ঝুলে থাকা মানেই ত্রিশঙ্কু! যে বিচিত্র দশা হয়েছিল পুরাণের এই রাজার
Trishanku Mythology: বিশ্বামিত্র রেগে গিয়ে পতনোন্মুখ রাজাকে তিষ্ঠ, তিষ্ঠ বলে মাঝ আকাশে থামালেন, তারপর যোগবলে দক্ষিণ আকাশে আরও একটি নক্ষত্রলোক ও সপ্তর্ষিমণ্ডল সৃষ্টি করলেন।
বাংলায় একটি কথা আছে, “ত্রিশঙ্কু দশা" বা "ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকা”। কথাটির মানে হলো অনিশ্চয়তা। কিন্তু অনিশ্চয়তা বোঝাতে 'ত্রিশঙ্কু' শব্দটি কেন বলা হয়? এর নেপথ্যে আছে এক পুরাকাহিনি। রাজা হরিশচন্দ্র তো রামায়ণ সুবাদে সকলেরই চেনা। দাতা হিসেবে তিনি সুবিদিত। কিন্তু এই গল্প হরিশচন্দ্রের নয়, তাঁর পিতা রাজা সত্যব্রত ওরফে ত্রিশঙ্কুর। রাজা সত্যব্রতর পিতা ছিলেন সূর্যবংশের রাজা এয্যারুণ। তিনি অত্যন্ত সুশাসক ছিলেন, তাঁর রাজত্বে কোনও প্রজার মনে দুঃখ ছিল না। কিন্তু হলে কী হবে, স্বয়ং রাজার মনই ছিল দুঃখে ভারাক্রান্ত। কারণ তাঁর যে একমাত্র পুত্র, সত্যব্রত, তিনি একজন দুর্জন ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তিনি কাউকে শান্তিতে থাকতে দিতেন না, অত্যাচার করাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। এয্যারুণ এই পুত্রকে নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তায় থাকতেন আর নিজের ভাগ্যকেই দোষ দিতেন, কারণ তিনি স্বাভাবিকভাবেই চাইতেন তাঁর পুত্র তাঁর মতোই সুশাসক হবেন, প্রজাদের কল্যাণকামনা করবেন। কিন্তু তা না হয়ে পুত্র হলেন সীমাহীন অত্যাচারী। রাজা এয্যারুণ ভাবলেন, বিবাহ দিলে হয়তো ছেলের এই স্বভাব পরিবর্তিত হবে। তাই পুত্রবধূ করে আনলেন কেকয় রাজবংশের কন্যা সত্যরথাকে। কিন্তু বিয়ের পরেও কিছু বদলাল না। উলটে প্রজাদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেল। চরের মুখ রাজা সব খবরই পান, আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেন। শেষে একদিন সত্যব্রত এক ভয়ানক কাণ্ড করে বসলেন। নগরবাসী এক কন্যার বিবাহতে তিনি উপস্থিত হয়ে বিবাহের কার্যে বাধা দিয়ে সপ্তপদী শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটিকে হরণ করে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেন। এই খবর শুনে এয্যারুণ ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি সত্যব্রতকে ধরে নিয়ে গেলেন তাঁদের কুলগুরু বশিষ্ঠের কাছে। তাঁর সামনেই তাঁকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করলেন, শেষে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিয়ে বললেন, তোমার যখন চণ্ডালের মতোই স্বভাব তাহলে চণ্ডালদের সঙ্গেই বাস করো গিয়ে।
বাধ্য হয়ে সত্যব্রত চণ্ডালপল্লীতে গিয়ে বসবাস শুরু করলেন। এদিকে এয্যারুণের মন আরও খারাপ, রাজকার্যে কিছুতেই মন বসাতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত একদিন রাজা রাজ্যত্যাগ করে বনবাসে গিয়ে ধর্মকর্মে মন দিলেন। এদিকে রাজাহীন রাজ্য মানেই অরাজকতা। অধর্মে দেশ ছেয়ে গেল, বারো বছর রাজ্যে বৃষ্টি হলো না। অনাবৃষ্টিতে দেখা গেল খরা, আর খরা থেকে দুর্ভিক্ষ। এদিকে যে চণ্ডালপল্লীতে সত্যব্রত থাকেন, সেই পল্লীর কাছেই ছিল ঋষি বিশ্বামিত্রের আশ্রম। সেই ঋষি বিশ্বামিত্র, যিনি প্রবল তপস্যার জোরে ক্ষত্রিয় থেকে ঋষি হয়েছিলেন। যাই হোক, সত্যব্রত মাঝে মাঝেই যেতেন বিশ্বামিত্রের আশ্রমে, আশ্রমে যেতে তাঁর ভালোই লাগতো। এদিকে রাজ্যজুড়ে দুর্ভিক্ষ, দুর্ভিক্ষের ছোঁয়া আশ্রমেও লেগেছে। এবার হয়েছে কী, ঋষি বিশ্বামিত্র এই দুর্ভিক্ষের কিছু আগেই সাগরে চলে গেছেন তপস্যা করতে। এদিকে ঋষিপত্নী এই দুর্ভিক্ষের সময় কিছুতেই সংসার প্রতিপালন করতে পারছেন না। শেষে তিনি এক অদ্ভুত কাজ করলেন। নিজের মেজো ছেলেটির গলায় দড়ি বেঁধে একশত গাভীর বিনিময়ে তিনি যখন বিক্রয় করে দিচ্ছেন, ঠিক সেই সময় সত্যব্রত এসে উপস্থিত হলেন আশ্রমে। ঋষিপুত্রের এমন অবস্থা দেখে সত্যব্রতের খুব মায়া হলো। তিনি দড়ি খুলে ঋষিপুত্রকে মুক্ত করে দিলেন, ওই গাভীগুলিকেও ফিরিয়ে দিলেন। গলায় দড়ি বাঁধা ছিল বলে সেই ঋষিপুত্রের নাম হল গালব। তিনিও পরে কঠোর তপস্যার বলে মহর্ষি হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-শকুন্তলা মানেই, নরম, স্নিগ্ধ, কোমলমতি? অবাক করবে ‘আসল’ শকুন্তলার কাহিনি
এবার বিশ্বামিত্রের পত্নী ও পুত্রের দিনাতিপাত হবে কী করে? এই ভেবে সত্যব্রত তাঁদের আশ্রমেই থেকে গেলেন। অত্যাচারী হলে কী হবে, খুব দায়িত্বের সঙ্গেই তিনি তাঁদের ভরণপোষণ করতেন, পশু মেরে সেগুলির মাংস দিয়ে। এদিকে রাজ্যে আরেক ঘটনা। এয্যারুণ বনবাসে যাওয়ার পর রাজ্যের দেখভাল করছিলেন বশিষ্ঠই। তিনি ভাবছিলেন সত্যব্রতর করা পাপকাজটির কথা। তিনি ভাবলেন, সপ্তপদী না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ সম্পন্ন হয় না, তাই কন্যাকে পরস্ত্রীও বলা যায় না। তাই বলা যায়, সত্যব্রত ঠিক পরস্ত্রী হরণকারী না। কিন্তু কন্যাহরণকারী তো বটে। সেটাও একটি পাপ। তাই ত্যাজ্যপুত্র হয়ে বনে গেলে তাঁর একটি প্রায়শ্চিত্তও হবে, এই কথা ভেবে তখন বশিষ্ঠ কিছু বলেননি। বারো বছর সম্পূর্ণ হলে সত্যব্রতের পাপ কেটে যাবে, আর তখন তাকে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করবেন— এমনটাও তিনি ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু সত্যব্রত বশিষ্ঠের এই গূঢ় অভিপ্রায় বুঝতে পারেননি। উলটে তাঁর উপর একটু রেগে গিয়েই ভেবেছিলেন যে বশিষ্ঠ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পিতার রোষ থেকে তাকে বাঁচাননি। বশিষ্ঠের উপরে তাঁর সুপ্ত রাগ ছিল।
দুর্ভিক্ষের কাল। একসময় এমন হলো, প্রায় দুই দিন ধরে সত্যব্রত নিজের আর বশিষ্ঠের পরিবারের কোনও খাবারই জোটাতে পারছেন না। নিজের জন্য যতটা অসহায়বোধ হচ্ছে, তাঁর চেয়েও বেশি অসহায় বোধ হচ্ছে বিশ্বামিত্রের পরিবারের জন্য। তিনি এবার খিদেয় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে লুকিয়ে বশিষ্ঠের আশ্রমে ঢুকে তাঁর কামধেনুটিকে চুরি করে নিয়ে এলেন। মনে মনে একটু প্রতিশোধের ইচ্ছাও ছিল। সেই কামধেনুকে বধ করে তিনি আর বিশ্বামিত্রের পরিবার সেই মাংস পেট ভরে খেলেন। এদিকে বশিষ্ঠ আশ্রমে ঢুকে কামধেনুকে দেখতে না পেয়ে যোগবলে ঠিক বুঝতে পারলেন একাজ সত্যব্রতর। ভয়ানক রেগে গিয়ে তিনি সত্যব্রতকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, যদি তুমি এই কাজ না করতে তাহলে তোমার সব দোষ ক্ষমা করে তোমাকে রাজা করতাম। কিন্তু আজ থেকে তোমার নাম সত্যব্রত থাকবে না, তুমি তিন তিনটি শঙ্কু অর্থাৎ পাপ করেছো, প্রথম পাপ পিতাকে অসন্তুষ্ট করা, দ্বিতীয় পাপ কুলগুরুর গোবধ করা, তৃতীয় পাপ নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করা। তোমার নাম আজ থেকে হলো ত্রিশঙ্কু।
আরও পড়ুন- বাল্মীকির দায়সারা চরিত্র! যেভাবে রামের হাতে মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিল অনার্য মারীচ
ব্রহ্মশাপ ফলবেই, আর তার উপর রাজ্যে অপরিসীম দুর্ভিক্ষ। এত কিছু চিন্তা মাথায় নিয়ে সত্যব্রত ওরফে ত্রিশঙ্কু চললেন আরও গভীর অরণ্যে, সেখানে গিয়ে তিনি কঠোর আত্মসংযম করে শুরু করলেন তপস্যা করা। বারো বছর ধরে তিনি তপস্যা করলেন। এদিকে বিশ্বামিত্র ততদিনে ফিরে এসেছেন তপস্যা করে। তিনি তাঁর স্ত্রীর মুখে শুনলেন, কীভাবে সত্যব্রত এতদিন তাঁদের পালন করেছেন। শুনে খুব খুশি হলেন। বারো বছর পর যখন সত্যব্রত বা ত্রিশঙ্কু ফিরে এসেছেন, তখন বিশ্বামিত্র তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যব্রতের কাজে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন, সত্যব্রত কী বর চান? সত্যব্রত বললেন , আমি যেন অযোধ্যায় নিজের ঘরে যেতে পারি। এই বরের জন্য বশিষ্ঠ সত্যব্রতকে রাজ্য সমর্পণ করলেন। এতদিন পর রাজ্যে বৃষ্টি হলো। দুর্ভিক্ষ কেটে গেল। আর সত্যব্রত এবার পিতার মতোই সুশাসক হলেন, প্রজাদের দুঃখ কষ্ট আর রইল না। সত্যব্রতের আরও একটি ইচ্ছা ছিল যে, সশরীরে স্বর্গে যাবেন। এবার যখন তাঁর স্বর্গে যাওয়ার মন হলো, তিনি তখন বিশ্বামিত্রকে জানালেন। এরপর বিশ্বামিত্রকে প্রধান পুরোহিত করে ত্রিশঙ্কু এক যজ্ঞ করলেন। সব মুনিদের নিমন্ত্রণ করলেন। বশিষ্ঠ, বশিষ্ঠের পুত্রগণ ও মহোদয় নামের এক ঋষি ছাড়া সকলেই এসে উপস্থিত হলেন। যজ্ঞ সমাপ্ত হলে বিশ্বামিত্র দেবতাদের অনুরোধ করলেন যে তাঁরা যেন রাজার নৈবেদ্য গ্রহণ করেন ও রাজাকে সশরীরে স্বর্গে নিয়ে যান। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কোনও দেবদেবীই সাড়া দিলেন না।
বিশ্বামিত্রের রাগ হলো। তিনি রাজার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেবতাদের সাহায্য ছাড়াই তিনি রাজাকে স্বর্গে প্রেরণ করবেন। এবার বিশ্বামিত্রের তেজোবলে ত্রিশঙ্কু বা সত্যব্রত সবেগে স্বর্গের দিকে উঠতে থাকলেন। এদিকে দেবতারা কিছুতেই সত্যব্রতকে স্বর্গে স্থান দেবেন না, কারণ তিনটি মহাপাপ করেছেন সত্যব্রত ওরফে ত্রিশঙ্কু। এছাড়াও আরও অনেক পাপ তো আছেই। তখন দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গের দিকে মুখ করে উপরে ওঠা ত্রিশঙ্কুকে অধোমুখে অর্থাৎ মাটির দিকে মাথা দিয়ে পৃথিবীতে নেমে যেতে বললেন। এবার বিশ্বামিত্র গেলেন রেগে। তাঁকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে দেখে তিনি এক অদ্ভুত কাজ করলেন। তিনি পতনোন্মুখ রাজাকে তিষ্ঠ, তিষ্ঠ বলে মাঝ আকাশে থামালেন, তারপর যোগবলে দক্ষিণ আকাশে আরও একটি নক্ষত্রলোক ও সপ্তর্ষিমণ্ডল সৃষ্টি করলেন। এবার সেখানে তিনি নতুন দেবতা ও নতুন ইন্দ্র সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে পড়লেন। এই দেখে দেবতারা ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁরা শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করে বললেন এই অবস্থাতেই ত্রিশঙ্কু বিশ্বামিত্র সৃষ্ট এই নতুন আকাশে থাকবেন। এই যে এক বিচিত্র অবস্থায় ত্রিশঙ্কু অবস্থান করতে লাগলেন, এই দশাই ত্রিশঙ্কু দশা নামে বিখ্যাত হলো।