ, দই বা যব মিশিয়ে তৈরি করা হতো সেই দেবভোগ্য পানীয়। বোঝা যায়, দামী দামী মদ আস্বাদন করতে যেমন পানশৌণ্ডেরা লালায়িত হন, বিভিন্ন মদ্যপান করে তাদের বিভিন্ন স্বাদ আস্বাদন করেন, স্বর্গের শ্রেষ্ঠ পানীয় তথা প্রায়-মদ্য সোমরস পান করতে দেবতা এবং ঋষিরাও হয়তো তেমনই আনন্দ পেতেন। দেবতার সঙ্গে মদ বিষয়টিকে মেলানো না গেলেও, বিষয়টি আখেরে তাই।

এই আপাতনিরীহ সোমরসকে কেন্দ্র করে আরও একটি বিষয় ছিল, যা খানিক অনালোকিত। সেটি হলো, এই পানীয় গ্রহণ করার অধিকার। সোমরস তো কেবল পানীয় নয়, এটি দেবসমাজে 'স্টেটাস'-এর পরিচায়ক। খোদ দেবতা, যাদের মানুষ কারণে-অকারণে স্মরণ করে, যারা অঘটনঘটনপটু, তাঁদের মধ্যেও মানবসমাজের মতো বিভাজন কাজ করত! অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য, শূদ্র ভেদাভেদ ছিল। ঠিক সেই কারণেই দেবচিকিৎসক অশ্বিনীকুমার ভ্রাতৃদ্বয় যজ্ঞকালে সোমরসের ভাগ পেতেন না। কারণ তাঁরা ছিলেন শূদ্র গোত্রীয় দেবতা। এই মানবসমাজেও যেমন সবথেকে ভালো সুবিধাটি হোমরাচোমরা মানুষদের জন্য তোলা থাকে, ভাবতে আশ্চর্য লাগে, দেবতাদের সমাজেও তাই। আর এই সোমরস নিয়ে দেবতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে থাকলেও সব থেকে বেশি যার দাবি ছিল সোমরসের উপর, তিনি হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। আর তাঁকে সোমরস উৎসর্গ করতে যাজ্ঞিক মুনিরাও কোনওপ্রকার কার্পণ্য করতেন না। যাইহোক, অশ্বিনীকুমারেরা শূদ্র জাতীয় দেবতা বলে ইন্দ্রাদি উচ্চবর্ণীয় দেবতারা মোটেও চাইতেন না যে তাঁরা সেই উচ্চমানের সোমরস ভোগ করুন। আর পুরাণজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই ঋষি চ্যবনের কাহিনি জানেন, যিনি অশ্বিনীকুমারদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশে দেবরাজ ইন্দ্রের বিরুদ্ধে গিয়ে যজ্ঞভাগ হিসেবে তাঁদের সোমরস নিবেদন করেছিলেন। ইন্দ্র তাঁকে বজ্র দ্বারা বাধা দিতে গেলে মহর্ষি চ্যবন যোগবলে তাঁকে প্রতিহত করেন। বলা যেতে পারে, এটিও বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে তার প্রাপ্য অধিকার পাইয়ে দেওয়ার লড়াই। এখনকার সমাজেও আমরা খুঁজলে এমন মানুষ পাব।

এই সোমরসের সঙ্গে 'স্টেটাস' বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। সোমরসের মতো উচ্চমার্গীয় পানীয়কে কখনই সাধারণ মদ্যের সঙ্গে তুলনা করাই হয়নি। সুরার মতো খেয়ে নেশাগ্রস্ত হওয়ার জন্য সোমরস নয়। তাই সুরা বা সাধারণ মদ্য ছিল দেবতা ও ঋষিগণ বাদে ক্ষত্রিয়সহ বাকি তিন বর্ণের ভোগ্য। এই সুরা কিন্তু এখনকার দিনের সুরার মতোই, ভাতে জল মিশিয়ে ফার্মেন্টেশন করার পদ্ধতি বৈদিকেরা জানতেন, “যৎ সুরা ভবতি…তদথো অন্নস্য রসঃ”। আরও এক ধরনের সুরা ছিল, তার নাম ছিল পরিস্রুত। সোমরসের সঙ্গে সুরা ও পরিস্রুতের মূল পার্থক্য এই যে, সোমরস নন-ফার্মেন্টেড, আর বাকি দু'টি ফার্মেন্টেড। সোমরসপান আসলে একটি উত্তেজনা বহন করে, পায়ীকে সম্ভ্রান্ত করে, দৃষ্টি আরও উজ্জ্বল হয়, যাকে বলে মানুষ চনমনে হয়ে ওঠে, নতুন জীবনীশক্তি পায়, তাহলে এটাও কি বলা যায় যে, সোমরসপান অমৃতপানের সমতুল্য? কারণ অমৃতপান অমর করে, এই অমরত্ব তো নতুন জীবনীশক্তিরও নামান্তর।

আরও পড়ুন- বছরে একবার নিশুতি রাতে জন্ম নেয় ব্রহ্মকমল! হিমালয়ের ফুল ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য

পরিশেষে একটি 'রিয়েলিটি চেক'। এই স্বর্গীয় রহস্যময় পানীয়ের স্বরূপ বৈদিক পণ্ডিতেরা নির্ণয় না করতে পারলেও এক সাহেব কিন্তু তা পেরেছিলেন। সাহেবের নাম রবার্ট গর্ডন ওয়াসন (Robert Gordon Wasson)। তিনি এই সোমলতার বিষয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। বেদে যেভাবে সোমলতার বর্ণনা করা হয়েছে, সেই অনুযায়ী, সোমলতা এটি রাত্রিবেলায় জ্যোতিষ্মান হয়, দিনের বেলায় ঈষৎ লাল রঙের বা কখনও সাদা রঙের হয়। এই সকল বর্ণনা এবং আরও অন্যান্য বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে ওয়াসন সাহেব দেখেছিলেন যে, একটি বিশেষ ধরনের 'ছত্রাক' বা ব্যাঙের ছাতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেই এই বর্ণনা মেলে। এর ল্যাটিন নাম হলো Amanita Muscaria। এই ছত্রাক উত্তরভারতের পার্বত্য প্রদেশে পাওয়া যায়, এটিই হলো সেই সোমলতা!

১৯৭১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা প্রদেশের এক বিদ্বৎসভায় এই তত্ত্ব ওয়াসন সাহেব প্রকাশ করেন, এই তত্ত্বের আধার বইটি হলো- ‘Soma: The Divine Mushroom of Immortality’! বলা বাহুল্য, ভারতীয় বৈদিক পণ্ডিতেরা এই বিষয়ে প্রথমে একটু আপত্তি তুলেছিলেন ঠিকই। অত চর্চিত, দুর্লভ, জাদুকরী রহস্যময় পানীয়ের উৎস যদি গিয়ে দাঁড়ায় একটি সামান্য ছত্রাকে, তাহলে ধাক্কা খাবারই কথা। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা নিজেরাই এই গবেষণাকে সঠিক বলে মেনে নিয়েছেন। কেউ মানুক বা না মানুক, আর সোমরসের উৎস যাই হোক, সোমরসের অমৃতসম মোহময়তা চিরকালই আছে, থাকবেও।

তথ্যঋণ-
১) নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী- পুরাণী
২) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী- গল্পসমগ্র

More Articles